গণিত

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৩৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

গণিত (Mathematics)  পরিসর ও সংখ্যা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। গণিত শাস্ত্রের প্রধান বিভাগগুলির মধ্যে রয়েছে জ্যামিতি, অঙ্কশাস্ত্র, বীজগণিত, ক্যালকুলাস এবং ত্রিকোণমিতি। পরিসংখ্যান, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, গণনা, জ্যোতির্বিদ্যা, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ-গতিবিদ্যার গাণিতিক সূত্রসমূহ এবং পারমাণবিক বিদ্যা ফলিত গণিতশাস্ত্রের আওতাভুক্ত বিষয়।

প্রাগৈতিহাসিক মানব সম্ভবত তাদের হাতের আঙ্গুল থেকে কমপক্ষে দশ পর্যন্ত গুণতে শিখেছিল। চীনা, হিন্দু, ব্যাবিলনীয় ও মিশরীয়গণ সকলেই তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহারিক গুরুত্ব ছিল এমন গণনা ও পরিমাপ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিল। প্রথম তাত্ত্বিক গণিতবিদ ছিলেন মেলিটাস এর ‘থেলেস’ (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ অব্দ)। ধারণা করা হয় তিনিই সমতলের উপর অঙ্কিত চিত্রের জ্যামিতির প্রাথমিক সূত্রসমূহের প্রস্তাবনা রেখেছিলেন। তাঁর শিষ্য পিথাগোরাস গ্রীকগণের মধ্যে জ্যামিতিকে একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তীতে আলেকজান্ডারীও যুগের জ্যামিতি শাস্ত্রবিদদের মধ্যে ছিলেন (খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ ও ৩য় শতক) ইউক্লিড এবং আর্কিমিডিস। বর্তমান দশ ভিত্তিক সংখ্যাসমূহের উৎপত্তি ও ব্যবহার হিন্দু-আরব অঞ্চল থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যের খাওয়ারিজমি-এর মতো আরব গণিতশাস্ত্রবিদদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল। ভারতের (বঙ্গ অন্তর্ভুক্ত) গণিতশাস্ত্রের মূল উন্নয়নের ঘটনাটি ঘটেছিল ৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাজার বছর সময় জুড়ে, যা ইতিহাসে বৌদ্ধ ও জৈনযুগ হিসেবে চিহ্নিত।

বৌদ্ধ ও জৈন যুগীয় গণিত (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-৫০০ খ্রিস্টাব্দ)  বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে গণিতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ই গণিত গবেষণার ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। জৈনরা গণিত চর্চাকে ধর্মচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করত। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গণিত বিষয়ক কোনো গবেষণাকর্মের তেমন কোনো নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও তাঁদের ধর্মীয় সাহিত্যে গণিত বিষয়ক অনেকগুলি ধারণা ও উপাদান ব্যাপকভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে। অনুরূপভাবে, গাণিতিক উপাদান বিষয়ে যে কোনো ঐতিহাসিক আলোচনায় সূর্য্যপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), চন্দ্রপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), জম্বুদ্বীপপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), স্থানাঙ্গ-সূত্র (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), সমভয়াঙ্গ-সূত্র (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ভগবতী-সূত্র (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), অনুযোগদ্বার-সূত্র (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ললিতবিস্তার (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), কাক্কয়ানাসের পালি ব্যাকরণ (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), তত্ত্বার্থধিগম-সূত্র ও ঊমাস্বতী কর্তৃক-এর ভাষ্য (১০০ খ্রিস্টাব্দ), পুষ্পদানাত ও ভূতাবলির সাতখন্ডগম (২০০ খ্রিস্টাব্দ), ভাতিভ্রসবের ত্রিলোকপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টাব্দ) ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গেই চলে আসে।

