রুকনউদ্দীন কায়কাউস
রুকনউদ্দীন কায়কাউস (আনু. ৬৯১-৭০১ হি/১২৯১-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ) লখনৌতির সুলতান। তিনি ছিলেন বুগরা খানের পুত্র। বুগরা খান তাঁর সপক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করলে তিনি ক্ষমতালাভ করেন। মুঙ্গেরের মহেশ্বর ও লক্ষ্মীসরাই এবং দেবকোট, ত্রিবেণী ও মহাস্থান থেকে তাঁর লিপি পাওয়া গেছে। এছাড়া লখনৌতি টাকশাল থেকে প্রচারিত তাঁর অসংখ্য মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁর কোন কোন মুদ্রা ও লিপিতে তিনি নিজেকে ‘সুলতান-বিন-সুলতান’ (সুলতানের পুত্র সুলতান) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মুঙ্গেরে প্রাপ্ত তাঁর মহেশ্বর (১২৯২-৯৩ খ্রি) এবং লক্ষ্মীসরাই (১২৯৭ খ্রি) লিপি, দিনাজপুরে প্রাপ্ত দেবকোট লিপি (১২৯৭ খ্রি), হুগলিতে প্রাপ্ত ত্রিবেণী লিপি (১২৯৮ খ্রি) ও বগুড়ায় প্রাপ্ত মহাস্থান লিপি (১৩০০ খ্রি) এবং লখনৌতি টাকশাল থেকে প্রচারিত কিছু মুদ্রা থেকে অনুমান করা যায় যে, কায়কাউস তাঁর রাজ্য সম্প্রসারণে সক্ষম হয়েছিলেন। লিপিসমূহের প্রাপ্তিস্থল থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর রাজ্য পশ্চিমে বিহার, উত্তরে দেবকোট এবং দক্ষিণে সাতগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুদ্রা প্রমাণে অনুমান করা যায় যে, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার দিকে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিলেন এবং নবলব্ধ স্থানের রাজস্ব থেকে মুদ্রা জারি করেছিলেন। মুদ্রাপ্রমাণে এটুকু বলা যায় যে, পূর্ববঙ্গের অন্তত কিছু এলাকা তাঁর দখলে ছিল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস সাধিত এবং শেষ আববাসীয় খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহ নিহত হলেও কায়কাউসের মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ হয়েছিল। এ থেকে খিলাফতের প্রতি সুলতানের আনুগত্যের প্রমাণ মেলে।
মনে হয় সুলতান তাঁর রাজ্যকে বিহার ও লখনৌতি এই দুভাগে ভাগ করেছিলেন এবং অঞ্চল দুটি শাসনের জন্য দুজন দক্ষ সহকারী নিযুক্ত করেছিলেন। ইখতিয়ারউদ্দীন ফিরুজ ইতগীন বিহারের এবং শাহাবুদ্দীন জাফর খান বাহরাম ইতগীন লখনৌতির শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। লখনৌতি প্রদেশ দেবকোট থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুলতান তাঁর লিপিতে নিজেকে সুলতান-উস-সালাতীন (সুলতানদের সুলতান) বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি বিহার ও লখনৌতিতে তাঁর অধীন শাসনকর্তাদ্বয়ও নিজেদেরকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার রূপে অভিহিত করেছেন। সম্ভবত এ ধরনের উচ্চ উপাধি ধারণের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রকাশ করা যে, তাঁরা দিল্লির খলজীদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেন না। তাঁদের দৃষ্টিতে দিল্লির খলজীগণ শুধু জবরদখলকারী হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন। বলবনের বংশধরগণ লখনৌতিতে তাদের স্বাধীনতা এবং লখনৌতি রাজ্যের আঞ্চলিক অখন্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখতে ছিলেন সদা সতর্ক। স্মরণ করা যেতে পারে যে, আলাউদ্দীন খলজী উপমহাদেশের অন্যান্য প্রায় সকল এলাকা দখল করলেও লখনৌতির দিকে হাত বাড়ান নি।
লিপি ও মুদ্রা অনুসারে কায়কাউসের রাজত্বের শেষ বছর ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ। কিভাবে তাঁর শাসনের অবসান ঘটে তা জানা যায় না। সম্ভবত তিনি অপুত্রক অবস্থায় মারা যান, কিংবা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েও দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ত্রিশ বছর। এভাবে লখনৌতিতেও বলবনের বংশের অবসান ঘটে। [মুহম্মদ আনসার আলী]