ভূমি অবনয়ন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভূমি অবনয়ন (Land Degradation)  ক্ষালনের ফলে মৃত্তিকার বিনিময়যোগ্য ক্ষার হ্রাস এবং স্তর-সিলিকা এঁটেলের ক্ষয়। অন্যভাবে বলা যায়, অবক্ষয় (weathering) ও ক্ষয়ীভবনের (erosion) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া এবং সাধারণভাবে ভূমির উচ্চতা হ্রাস ও নিচু হয়ে যাওয়া। শুষ্ক (arid), শুষ্কপ্রায় (semi-arid) এবং শুষ্ক আর্দ্রপ্রায় (subhumid) এলাকাতে ভূমি অবনয়নের বিস্তৃতি হলো মরুকরণ, যা মরু এলাকার বহির্মুখী প্রসারণ ঘটায়। জলবায়ুগত পার্থক্য এবং মানুষ ও তাদের পশুর কর্মকান্ডের দ্বারা এ মরুকরণ ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে ভূমি অবনয়ন ও মরুকরণ বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে থমাস ম্যালথাসের ‘জনসংখ্যাতত্ত্ব’ (Principles of Population) সম্পর্কিত প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর সম্ভবত মানুষ ও ভূমির সামর্থ্য বিষয়ক আধুনিক আলোচনার সূত্রপাত হয়।

ভূমি অবনয়ন ভূমি অব্যবস্থাপনার ফলে ঘটে এবং ভূমির গুণাগুণ ও ভূমি ব্যবহারের মধ্যে পুনঃপুন সমন্বয়হীনতাই এর কারণ। এটি সুস্পষ্টভাবে মানব প্রবর্তিত সামাজিক প্রতিভাস এবং এর দ্বারা ব্যাপক এলাকা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগণ প্রভাবিত হয়। যদিও ভূমি অবনয়ন ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি, তবুও জলবায়ুগত পরিবর্তনের পিছনে একটি চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমি অবনয়নের ভূমিকা ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মরুকরণের ধারণা সম্ভবত প্রথমে Aubreville প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি জরিপ এবং দরিদ্র কৃষকদের দ্বারা অনুসৃত অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ভূমির অব্যবস্থাপনা থেকে সৃষ্ট ভূমির মারাত্মক অনবয়ন মূল্যায়ন করেছিলেন।

ভূমি অবনয়নের কারণসমূহ (Causes of land degradation)  বাংলাদেশে ভূমি অবনয়নের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে: (১) ক্ষয়ীভবন, দূষণ (contamination), দৃঢ়ীকরণ (compaction), ভ্রান্ত চাষ পদ্ধতির করণে জৈবপদার্থ হ্রাস, লবণাক্তকরণ এবং জলাবদ্ধতার ফলে ব্যাপক মৃত্তিকা অবনয়ন; (২) প্রধানত ভূমি রূপান্তর ও বন উজাড়ের মাধ্যমে মৃত্তিকা অবনয়ন; (৩) চাষাবাদ, নগরায়ণ প্রভৃতি কারণে প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের (natural landscape) অবনয়ন এবং (৪) নিবিড় চাষ পদ্ধতি, নগরায়ণ ইত্যাদির দ্বারা জীব-ব্যবর্তন (bio-diffraction) হ্রাস এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থার (ecosystem) খন্ডকরণ। ভূমি অবনয়নের অন্যান্য কারণসমূহের মধ্যে খরা, জনসংখ্যার চাপ, দারিদ্র্য, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ এবং স্থানীয় কৃষি ও ভূমি ব্যবহার নীতি অন্তর্ভুক্ত। উচ্চ ফলনশীল শস্যের (High Yielding Variety- HYV) নিবিড় চাষাবাদ এবং সেইসঙ্গে জমিতে ভারসাম্যহীন সার প্রয়োগ দেশের কৃষিজমির মারাত্মক অবনয়ন ঘটাচ্ছে। ভূমি অবনয়নের এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত বা সমন্বিত মৃত্তিকা ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিমিত সার প্রয়োগ নিশ্চিত করে ভূমির এ অবনয়নকে বিপরীতমুখী করা দরকার।