স্থানাঙ্গ-সূত্র অনুযায়ী গণিতের বিষয় হলো দশটি: পরিকর্ম (চারটি মৌলিক ক্রিয়াপদ্ধতি), ব্যবহার (প্রয়োগের বিষয়), রজ্জু (জ্যামিতি), রশি (কঠিন পদার্থ পরিমাপন প্রক্রিয়া), কলাসবর্ণ (ভগ্নাংশসমূহ), যাবৎ-তাবৎ (সরল সমীকরণ), বর্গ (দ্বিঘাত সমীকরণ), ঘন (ত্রিঘাত সমীকরণ), বর্গ-বর্গ (চতুর্ঘাত সমীকরণ), এবং বিকল্প (বিন্যাস ও সমাবেশ)। অবশ্য অভয়াদেব সুরী (১০৫০ খ্রিস্টাব্দ) প্রদত্ত কতিপয় পরিভাষা বা তাঁর ব্যাখ্যার সঙ্গে কোনো কোনো গণিত বিষয়ক ঐতিহাসিক দ্বিমত পোষণ করে থাকেন।

বৌদ্ধদের ললিতবিস্তার (১০০ খ্রিস্টপূর্ব) শততমিক মানের ওপর ভিত্তি করে কোটি, অযুত, নিযুত থেকে তাল্লক্ষ্মণ = ১০৫৩ ইত্যাদি সংখ্যাক্রম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কাক্কয়ানদের পালি ব্যাকরণেও একটি সংখ্যাক্রম পরিবেশিত হয় যেটির শেষ সংখ্যা হলো অসংখ্যেয় = ১০১৪০। জৈনরা আরও এক ধাপ এগিয়ে শীর্ষপ্রহেলিকা = (৮৪০০০০০০)২৮ পর্যন্ত সংখ্যা গণনা ও নামকরণ করে এবং একই সময়কালে এর দ্বিতীয়টি ছিল কালক্রম বিষয়ক - পূর্ব = ৭৬ × ১০১১ বছর। উল্লিখিত সংখ্যা-নাম ও অন্যান্য ইতিবাচক সাক্ষ্যসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খ্রিস্টীয় যুগ সূচনার পূর্ব থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানীয় মান ও শূন্যসহ দশমিক সংখ্যা গণনার পদ্ধতি জানা ছিল।

জৈনদের বড় সংখ্যাসমূহের নামকরণের প্রতি আগ্রহ অবিন্যস্ত নয়, গাণিতিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ অসীমের ধারণা থেকেই উদ্ভূত। জৈনরা সংখ্যাকে সংখ্যেয় (গণনযোগ্য), অসংখ্যেয় (অগণনযোগ্য) ও অনন্ত এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। মজার বিষয় হলো যে, জৈনরাও গ্রীকদের মতো এক (১)-কে সংখ্যা হিসেবে গণনা করেনি। যদিও আদি জৈনধর্মাবলম্বীরা স্বীকার করে যে, গণনযোগ্য সংখ্যাসমূহের মধ্যে উচ্চতম সংখ্যায় পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য, তবু তাঁরা আলেফ-শূন্য ধারণায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। স্থানাঙ্গ-সূত্র অনুযায়ী অসীমের পাঁচটি ধরন আছে: একতোনন্ত (একমুখগামী অসীম), দ্বিধানন্ত (দ্বিমুখগামী অসীম), দেশবিস্তারানন্ত (এলাকাবিস্তারী অসীম), সর্ববিস্তারানন্ত (পুরোস্থানবিস্তারী অসীম) ও শাশ্বতানন্ত (চির অসীম)।

অনুযোগদ্বার-সূত্র (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও সাতখন্ডগম (২০০ খ্রিস্টাব্দ)-এ সংখ্যাসূচক বিধি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আদি জৈন ধর্মাবলম্বীদের প্রিয় বিষয় ছিল ভঙ্গ বা বিকল্প (বিন্যাস ও সমাবেশ)। তাঁদের বিভিন্ন চিন্তা যেমন, দর্শন ও ধর্মচিন্তা থেকে গণিতের এ শাখার উদ্ভব ঘটে। বীরসেনা (৮১৬ খ্রিস্টাব্দ) সাতখন্ডগমের ওপর মন্তব্য করার সময় অর্ধচ্ছেদ, ত্রকাচ্ছেদ ও চতুর্থচ্ছেদ ইত্যাদির ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন যেসবের মধ্যে লগারিদম বিষয়ক ধারণার ইঙ্গিত ছিল। আধুনিক সংখ্যা পদ্ধতিতে,

X-এর অর্ধচ্ছেদ = logX, যেখানে লগারিদমের ভিত্তি হলো ২;  X-এর ত্রকাচ্ছেদ = log3X, যেখানে লগারিদমের ভিত্তি হলো ৩; X-এর চতুর্থচ্ছেদ = log4X, যেখানে লগারিদমের ভিত্তি হলো ৪।

