জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাত ও অখ্যাত প্রান্তগুলোতে অসংখ্য জাতি (Nation), জনগোষ্ঠী (Ethnic group), আদিবাসী (Aborigine), ও মৌলগোষ্ঠী (Tribe) বাসবাস করছে। এদের প্রত্যেকেরই বিশেষ দৈহিক গড়ন ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাস, ধর্ম, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও জীবন যাত্রার ধরন রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একের সাথে অপরের কিছু কিছু সাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয় বটে। এই সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলোর তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী, আদিবাসী ও মৌলগোষ্ঠীগুলোর উদ্ভব, বিকাশ এবং পারস্পরিক জাতিতত্ত্বের বিষয়ে একটি রূপরেখা নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তাছাড়া বিচিত্র মানুষের বৈচিত্রময় জীবন ব্যবস্থা সহজেই সকলকে আকৃষ্ট করে। আর এসব বিষয় নিয়ে যে আলোচনা তা-ই জাতিতত্ত্ব(Ethnology)।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর বাংলাদেশের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত জাদুঘরটির বিষয়বস্ত্ত জাতিতত্ত্ব। একতলা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখি এই জাদুঘরে একটি কেন্দ্রীয় হলঘরসহ মোট চারটি গ্যালারী। প্রতিটি গ্যালারীতে তিনটি করে কক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও এ যাবত পশ্চিম বাহুর গ্যালারী দুটির প্রত্যেকটিতে দুটি করে কক্ষ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। ফলে বর্তমানে জাদুঘরে প্রদর্শনী কক্ষের সংখ্যা ১১টি।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষত পার্বত্য জেলাগুলিতে বৈচিত্র্য আরো বেশি। আর এ জন্য এসব এলাকায় সুদুর অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন আদিবাসী নিভৃত জীবন যাপন করে আসছে। এরূপ প্রায় ৪৫টি আদিবাসী নিজ নিজ ঐতিহ্যগত জীবনধারা অব্যাহত রেখেছে। দেশের মূল অধিবাসীদের জীবন ধারার সাথে এর যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবনধারার ঐতিহ্যই বিস্মৃত হওয়ার পথে। মূল অধিবাসীও তাদের সম্পর্কে তেমন অবগত নয়। অথচ এরাও দেশের জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাই আদিবাসী ও মূলজনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক পরিচিতি সম্প্রীতি সুনিবিড় করণের জন্যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং দর্শকদের পরিদর্শনের জন্যে ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় একতলা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখি জাদুঘর ভবন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন ধারায় প্রতিফলিত প্রত্ন সংস্কৃতির পরিচয়কে মানচিত্র, আলোকচিত্র, মডেল, কৃত্রিম পরিবেশ, দেওয়ালচিত্র, সংক্ষিপ্ত আলোকচিত্র, মডেল, কৃত্রিম পরিবেশ, সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ফলক ইত্যাদির মাধ্যমে এর প্রদর্শনীর বিষয়বস্ত্তকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জাদুঘরে একটি ছোট লাইব্রেরীও আছে। জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর শুধু দেশি-বিদেশি পেশাদার দর্শকদের জ্ঞানানু সন্ধানের আকাঙ্ক্ষাই নিবৃত করে না, বরং সকল শ্রেণীর দর্শক পর্যটকদের বিপুল আনন্দেরও খোরাক যোগায়।
এই জাদঘুরে প্রায় ২৫টি আদিবাসীসহ বিদেশি ৫টি দেশের জাতিতাত্ত্বিক সামগ্রীর তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্যে প্রদর্শিত রয়েছে। যে কোন দর্শক বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান কিরগিজস্থান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানীর জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবেন। প্রদর্শিত আদিবাসীদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, স্নো, বম, খিয়াং, খুমি, চাক, রাখাইন, পাবেখো- সিলেট অঞ্চলের খাসিয়া, মনিপুরী, পাঙন, (মুসলিম মনিপুরি) পাত্র, ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো, হাজং, দালু, মান্দাই, কোচ, রাজশাহী দিনাজপুর অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, পলিয়া, কোচ, যশোহর, ঝিনাইদহ অঞ্চলের বুনো, বা বোনা, বাগদি প্রভৃতিসহ পাকিস্তানের পাঠান, সিন্ধি, পাঞ্জাবী, কাফির, সোয়াত, ভারতের আদি, ফুওয়া, মুরিয়া, মিজো, কিরগিজস্থানের (প্রাক্তন রাশিয়া) কিরগিজ, অস্ট্রেলিয়ার অষ্ট্রাল এবং দুই জার্মানীর মিলন প্রাচীরের ভগ্নাংশের কিছু নির্দশন জাদুঘরে প্রদর্শিত আছে।