ভূমি অবনয়ন ও টেকসই ক্ষমতা (Land degradation and sustainability)  উচ্চ ফলনশীল শস্যের আবাদসহ নিবিড় চাষাবাদ পদ্ধতি মৃত্তিকা থেকে অত্যধিক পরিমাণে পুষ্টি উপদান অপসারণ করছে, কিন্তু অনুমিত পুষ্টি উপাদান অপসারণের তুলনায় রাসায়নিক সারের (নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম) প্রয়োগ অনেক কম হয়ে থাকে। পুষ্টি উপাদানের অপসারণ ও সারের মাধ্যমে মৃত্তিকাতে পুষ্টি উপাদান সরবাহের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার পরিণতিস্বরূপ মারাত্মক ভূমি অবনয়ন ঘটছে। বাংলাদেশে সারের ব্যবহার অপর্যাপ্ত ও অধিক ত্রুটিপূর্ণ। এর কারণ হলো সারের উচ্চ মূল্য, অনিয়মিত সরবরাহ এবং মৃত্তিকা পরীক্ষণ মানের ভিত্তিতে সুপারিশকৃত পরিমাণ ও সারের প্রকার সম্পর্কিত যথার্থ জ্ঞানের অভাব। অযথাযথ সার ব্যবহার এবং সেইসঙ্গে জৈব এবং জীবাণু সারের ব্যবহার প্রায় না করাই বাংলাদেশে ভূমি অবনয়নের প্রধান কারণ। মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব ধর্মাবলির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ব্যতীত সর্বাধিক আর্থিক সুফল পাওয়ার জন্য গাছের পুষ্টি উপাদানের সব প্রধান উৎসের কার্যকর ও বিচক্ষণ ব্যবহারের দিকেই একটি সমন্বিত পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে।

মরুকরণ (Desertification)  জলবায়ুগত পরিবর্তন ও মানুষের কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাবে শুষ্ক, প্রায় শুষ্ক ও শুষ্ক আর্দ্র প্রায় অঞ্চলে ভূমির অবনয়ন। এ সংজ্ঞা বহির্ভূত এলাকাগুলোতেও অস্বাভাবিক বা আর্দ্র জলবায়ু থাকে। জলবায়ুগত অঞ্চলের এ সংজ্ঞাটি ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’ (FAO) প্রদত্ত কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের (Agroecological Zones) সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ভিত্তিউপাত্তের (database) অভাবের কারণে মানচিত্রে অঙ্কণকৃত খরা প্রভাবিত অঞ্চল তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য প্রদর্শন করে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) কর্তৃক ১৯৯৩ সালে প্রস্ত্ততকৃত মরুকরণের বিশ্ব মানচিত্র (The World Atlas of Desertification) সম্ভবত বিশ্বব্যাপী মরুকরণের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য চিত্র প্রদান করে। এই রিপোর্টটি সম্ভবত জলবায়ু বিশ্লেষণের উপর ভিত্তিশীল এবং এতে সর্বাপেক্ষা কম মৃত্তিকা সম্পদের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। তৎসত্ত্বেও, এই রিপোর্টে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাপ প্রদান করা হয়েছিল এবং এ কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যায়ন ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন ও মরুকরণের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে বিভিন্ন ধারণা রয়েছে। জলবায়ুগত পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল (Intergovernmental panel) কর্তৃক প্রণীত সাম্প্রতিক রিপোর্টসমূহ প্রতিনিয়ত একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে যে, পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর মানুষের প্রভাব সুস্পষ্টরূপে বিদ্যমান। এ বিষয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা কয়েকটি বিষয়ে একমত হন যে, (১) ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অভিক্ষেপিত গড় পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা প্রায় ১.৫°সে. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে যে হার বিগত ১০ হাজার বছরের মধ্যে যে কোন তুলনামূলক সময়কালে উষ্ণতাবৃদ্ধির হারের তুলনায় অধিকতর, (২) ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০ হতে ৩০ সেমি বৃদ্ধি পাবে, এবং (৩) কোন কোন এলাকায় বাষ্পীভবন বৃদ্ধি এবং কোন কোন এলাকায় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়ার ধরনে পরিবর্তন ঘটবে এবং সম্ভবত অধিক বন্যা ও খরা সংঘটিত হবে।