নিচের সমীকরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, জৈনরা লগারিদমের কতিপয় সূত্রের সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিল; যেমন:

Log (m/n) = 10gm -10gn;

Log (m/n) =  10gm - 10gn;

Log (Xx)x = Xx 10gx

পরিমাপন পদ্ধতি বিষয়ে জৈনদের যে উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল তা বৃত্ত পরিমাপের ক্ষেত্রে এসে পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়। বৃত্তের ক্ষেত্রফল, পরিধি ও ব্যাসার্ধ নির্ণয় এবং অর্ধ-বৃত্তের চেয়ে ছোট বৃত্তাংশের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র ঊমাস্বতীর (১০০ খ্রিস্টাব্দ) তত্তার্থধিগম-সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

উপরিউল্লিখিত তথ্যানুসারে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতবর্ষে গণিতচর্চা ও গবেষণায় জৈনরা যে সাফল্য অর্জন করেছিল তা পরবর্তীকালে এ উপমহাদেশে গণিতশাস্ত্রের বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এবং গণিতের কতগুলি ক্ষেত্রে তাঁরা অন্যান্য সংষ্কৃতির মানুষের চেয়ে যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। [নন্দলাল মাইতি]

বঙ্গীয় গণিত ধারণা  খ্রিস্টপূর্ব দুই শতক থেকে উদ্ভাবিত গণিত বিষয়ক ধ্যানধারণা ভারতের বিশাল সাহিত্যভান্ডারে বিধৃত রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগের বেদ (১৫০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ (৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), শুলব-সূত্র (৮০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), সূর্য্যপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), চন্দ্রপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), জম্বুদ্বীপপ্রজ্ঞাপ্তি (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), তত্ত্বার্থধিগমভাষ্য (১০০ খ্রিস্টাব্দ), অনুযোগদ্বারসূত্র (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ভগবতীসূত্র (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং আরও অনেক গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গাণিতিক ধ্যানধারণা গ্রন্থিত রয়েছে। এটি প্রায় নিশ্চিত যে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বা এর কাছাকাছি সময়ে ভারতে স্থানিক মানসহ সংখ্যা গণনার দশমিক পদ্ধতি ও শূন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল, যদিও ৪২৮ খ্রিস্টাব্দে মানকুবার শিলালিপিতে প্রথম শূন্য প্রতীক (০) দেখা গিয়েছে। গণিতের উদ্ভব ও বিকাশে সার্বিকভাবে ভারতের অবদান বিশাল যা বাকশালী পান্ডুলিপি (৩০০ খ্রিস্টাব্দ), আর্য্যভট্টীয় (৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ), ব্রহ্মষ্ফুটসিদ্ধান্ত (৬২৮ খ্রিস্টাব্দ), পাটিগণিত ও ত্রিসাতিকা (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ), গণিত সারসংগ্রহ (৮৫০ খ্রিস্টাব্দ), লীলাবতী ও বীজগণিত (১১৫০ খ্রিস্টাব্দ), তন্ত্রসংগ্রহ (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ), করণপদ্ধতি (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং এ ধরনের বহু গ্রন্থে