জলোচ্ছ্বাস

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:৪৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

জলোচ্ছ্বাস (Tidal Bore)  সংকীর্ণ ও অগভীর নদীপথ অথবা মোহনায় প্রবল জোয়ারের সময় সৃষ্ট প্রাচীরাকৃতির উত্থিত তরঙ্গ। স্রোতের বিপরীতে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায় বলে জলোচ্ছ্বাসের পানি প্রাচীরের মতো উঁচু হয়ে ওঠে। সাধারণ জোয়ারের সময় উন্মুক্ত সাগরের চেয়ে উপকূলবর্তী অগভীর অংশে সমুদ্রের পানি অনেক বেশি উঁচু হয়ে ওঠে। ভরা কটালের (spring tides) সময় জোয়ার তরঙ্গ আরও প্রবল হয়। এ সময় অগভীর নদী মোহনায় বা উপকূলবর্তী অগভীর অংশে নদীর স্রোত দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে জোয়ারে উত্থিত তরঙ্গের চূড়া ভেঙে পড়ে এবং প্রবল জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। উপকূলীয় নদ-নদীর মোহনায় জলোচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন: আমাজন, হুগলী, সিন্ধু নদ, মেঘনা, ইয়াংসি-কিয়াং প্রভৃতি নদীর মোহনায় জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে। জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকার জলযানগুলির জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এই জলোচ্ছ্বাসের সময় নদীর সারফিং (River Surfing) খেলা ভালোভাবে করা যায়। জলোচ্ছ্বাস ‘বান’ নামেও সমধিক পরিচিত। জলোচ্ছাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। কখনও কখনও ঢেউগুলির সামনের অংশ একটি বড় আকারের পরিধি নিয়ে আসতে পারে। আবার কখনও ঢেউগুলোর অগ্রভাগ অনেক পরিধি নিয়ে অগ্রসর হতে পারে।

বাংলাদেশে জলোচ্ছ্বাস, বান, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস (tidal-surge), ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস (cyclonic-surge) এবং ঝড়ো-জলোচ্ছ্বাস (storm-surge) প্রায়ই কাছাকাছি বলে গণ্য করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রসরমান অংশ হিসেবে উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক পানির বিশাল তরঙ্গকে ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস (cyclonic-surge) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দুটি পৃথক ধরনের সামুদ্রিক অস্থিরতার সঙ্গে ঝড়-ঝঞ্ঝা একত্রিত হলে ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়। প্রথম ধরনের সামুদ্রিক অস্থিরতা হচ্ছে ঘূর্ণিতরঙ্গ (cyclonic wave)। এ ঘূর্ণিতরঙ্গ সামুদ্রিক ঝড়ের শান্তকেন্দ্রে সৃষ্টি হয়। বায়ুর প্রবাহ ও চাপের সমন্বয়ের ফলে সামুদ্রিক ঝড়ের কেন্দ্র ও তার চারপাশের বিশাল জলরাশি স্তম্ভের মতো কখনও কখনও প্রায় ৬/৭ মিটার পর্যন্ত ফুলে উঁচু হয়ে উঠতে পারে এবং বায়ুতাড়িত এ ঝড় ঝড়ো-জলোচ্ছ্বাস হিসেবে অগ্রসর হতে থাকে। ঝড়ো-জলোচ্ছ্বাস উপকূলে আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল জলরাশি প্রবল বেগে উপকূলে আছড়ে পড়ে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল  বন্যা সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় ধরনের সামুদ্রিক অস্থিরতাটি হলো ঘূর্ণিজোয়ার (cyclonic tide) যা তুলনামূলকভাবে বড় এলাকা জুড়ে সংঘটিত হয়। বিক্ষুব্ধ বায়ু প্রবাহের সময় উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের সাধারণ উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটলে এ জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়।

কখনও কখনও ৬ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠা উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে ছুটে আসা এ জলোচ্ছ্বাসের বিপুল জলরাশিকে প্রতিরোধ করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এপ্রিল অথবা মে মাসে এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে  ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়। প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক থেকে পাঁচটি প্রবল সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে এবং এর সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস ভূ-অভ্যন্তরভাগে প্রায় ২০০ কিমি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতার সঙ্গে ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা সরাসরি সম্পর্কিত। বাতাসের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে অমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা তিথির সংযোগ ঘটলে চাঁদ ও সূর্যের মিলিত আকর্ষণে সৃষ্ট প্রবল জোয়ারের ফলে জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা অনেক বেশি হয় এবং ব্যাপক বন্যা সংঘটিত হয়।

বাংলাদেশে আঘাতকারী ঘূর্ণিঝড়গুলির সঙ্গে আসা ঝড়ো-জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের ১২ ও ১৩ নভেম্বর মেঘনা মোহনায় আঘাতকারী স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসটি ভরা কটালের সময়ে হয়েছিল এবং জলরাশি ৩.০৫ থেকে ১০.৬ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে উঠে যায়। সেসময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিমি এবং প্রায় তিন লক্ষ মানুষ এ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয়। শতাব্দীর আরেক ভয়াবহতর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসটি সংঘটিত হয় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল তারিখে যা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা ও খুলনা এলাকায় আঘাত হানে এবং কেড়ে নেয় প্রায় ১৫,০০০ মানব প্রাণ, ৭০,০০০  গবাদি পশু, এবং সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা।  [এইচ.এস মোজাদ্দাদ ফারুক]

আরও দেখুন ঘূর্ণিঝড়; প্রাকৃতিক দুর্যোগ

মানচিত্রের জন্য দেখুন ঘূর্ণিঝড়