নিয়ামক ও প্রক্রিয়াসমূহ  মরুকরণ প্রক্রিয়ার প্রধান নিয়ামক ও কারণসমূহ জৈবভৌত (biophysical), আর্থ-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়াদির ভিত্তির ওপর নিহিত। ভূমিরূপ যা মৃত্তিকাক্ষয় প্রক্রিয়া, পানিসাম্য পরিবর্তন, পানি সম্পদের অধিক ব্যবহার, কৃষিকার্যের নিবিড়করণ, জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ ও শিল্প সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়কে আনুকূল্য প্রদান করে প্রধানত ভূমির অবনয়ন ঘটায়। ধাপে ধাপে ভূমি অবক্ষয় প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে মরুকরণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে এবং ধাপগুলো সাধারণত নিম্নোক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণে হয়ে থাকে: (১) মৃত্তিকার গাছপালার আচ্ছাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া (২) মৃত্তিকার জৈবপদার্থের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া এবং এর সংযুতির অবনতি ঘটা (৩) মৃত্তিকা সংযুতির (soil aggregates) বির্কীর্ণন ও মৃত্তিকা পৃষ্ঠ বন্ধ হয়ে যাওয়া (৪) পৃষ্ঠ গড়ানো পানি ও মৃত্তিকা বস্ত্তর স্থানান্তর এবং (৫) মৃত্তিকা অবনয়নের চূড়ান্ত পর্যায় তথা মরুকরণ। ভূমি অবনয়নের বর্ণনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে মৃত্তিকাক্ষয়কে মরুকরণের মূখ্য ভৌত প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা যায়।

বর্তমান কালের মরুকরণ প্রক্রিয়ার অধিকাংশই সাম্প্রতিক বা দূরবর্তী সময়কালের ঐতিহাসিক ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট। এসব নিয়ামক ও কারণসমূহ বিভিন্ন স্থানিক (spatial) ও কালিক (temporal) প্রেক্ষাপটে মরুকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াসমূহকে প্রভাবিত করে। স্থানভেদে মরুকরণ প্রক্রিয়ার হারে ভিন্নতা ঘটে। প্রধানত বৃষ্টিপাত এবং জৈব-জলবায়ুগত স্থিতিমাপসহ জলবায়ুর পার্থক্য এবং পরিবেশের ওপর মানুষের ব্যতিচারের তীব্রতার পার্থক্যের কারণে মরুকরণ প্রক্রিয়াও স্থানভেদে ভিন্ন তথা কমবেশি হয়ে থাকে।

ভূমিব্যবহার ব্যবস্থায় পরিবর্তন ও অবনয়ন (Landuse changes and degradation)  বিশ্বজুড়ে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনপ্রতি নীট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.১৫ শতাংশ মাত্র। দেশের ৯০ লক্ষ হেক্টরের সীমিত নীট চাষযোগ্য জমির কৃষি নিবিড়তা হচ্ছে ১৭৪.৬৪ শতাংশ। প্রধানত ক্ষয়ীভবন, পুষ্টি উপাদান নিঃশেষ হওয়া, অসামঞ্জস্য সার প্রয়োগ, জলাবদ্ধতা, বন উজাড়করণ, লবণাক্ততা এবং ক্ষারত্বের কারণে মৃত্তিকা অবনয়ন সংঘটিত হয়।

মৃত্তিকা ও পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর কাঙ্খিত মাত্রার শস্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণ নির্ভর করে। এ পর্যন্ত শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রধানত উচ্চ ফলনশীল শস্যের আবাদ, সার প্রয়োগ, সেচ ও কৃষি-রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। সারের ব্যবহার বৃদ্ধির সম্প্রসারণ ব্যতীত বিশ্বের কোন দেশেই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের কতিপয় অধিক শিল্পায়িত দেশসমূহে সার ব্যবহারের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে পরিবেশবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট অহেতুক আশঙ্কার কারণে পরিমিত সার ব্যবহার বৃদ্ধি করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হওয়া উচিত নয়, কারণ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম বিষয় হচ্ছে পরিমিত সার প্রয়োগ। তদুপরি, বাংলাদেশের মৃত্তিকার উর্বরতা নিম্নমানের, সার ব্যবহারের পরিমাণ কম এবং জলবায়ু ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় প্রকৃতির। তৎসত্ত্বেও, অসামঞ্জস্য পরিমাণ সার প্রয়োগের ফলে সৃষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ক্রমবৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত জৈবসার ও শস্য অবশেষ ব্যবহার, নাইট্রোজেনের অধিক অপচয় ও স্বল্প ব্যবহার-দক্ষতা প্রভৃতি ব্যাপারেও উদাসীন থাকা চলবে না। সুতরাং, সুষম ও সমন্বিত মৃত্তিকা ও পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা এবং মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের পরিবর্তন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক।

নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সারের ব্যবহার  জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের শস্য উৎপাদন ক্ষমতায় এককভাবে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম (NPK) সারত্রয়ের প্রভাব চিহ্নিত করেছে। এ সংস্থা কয়েকটি প্রধান শস্যের উৎপাদন সূচক নির্ণয় করে দেখিয়েছে যে, প্রতি ১ কেজি NPK সার প্রয়োগের ফলে গম, ধান, ভুট্টা, জোয়ার ও ডালের উৎপাদন যথাক্রমে ৭.৫, ১০.৭, ১১.৩, ৭.১ ও ৬.৩ কেজি বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গড় উৎপাদন সূচক হচ্ছে প্রতি কেজি NPK সার প্রয়োগে ধান, গম ও ভুট্টার অতিরিক্ত উৎপাদন যথাক্রমে ১০.৫, ৪.৯ এবং ১৩.০ কেজি। বাংলাদেশের কৃষি ইনস্টিটিউটসমূহ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং পরীক্ষণগুলোর সুষ্ঠু পরিচর্যা সাধন করছে। এ কারণে তাদের পরীক্ষণ খামারগুলোতে ভূমি অবক্ষয়ের ফলে উৎপাদন হ্রাসের কোন প্রকার লক্ষণীয় প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তৎসত্ত্বেও, ভূমি, পানি, পুষ্টি উপাদান, জৈব ও অন্যান্য সরবরাহকৃত উপাদানের সমন্বিত দক্ষতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

অতীতকালের বিভিন্ন ধরনের ভূমি ব্যবহারের পরিণতি ও ভূমি ব্যবহার ধারার পরিবর্তন বর্তমান অবস্থার দিকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার বিবর্তনকে বুঝতে এবং ভূমির আরও অবনয়ন ও মরুকরণ রোধে পন্থা নির্ণয় করতে সাহায্য করতে পারে। কৃষি নিবিড়করণ, কৃষি পরিত্যক্তকরণ, নগর সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন বৃদ্ধি, খনি খনন ও ভূমি-পূর্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবহণ এবং পর্যটন ও বিনোদন প্রভৃতির লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকান্ড বর্তমানে মরুকরণ প্রক্রিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য (Climatic change and bio-diversity)  একটি অবিরত আন্তঃক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া দুটি স্বতন্ত্র প্রতিভাস। জলবায়ু মরুকরণ অগ্রগমনের সীমাগত অবস্থা নির্ধারণ করে এবং মরুকরণ প্রক্রিয়া বায়ুমন্ডলীয় সঞ্চালন প্রভাবকারী শক্তি ও পানির প্রবাহ বিভাজন ক্রিয়াকে পরিবর্তন করে থাকে। মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা উভয়ের বিবর্তন প্রভাবিত হয়ে থাকে। জলবায়ু উষ্ণায়ন ইতিহাসের আবর্তক চক্র বিগত শতাব্দীতে প্রধানত মানব সভ্যতার উন্নয়নের ফলে পরিবর্তিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তৎসত্ত্বেও, জলবায়ুগত পরিবর্তন তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং খরার মধ্যকার সহযোগিতামূলক আন্তঃক্রিয়া মরুকরণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে থাকতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম অংশে এই পরিস্থিতি সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে যেখানে বিগত কয়েক দশকে খরা সংঘটন, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক উত্তোলন এবং মৃত্তিকা লবণাক্তকরণ প্রক্রিয়াসমূহ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষকরণ ও রাসায়নিক স্পিসিস দ্বারা সমৃদ্ধকরণ (eutrophication) এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থার (ecosystem) অবনয়নও এই প্রক্রিয়াসমূহের সঙ্গে ঘটেছে। শুষ্কভূমির প্রতিবেশ ব্যবস্থা রক্ষাকারী নাজুক সাম্য জলবায়ুর এসকল পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তদুপরি, গঙ্গার উজানে অবস্থিত দেশ কর্তৃক একতরফাভাবে নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে মৃত্তিকা পরিলেখের শিকড় অঞ্চলের (rhizosphere) মৃত্তিকা পানি নিঃশেষ হচ্ছে। এসব এলাকার পরিচিত গাছ ও প্রাণীর অনেক প্রজাতির টিকে থাকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, যারা দেশের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতায় অনেক অবদান রাখছে।