বিধৃত রয়েছে। পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস ইত্যাদির বিকাশে আর্য্যভট্ট (জন্ম: ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ), ব্রহ্মগুপ্ত (জন্ম: ৫৯৮ খ্রিস্টাব্দ), শ্রীধর (সমৃদ্ধি ৭৫০ এর দশকের দিকে), মহাবীর (সমৃদ্ধি ৮৫০ এর দশকের দিকে), দ্বিতীয় ভাষ্কর (১১৫০ খ্রিস্টাব্দ) প্রমুখ অঙ্কশাস্ত্রবিদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাঁদের প্রথম ও দ্বিতীয় ডিগ্রির অনির্ণেয় সমীকরণ (indeterminate equation), অন্তঃপ্রক্ষেপণ তত্ত্ব (theory of interpolation), চক্রীয় চতুষ্কোণীয় উপপাদ্য (theorem of cyclic quadrilateral) ইত্যাদিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকি ক্যালকুলাসের ধারণা এবং টেলর সিরিজ ও গ্রেগরী-লিবনিজ সিরিজ ইত্যাদির পূর্বাভাসকে গণিত জগতের বিস্ময়কর উদ্ভাবন হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রাচীনকালের আর্য্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, দ্বিতীয় ভাষ্কর থেকে শুরু করে মাধব (১৩৪০-১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ), নীলকান্ত (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) ও পুতুমানা পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ধ্রুপদী অঙ্কশাস্ত্রের বিকাশে বাস্তবিকই বাংলার অবদান প্রায় নেই বললেই চলে, বা থাকলেও তা খুবই সামান্য। তবে বাংলার ইতিহাস থেকে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব সময়কালে প্রাচীন বাংলায় কয়েক ধরনের গণিত ছিল। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩০০ থেকে বারো শতকের সেন রাজবংশের শেষ শাসক লক্ষ্মণসেন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন রাজা ও সামন্ত শাসক দ্বারা বাংলা শাসিত হয়েছিল। রাজা ও সামন্ত শাসক নিজেরা এবং তাঁদের সন্তানসন্ততি, ব্রাহ্মণকূল ও সুবর্ণিকদের গণিতের শিক্ষা ছিল না এ সিদ্ধান্ত টানা বস্ত্তত ভুল। বরং সমতট, রাঢ়, বরেন্দ্র ও পুন্ড্রবর্ধনে পঞ্চাশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও প্রাচীন বৌদ্ধ মঠসমূহে ধর্মীয় শিক্ষাসহ রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যায় পাঠদান করা হতো। শীলভদ্র ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের অঙ্কশাস্ত্র বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান বা কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না এ কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। কথিত আছে যে, হরিসেন বর্মনের শক্তিধর প্রধানমন্ত্রী ভবদেব ভট্ট জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন, কিন্তু গ্রন্থটির হদিস পাওয়া যায় নি। প্রাচীনকালে বাঙালিরা যে গণিতচর্চা করেছিল তার চিহ্নসমূহ কেবল দৈর্ঘ্য, ওজন ইত্যাদি কতিপয় পরিমাপের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বাংলাদেশের  বগুড়া জেলার  মহাস্থানগড় (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার বেড়াচাঁপার খনন থেকে আবিষ্কৃত বহু পুরাতাত্ত্বিক নমুনা এবং বিপুল সংখ্যক তাম্রলিপি ও মুদ্রা উপরিউক্ত বক্তব্যকে নিঃসংশয়ে স্বীকৃতি দান করে।

