গঙ্গারিডাই
গঙ্গারিডাই প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে গ্রিক ও ল্যাটিন লেখায় একটি জনগোষ্ঠী ও একটি দেশের নাম হিসেবে উল্লিখিত। ক্লাসিক্যাল লেখকদের বর্ণনায় ‘গঙ্গারিডাই’ এবং এর রূপভেদে ‘গঙ্গারিডেই’ (Gangaridae), ‘গঙ্গারিদুম’ (Gangariridum) ও ‘গঙ্গারাইডেস’ (Gangarides) শব্দগুলি পাওয়া যায়।
আলেকজান্ডার ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডিওডোরাস (৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১৬ খ্রিস্টাব্দ) সিন্ধু পরবর্তী দেশ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, গঙ্গা পেরিয়ে যে অঞ্চল সেখানে ‘প্রাসিয়ই’(Prasioi) ও গঙ্গারিডাই-দের আধিপত্য। কুইনটাস কারটিয়াস রূফাস গঙ্গা পেরিয়ে পরবর্তী তীর অঞ্চলটিতে দুটি জনগোষ্ঠীর বসবাসের কথা বলেছেন, ‘গঙ্গারিডাই’ ও ‘ফারিসি’ (Pharrisii)। স্ট্রাবো (৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-২১ খ্রিস্টাব্দ)-এর তথ্যানুযায়ী গঙ্গা ‘গঙ্গারিডেই’-এর উপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে, যা তার পূর্ব সীমানা গঠন করেছে। প্লিনি (খ্রিস্টীয় প্রথম শতক) লিখেছেন যে, গঙ্গার শেষ অংশ ‘গঙ্গারাইডেস’-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভার্জিল (৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অবস্থানের কোনো ইঙ্গিত না দিয়েই গঙ্গারিডাই-এর উল্লেখ করেছেন।
টলেমি (দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ) গঙ্গারিডাই-এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, গঙ্গার পাঁচটি মুখ সংলগ্ন প্রায় সমস্ত এলাকা গঙ্গারিডাইগণ দখল করে রেখেছিল, ‘গাঙ্গে’ (Gange) নগর ছিল এর রাজধানী। যদিও টলেমি গঙ্গার পাঁচটি মুখের অবস্থানের অক্ষ ও দ্রাঘিমা সহ নাম উল্লেখ করেছেন, তথাপি সেগুলি সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি মাপ নির্ভুল না হওয়ার কারণে। তবুও তার বর্ণনাকৃত চারটি দ্রাঘিমা ডিগ্রি সমুদ্র উপকূলের সর্বপশ্চিম থেকে সর্বপূর্বের নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করছে। কার্যত এর অর্থ হলো ‘গঙ্গারিডাই’ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী গঙ্গার সর্বপশ্চিম এবং সর্বপূর্বের নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো যে, ভাগীরথীর (তমলুক-এর নিকটে) এবং পদ্মার (চট্টগ্রামের নিকটে) নদীমুখের দ্রাঘিমা রেখার পার্থক্য ৩.৫ ডিগ্রির সামান্য কিছু বেশি। তাই টলেমির তথ্যানুযায়ী গঙ্গারিডাই-কে শনাক্ত করা যায় বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশে গঙ্গার প্রধান দুটি শাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে। তবে তথ্য অপ্রতুলতার কারণে ‘গাঙ্গে’ (Gange) নগরটির অবস্থান শনাক্ত করা যায় না।
একজন গ্রিক নাবিক তাঁর Periplous tes Erythras Thalasses (Periplus Maris Erythraei) গ্রন্থে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন গাঙ্গে দেশের কথা উল্লেখ করেছেন, যা ছিল Desarene (ঊড়িষ্যা উপকূল)-র পূর্ব পার্শ্বে গঙ্গা সংলগ্ন অথবা সমগ্র অঞ্চলটি ছিল নদীবেষ্টিত। নদী তীরে নদীর নামে ‘গাঙ্গে’ ছিল একটি বাণিজ্য শহর। একটি বিষয় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, টলেমির ‘গঙ্গারিডাই’ এবং ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থের লেখকের ‘গাঙ্গে দেশ’ বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত একই এলাকাকে ইঙ্গিত করছে। কালিদাসের রঘুবংশ-এ বঙ্গের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা অভিন্ন অর্থই ব্যক্ত করে। তাই প্রাচীন বাংলার বঙ্গ জনপদকে গ্রিক ও ল্যাটিন লেখকদের ‘গঙ্গারিডাই’-এর সমতুল্য গণ্য করা যেতে পারে।
গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিডেই এবং গঙ্গারিদুম শব্দরূপগুলির উৎপত্তি গঙ্গারিড (Gangarid) থেকে। ধারণা করা হয় যে, গঙ্গারিড হলো ভারতীয় ‘গঙ্গাহূদ’ শব্দের গ্রিক রূপ। এর অর্থ ‘যে ভূমির বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত’ (গঙ্গাহূদ> গঙ্গারিদ> গঙ্গারিডাই, গঙ্গারিড-এর বহুবচনার্থে), যা ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থের লেখকের বর্ণিত গাঙ্গে দেশের সাথে বেশ মানিয়ে যায়।
তবে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে অথবা অব্যবহিত পরে কয়েক শতকে গ্রিক ও ল্যাটিন ক্লাসিক্যাল লেখকদের বর্ণনার সাথে মিলে এমন কোনো সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাজ্যের সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব স্থানীয় কোনো উৎসের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। উল্লেখ করা হয়েছে যে, চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গঙ্গারিডাইর রাজা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তাঁর ৬ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ৭ শত হস্তি বাহিনী ছিল। প্রাপ্ত তথ্য এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় যে, পাশ্চাত্যের দূরবর্তী দেশগুলি পরবর্তী ৫০০ বছর তাদের নাম ও যশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। [আবদুল মমিন চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি Amitabha Bhattacharyya, Historical Geography of Ancient and Early Mediaeval Bengal, Calcutta, 1977; BN Mukherjee, The Territory of the Gangaridai, Indian Journal of Landscape Systems and Ecological Studies, X, 1987.