সরকার, ক্ষিতিশচন্দ্র
সরকার, ক্ষিতিশচন্দ্র (১৮৯৫-১৯৮১) একজন সমাজকর্মী হিসেবে তিনি রাজশাহীর শিক্ষা, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতিতে ব্যাপক অবদান রাখেন। তিনি তাঁর স্ব-জাতির আদিবৃত্তান্ত, তাদের শিক্ষা উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি রক্ষায় যে কাজ করে গেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর অদম্য দেশপ্রেম তাকে একজন নিষ্ঠাবান সংগঠক, যোগ্য পন্ডিত এবং গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে রাজশাহী শহর বিকশিত হতে শুরু করে। স্থানীয় জমিদার, আইনজীবী এবং শিক্ষকবৃন্দ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক এবং সমাজ কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেমন, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭২), রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরি (১৮৮৪) এবং বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি (১৯১৯)। ক্ষিতিশচন্দ্র সরকার বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
ক্ষিতিশচন্দ্র সরকার অল্প বয়সে তাঁর পিতাকে হারান। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং বি.এল ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি স্টেলা ক্রামারিশ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, ননী গোপাল মজুমদার এবং অন্যান্যদের সংস্পর্শে আসেন। তাদের থেকে উৎসাহ পেয়ে তিনি ভারত সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি রমাপ্রসাদ চন্দের অনুরোধে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটিতে যোগ দেন এবং ১৯২১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এখানে কাজ করেন। ১৯৪৬-১৯৬৩ সময়ে তিনি সোসাইটির অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ননী গোপাল মজুমদারের অনুপস্থিতিতে কিছু সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত কিউরেটরও ছিলেন।
ক্ষিতিশচন্দ্র সরকার বিহারের রাঁচি এবং পশ্চিমবঙ্গের মানভূম পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও তথ্যের মাধ্যমে তিনি এ স্থানগুলিতে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবন ধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রবন্ধটি ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে তিনি সিংহলের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা পরিদর্শন করেন এবং তা একটি প্রবন্ধে বর্ণনা করেন। প্রবন্ধটি অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সে উপস্থাপিত হয়। একই বছরে করাচিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তিনি ‘Some Aboriginal Rites and Customs’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৩৩ সালে মহারাষ্ট্রের বরোদাতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সে তিনি ‘Holwell Monument Recalled’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। তিনি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রমাপ্রসাদ চন্দের অনুরোধে ‘Sculpture of Varendra’ শিরোনামে আরেকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। যদিও তা প্রকাশিত হয়নি। তারপর তিনি ‘A Brief History of Varendra and other Essays’ নামে ১৯টি প্রবন্ধের একটি সংকলন সম্পাদনা করেন। গ্রন্থটির সম্পাদক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সম্পাদিত খ্যাতনামা গ্রন্থসমূহ হলো অক্ষয় কুমার মৈত্র রচিত ‘The Ancient Monument of Varendra’ এবং ভূবন মোহন সংখ্যাতীর্থের ‘Hya Shirsha Pancha Ratnam’.
ক্ষিতিশচন্দ্র সরকারের প্রতিবাদের কারণে ১৯৪৯ সালে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ভবনটিকে একটি মেডিক্যাল স্কুলে রূপান্তরিত করতে পারেনি। ১৯৬২ সালে জাদুঘরের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহকে করাচির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে স্থানান্তরের অপর একটি প্রচেষ্টাও তাঁর প্রতিবাদের কারণে ব্যর্থ হয়। সুতরাং বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির যে সকল দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়েছিল তা তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তিনি জাদুঘরের জন্য বেশ কিছু পুরাকীর্তি সংগ্রহ করেন। এগুলির মধ্যে হংক্রাইল বিষ্ণু (Hankrail Vishnu) উল্লেখযোগ্য। ক্ষিতিশ চন্দ্র সরকার রাজশাহী পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পরই তিনি কলকাতার অশোক নগরে চলে যান এবং ১৯৮১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [সাইফুদ্দীন চৌধুরী]