রামপ্রসাদ সেন
রামপ্রসাদ সেন (আনু. ১৭২০-১৭৮১) বাংলা ভক্তিগীতির, বিশেষত শ্যামাসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ রূপকার, সাধককবি, গায়ক। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কুমারহট্ট গ্রামের কবিরাজ বংশে তাঁর জন্ম। পিতা রামরাম সেন ছিলেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ ব্যবসায়ী। রামপ্রসাদ তাঁর গ্রন্থে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন তা থেকে অনুমিত হয় যে, তাঁর পিতাও কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
ছোটবেলায় পাঠশালার পাঠ শেষ করে পরবর্তীকালে পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার প্রয়োজনে তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেন। কিন্তু আয়ুর্বেদী ব্যবসার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না; তাঁর আগ্রহ ছিল সাহিত্য ও সঙ্গীতে। তাই পুত্রের আয়ুর্বেদশাস্ত্রে অনীহা এবং সাহিত্য-সঙ্গীতে অনুরাগ লক্ষ করে পিতা রামরাম সেন তাঁকে ফারসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবে রামপ্রসাদ ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। ফলে তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চার পথ প্রসারিত হয়।
পিতার মৃত্যুর পর সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা দেখা দিলে ১৭/১৮ বছর বয়সে জীবিকার উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা যান এবং সেখানে এক জমিদারের কাচারিতে মুহুরির চাকুরি গ্রহন করেন। মনে ভাবের উদয় হলে তিনি নির্জনে একা বসে গান গাইতেন; কখনও নতুন গান মনে এলে বিষয়-উদাসীন রামপ্রসাদ জমিদারির হিসাবের খাতায়ই তা লিখে রাখতেন। জমিদার রামপ্রসাদের এই ভক্তিভাব ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে এ কাজ থেকে মুক্তি দেন। তিনি রামপ্রসাদের জন্য মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করে তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেন এবং শক্তিসাধনা ও সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন।
রামপ্রসাদ নিজগ্রাম কুমারহট্টে ফিরে এসে সাধনা এবং সঙ্গীত রচনায় নিমগ্ন হন। নিজের গানে নিজেই সুর দিয়ে মাধুর্যভরা কণ্ঠে তিনি গেয়ে শোনাতেন। তখন নবদ্বীপের রাজা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনি রামপ্রসাদের কবিত্ব ও সঙ্গীতখ্যাতির কথা শুনে তাঁকে নিজের রাজসভায় যোগদানের আহবান জানান। ভারতচন্দ্র তখন কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। কিন্তু বিষয়বিমুখ রামপ্রসাদ রাজসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। তা সত্ত্বেও কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর ভরণ-পোষণের জন্য তাঁকে একশত বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন এবং ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কথিত হয় যে, কোনো একসময় মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীর পাড়ে রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে নৌকায় এনে আরও গান শোনেন।
সেকালের বৈষ্ণবদর্শন-কেন্দ্রিক রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাবিষয়ক কীর্তনের পাশাপাশি রামপ্রসাদ শাক্ত পদাবলি তথা শ্যামাসঙ্গীত রচনার মধ্য দিয়ে মাতৃরূপে শক্তিসাধনার এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি ভক্তিভাব এবং রাগ ও বাউল সুরের মিশ্রণে এক ভিন্ন সুরের সৃষ্টি করেন, যা বাংলা সঙ্গীতজগতে ‘রামপ্রসাদী সুর’ নামে পরিচিত। এই সুর পরবর্তীকালের প্রায় সকল সঙ্গীতকারকেই কম-বেশি প্রভাবিত করেছে; এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই সুরে অনেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন। রামপ্রসাদ নিজে এই সুরে কালী বা শ্যামার উদ্দেশে অনেক সঙ্গীত রচনা করেন, যা শ্যামাসঙ্গীত নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে তিনি বাংলা গানের জগতে অমর হয়ে আছেন। তাঁর গানের ভাষা সহজ, কিন্তু ভাব গভীর আবেগমন্ডিত। তিনি তাঁর গানে প্রচলিত প্রাচীন সুরের পাশাপাশি রাগসুরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।
বাস্তব জীবনের কর্মযোগের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনার এক অপূর্ব মিলনচিত্র রামপ্রসাদের সঙ্গীতের পদে পদে অঙ্কিত। সংসারের অভাব-অনটনের বাস্তবতার মধ্যে অন্তরে বৈরাগ্য নিয়েও রামপ্রসাদ গৃহত্যাগী হননি। তাই সংসারের বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টকে গৌরব মনে করে মায়ের উদ্দেশে তিনি গান বেঁধেছেন: ‘আমি কি দুঃখেরে ডরাই।’
রামপ্রসাদ প্রচুর গান রচনা করেছিলেন যার বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে। তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় গান হলো: ‘মন রে কৃষি কাজ জানো না’, ‘ডুব দেরে মন কালী বলে’, ‘মা আমায় ঘুরাবি কত’ ইত্যাদি। এ গানগুলির আবেদন চিরন্তন।
শ্যামাসঙ্গীতের মতো আগমনী গানের ধারাটিরও প্রবর্তক রামপ্রসাদ সেন। পূজার সময় পূজা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দেবী দুর্গার পুত্র-কন্যাসহ কৈলাস থেকে মর্ত্যে আগমনের কাহিনীকে কেন্দ্র করে এ গানগুলি রচিত। দুর্গা গৃহস্থ ঘরের কন্যার মতো স্বামীর ঘর থেকে পিতার ঘরে আগমন করেন। এ ব্যাপারে মা মেনকার যে উদ্বেগ তাও গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও রামপ্রসাদ কালীকীর্তন, কৃষ্ণকীর্তন, শিবকীর্তন নামে বিভিন্ন জনপ্রিয় পালা এবং বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেন।
রামপ্রসাদের মৃত্যুঘটনা অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন, যা একটি লোককথার জন্ম দিয়েছে। শোনা যায়, কালীপূজা শেষে মূর্তি বিসর্জনের সময় ‘তিলেক দাঁড়াওরে শমন’ গানটি গাইতে গাইতে তিনি মূর্তির সঙ্গে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
[খান মোঃ সাঈদ]
গ্রন্থপঞ্জি রামপ্রসাদ সেনের গ্রন্থাবলী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা; সুকুমার রায়, বাংলা সংগীতের রূপ, এ মুখার্জী কোং প্রা লি, কলকাতা, ১৯৬৯।