জাদুঘরের কেন্দ্রীয় কক্ষের প্রবেশ পথে রয়েছে টিকিট কাউন্টার, তিনটি মানচিত্র ও ইটালীর চিত্রশিল্পী মি. ক্যারোলীর ১২টি দেওয়াল চিত্র। দেওয়াল চিত্রে অর্ধেক বাংলাদেশের আদিবাসী ও পাকিস্তানী আদিবাসীদের বিভিন্ন জীবন যাত্রার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া ত্রিপুরা ও পাঞ্জাবী নারীর দু’টি মডেল, ম্রোদের জীবনযাত্রার ধরণসহ ধর্মীয় গো হত্যার উৎসবের ডায়রোমা, বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসীসহ পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর অলংকার, বাংলাদেশের পার্বত্যজেলায় বসবাসরত আদিবাসীদের বাসগৃহের নমুনা এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রকাশিত বিভিন্ন বই ও ভিউকার্ডের শোকেইজ।
গ্যালারী নং-১, কক্ষ-১-এ বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের আলোকচিত্র, কৃষিকাজসহ মাছধরা ও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-এর মিলনের প্রতিকৃতি, দেশের জাতীয় ফলসহ কৃষিলভ্য পণ্য, পশু পাখির মডেল (ড্যামি’র) মাধ্যমে প্রদর্শিত আছে। এ কক্ষে পাকিস্তানের পাঠান জনগোষ্ঠীর গ্রাম্য জীবনসহ শালিসী ব্যবস্থা ডিওরোমার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। কক্ষ-২-এ সিন্ধিরের ঘরোয়া পরিবেশসহ কাফির, পাঞ্জাবী, পাঠান প্রভৃতিদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত সামগ্রী, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিকারের দ্রব্যাদি, হস্তশিল্প, ভাঁজযুক্ত কাঠের জায়নামাজ, বড় আকৃতির আলা, তুলার বীজ ধনুকের মাধ্যমে পৃথক করণের উপকরণ, কাঠের সিন্ধুক, চেয়ার, চামড়ার ফালি দিয়ে বুননকৃত খাটিয়া প্রভৃতি প্রদর্শিত হয়েছে।
গ্যালারী নং-২, কক্ষ নং-১-এ খাসিয়া, মনিপুরী, পাঙন (মুসলিম মনিপুরী, দালু, কানাই, হদি জনগোষ্ঠীর আলোকচিত্র, ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পোশাক-পরিচ্ছদ, রাসনৃত্যের পোশাক ইত্যাদি, ২ নং কক্ষে পলিয়া (বাবুবলি) সাঁওতালদের রান্নার দৃশ্য ও গৃহস্থালী পরিবেশ, গারোদের জীবনচিত্র ও মডেল, ঘরোয়া পরিবেশ, শিকারের দ্রব্যাদি, মাছ ধরার বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্রশস্ত্র, মৃত বাড়ির পাশে পুতে রাখার ফলক সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
গ্যালারী নং-৩, কক্ষ নং-১-এ ম্রো আদিবাসীর বিভিন্ন আলোকচিত্রসহ তাহাদের দৈনন্দিন ব্যবহূত সামগ্রী, বাদযন্ত্র, কৃষিকাজে ব্যবহূত সামগ্রী, মাথার চুল ও চিরুনী।
কক্ষ নং-২ এ ঘুমি, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, আদিবাসীদের বিভিন্ন উপকরণ, তুলা থেকে বীজ পৃথক করার যন্ত্রসহ নানাবিধ সামগ্রী এবং কক্ষ -৩-এ বম, মডেলের প্রতিকৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাদ্যযন্ত্র, হাজংদের কৃষিকাজে ব্যবহূত উপকরণ, হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি প্রদর্শিত আছে।
গ্যালারী-৪, কক্ষ নং-১-এ রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় বসবাসরত চাকমাদের বিভিন্ন পরিবেশে আলোকচিত্র, চাকমা রমনীর মডেলসহ পোশাক-পরিচ্ছদ, চাকমাদের কাপড় বুননের চিত্রাঙ্কনের ডিজাইন কাপড় ‘আলাম’, পাশা খেলার ঘর, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, গৃহস্থালী পরিবেশের দৃশ্য, ২ নম্বর কক্ষে পার্বত্য জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মারমাদের মডেল, পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহস্থালীর পরিবেশ ও গৃহাভ্যন্তরে তৈরি স্থানীয়ভাবে জুয়ানী (মদ) তৈরির দৃশ্য প্রভৃতি, ৩ নং কক্ষে বিভিন্ন আদিবাসীদের জীবন যাত্রায় দৈনন্দিন ব্যবহূত সামগ্রী, পাখিসহ বিভিন্ন বন্যজন্তুর হাড়, কচ্ছপের খোলস, বড় আকৃতির সাপের চামড়া, বয়নসামগ্রী ও কক্সবাজার এবং পটুয়াখালীতে বসবাসরত রাখাইন আদিবাসীর জীবনযাত্রার আলোকচিত্র এবং আধুনিককালে নির্মিত পিতলের তৈরি বৌদ্ধমূর্তি প্রদর্শিত রয়েছে।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসরত এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব। বিশেষ করে সমতল ভূমিতে বসবাসকারী বাংলাদেশের। এই জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রত্যেক জীবনধারাতে স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য রয়েছে সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিলুপ্ত প্রায় জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের মাধ্যমে অাঁকড়ে রাখার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। [মুহাম্মদ আবদুল বাতেন]
গ্রন্থপঞ্জি মোঃ মোশারফ হোসেন, চট্টগাম জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ১৯৯৯।