মহাস্থানগড়ে গন্ডক ও কাকনিকা পাওয়া গেছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে বস্ত্তত কাকনিকা হলো একটি তাম্র মুদ্রা। গন্ডক বা গন্ডা ও পণ মূলত অস্ট্রিক শব্দ; সাঁওতালি ভাষায় এ দুটির অর্থ যথাক্রমে চার (৪) ও আশি (৮০)। বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন প্রবর্তিত তাম্র মুদ্রায় উন্মন, আধাকা, দ্রোণ, কাকা, গন্ডা ইত্যাদি ব্যবহূত হতো। চর্যাপদেও (১০০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) কওদি (= কাদা) ও বোদি (= বুদি) এর উল্লেখ রয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৪০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যেও কওদি, পণ ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। বাঙালিরা গণশিক্ষাদানের জন্য প্রায়োগিক গণিতের যে চর্চা করেছিল তা শুভঙ্কর (১৬০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) ও অন্যান্যদের ছড়াছন্দে প্রণীত আর্যাসমূহ (গণিতের বিধি) নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, শুভঙ্কর, অনুপ ভট্ট, রত্নেশ্বর ভট্ট, শংকর ভট্ট, ক্ষমানন্দ, ধূলিদন্তি, দ্বিজ রামদুলাল, নরসিংহ, দয়ারাম এবং আরও অনেকের কতিপয় ছড়ার নিচে প্রদত্ত নাম ছাড়া এঁদের প্রণীত কোনো পান্ডুলিপি বা গ্রন্থ সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় নি। এ ছড়াগুলি কেবল বাংলায় নয়, আসামেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আসামে এ ছড়াকে বলা হয় কায়াথালি আর্যা। আসামের গুটিকয় ছড়াকারের মধ্যে রয়েছেন গুরুদাস, রঘুপতি, জহুনন্দন চন্দ, বকুল কায়স্থ, হূদয় কায়স্থ, শুভঙ্কর ও অন্যান্য। প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও অবহট্ট শব্দে প্রাচীন বাংলায় আর্যাসমূহ লিখিত হয়েছে; মুখে মুখে সঞ্চারিত হয়ে ফেরার দরুন ছড়াগুলি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তিতরূপে পাওয়া গেছে। এভাবে, বাংলায় অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত আর্যার সাহায্যে পাঠশালায় প্রাথমিক গণিত শিক্ষাদান করা হতো।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি, রবার্ট মে প্রণীত অঙ্কপুস্তকম (১৮১৭) প্রকাশ করে। এর পর পরই জন হারলির গণিতঙ্ক (১৮১৯) এবং আরও পরে হলধর সেনের অঙ্ক-পুস্তক (১৮৩৯) প্রকাশিত হয়। মে ও হারলি তাঁদের পাঠ্যপুস্তকে বহু আর্যার সমাবেশ ঘটান। প্রসন্ন কুমার সর্বাধিকারী পাটিগণিত (১৮৫৫) ও দু খন্ডে বীজগণিত (১৮৫৯ ও ১৮৬০) প্রকাশের মাধ্যমে প্রচলিত অঙ্কশাস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন। উনিশ শতক শেষ হওয়ার আগে পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতি বিষয়ক বহু পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়। পঞ্চানন ঘোষ প্রকাশিত শুভঙ্করী (১৮৯৩) এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, ১৯৩৪ সালে বইটির ৮০তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। স্যার গুরুদাস ব্যানার্জীর পাটিগণিত ও বীজগণিত এবং জ্যামিতি যথাক্রমে ১৯১৩ এবং ১৯১৪ সালে সরল পাটিগণিত শিরোনামে প্রকাশিত হয়। উনিশ শতকের শেষে (১৮৮০-১৮৯০) স্যার আশুতোষ মুখার্জি আধুনিক গণিতশাস্ত্রে মূল্যবান অবদান রাখেন।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৯৪৭) বাংলার অঙ্কশাস্ত্রবিদেরা জ্যামিতি, সংখ্যাতত্ত্ব, ফাংশন তত্ত্ব ও অসীম সিরিজ, ডিফারেনসিয়াল সমীকরণ, বীজগণিত, পরিসংখ্যানসহ অঙ্কশাস্ত্রের আরও অনেক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যবান অবদান রাখেন। এ প্রসঙ্গে শ্যামাদাস মুখার্জী, আর.সি বোস, এইচ.এন দত্ত, এন.বি মিত্র, এন.এন ঘোষ, এস.কে ভড়, এ.বি দত্ত, এস.সি ধর, এন.আর সেন, পি.সি মহালনবিশ, এস.এন বোস এবং কাজী মোতাহার হোসেনের নাম স্মরণযোগ্য।  [নন্দলাল মাইতি]

বাংলাদেশে গণিতশাস্ত্র  স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গণিত শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছে। বাংলাদেশী গণিতবিদগণ ১৯৭২ সালে সকল স্তরে গণিত গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতি গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সাল থেকে এ সমিতি বারটি জাতীয় গণিত সম্মেলন (যেখানে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণও ছিল), কয়েকটি আঞ্চলিক সভা এবং স্বল্প সংখ্যক গবেষণা কর্মশালার আয়োজন করেছে। এ ছাড়া এটি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে মহাবিদ্যালয় পর্যায়ের উপযোগী শিক্ষামূলক বাংলাভাষার গণিত বিষয়ক পত্রিকা ‘গণিত পরিক্রমা’ এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রিকা, যার নাম ‘গণিত: জর্নাল অব দি বাংলাদেশ ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’।

সাম্প্রতিক সময়ে গণিত বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রমে প্রকৃত অর্থেই সংশোধন ঘটেছে এবং নতুন পাঠ্যপুস্তক লিখিত হয়েছে। নতুন পাঠক্রমে গণিতকে একটি সমকালীন ও প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে; শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশনকে উৎসাহিত ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন পাঠক্রমের কিছু চিত্র: দশমিক (মেট্রিক) একক সমূহের সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহার, প্রাচীন অনুশীলনী পদ্ধতির বিলোপ ঘটিয়ে শিশুদের খেলাচ্ছলে অঙ্ক শিক্ষার প্রবর্তন, শিক্ষা শুরু হওয়ার প্রথম আট বছরের মধ্যে পাটিগণিত শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখা, প্রাথমিক পর্যায়ে জ্যামিতি এবং বীজগণিতের ধারণার সূত্রপাত ঘটানো। সর্বোপরি, চার দশক আগে গণিত শিক্ষায় প্রাথমিক ক্যালকুলাসের প্রবর্তনের পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রমে সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যময় পরিবর্তন ঘটে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নৈর্বাচনিক গণিত কোর্সের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে ‘গণিত ব্যবহারিক’-এর প্রবর্তন একটি নতুন ধারার সূত্রপাত।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণিত পাঠক্রম মূলত সময়ের সাথে সাথে পর্যালোচনা এবং সংশোধন করা হয়ে থাকে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠক্রমে প্রায়ই গণিতের নতুন নতুন তত্ত্ব বিশেষ কোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে, যেমন: Fuzzy Mathematics, Lattice theory, Geometry of Numbers প্রভৃতি। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বর্তমানে চার বছরের সমন্বিত সম্মান কোর্স চালু করা হয়েছে। এ কোর্সের বর্তমান পাঠক্রম উন্নত দেশসমূহের সমতুল্য।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলিতে গণিতের সম্মান কোর্স প্রবর্তনের ফলে গণিত অধ্যয়নকারী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রবণতাটি দেশের প্রখ্যাত গণিতবিদদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় (প্রধানত স্নাতক পর্যায়ে) পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক (প্রধানত ইংরেজি ভাষায়, কিছু বাংলা ও ইংরেজির সংমিশ্রণে) রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। বাংলা একাডেমীর পাঠ্যপুস্তক বিভাগ গণিতের বিভিন্ন শাখার ওপরে কিছুসংখ্যক মানসম্পন্ন বাংলা বই প্রকাশ করেছে।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে গণিত বিষয়ে খুব বেশি গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয় নি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও না। সত্তর দশকের মধ্যভাগে গণিতে নির্ধারিত কোর্স এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ উভয় ক্ষেত্রেই গবেষণা ডিগ্রি এম.ফিল প্রদান প্রবর্তিত হয়। এখন পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি গণিতে পিএইচ.ডি ডিগ্রিধারী রয়েছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে গাণিতিক বিজ্ঞানসমূহের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৬ সালে সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস (আর.সি.এম.পি.এস) প্রতিষ্ঠা। কেন্দ্রটি নিয়মিতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলন, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। গাণিতিক বিজ্ঞানসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিষয়সমূহের ব্যাপক পরিসরভিত্তিক এ কর্মকান্ড গণিতের ভিত্তি থেকে রাসায়নিক পদার্থবিদ্যা বা প্রাণ-পরিসংখ্যান বা গাণিতিক অর্থনীতি পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠায় প্রয়াত বিজ্ঞানী নোবেল বিজয়ী আব্দুস সালামের বিরাট একটি ভূমিকা ছিল। এ কেন্দ্রের প্রধান কাজ হল এম.ফিল ও পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনে গবেষণা সুবিধা প্রদান করা।

বাংলাদেশী গণিতবিদগণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা প্রণালীর কম্পিউটারায়ন ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার প্রচলন প্রভৃতি জাতীয় বিষয়াবলীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।  [মুনিবুর রহমান চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  PN Gosh, Xubhamkari, Ptrick Press, Calcutta, 1934; BB Datta and AN Singh, History of Hindu Mathematics, Pts- I & II, Lahore, 1935; AN Singh, ‘History of Mathematics from Jaina Sources’, Jaina Antiquary, 15 and 16, 1949 and 1950; AK Bag, Mathematics in Ancient and Medieval India, Chaukhaba, India 1979; NL Maiti, Prachin Bharatiya Ganiter Itibrtta Firma, KLM Pvt Ltd, Calcutta, 1983; নন্দলাল মাইতি, ‘ লোকগণিত: গণিতের বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে এক ফল্গুধারা’, ভারতের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ১৯৯৭; শহীদুল্লাহ মৃধা, ‘শুভঙ্করী আর্যা’, বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান পত্রিকা, ঢাকা, ১৪০২ বাংলা।