ভূমি অবনয়ন পরিস্থিতি ও তীব্রতা (Status and severity of land degradation)  ভূমি অবনয়নের নিম্নোক্ত চারটি মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে: (১) মৃদু অবনয়ন: ভূমির কৃষি উপযুক্ততা কিছু পরিমাণে হ্রাস পেলেও স্থানীয় চাষাবাদ ব্যবস্থার জন্য তা উপযুক্ত। ভূমি ব্যবস্থাপনা রীতিতে পরিবর্তন আনতে পারলে পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। আদি জৈবিক কর্মকান্ডসমূহ এখন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ আছে; (২) মাঝারি অবনয়ন: কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেলেও স্থানীয় আবাদ ব্যবস্থার জন্য এখন পর্যন্ত তা উপযুক্ত। উৎপাদন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন। আদি জৈবিক কর্মকান্ডসমূহ আংশিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; (৩) তীব্র ভূমি অবনয়ন: খামার পর্যায়ে এই ভূমি সংশোধনযোগ্য নয়। ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাপক প্রকৌশলগত কর্মকান্ডের প্রয়োজন হয়। আদি জৈবিক কর্মকান্ডসমূহ ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে; এবং (৪) চরম পর্যায়ের অবনয়ন: এ ধরনের ভূমি সংশোধন ও পুনরুদ্ধারের অযোগ্য। আদি জৈবিক কর্মকান্ডসমূহ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

ভূমি অবনয়ন


ভূমি অবনয়নের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি নিঃসন্দেহে একটি দেশের জন্য বিরাট উদ্বেগের কারণ। সামাজিক পরিণতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষকের আয় কমে যাওয়া। তুলনামূলকভাবে মৃদু ভূমি অবনয়ন, উদাহরণস্বরূপ, মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের মাধ্যমে মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান ফিরিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে সম্পদ নবায়নযোগ্য এবং অবনয়ন বিপরীতমুখী। অপরদিকে, দুই প্রকার তীব্র ভূমি অবনয়নের ক্ষেত্রে কোন কোন সময় ভূমির উৎপাদনক্ষমতা সংশোধনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায়। মৃত্তিকাক্ষয়ের ক্ষেত্রে মৃত্তিকা সংরক্ষণ পদক্ষেপের দ্বারা ক্ষয়রোধ এবং হারিয়ে যাওয়া মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান ও জৈবপদার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষতিকর প্রভাবকে বিপরীতমুখী করা যেতে পারে। কিন্তু যেখানে জলনালার মাধ্যমে ভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বা পরতে পরতে সংঘটিত মারাত্মক ক্ষয়ের ফলে মৃত্তিকার উপরের সমৃদ্ধ স্তর অপসারিত হয়ে কাঁকরসমৃদ্ধ অবশেষ থাকে, সেসব ক্ষেত্রে ভুমি অবনয়ন সুস্পষ্টরূপে পুনরুদ্ধারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

গবেষণার আবশ্যকতা  ভূমি অবনয়ন পরিহারের লক্ষ্যে বিশেষ কতগুলো ক্ষেত্রে গবেষণা কার্যক্রম অপরিহার্য: সম্পদ পরিসংখ্যাপত্র (Resource inventory): সম্পদ পরিসংখ্যাপত্রের উদ্দেশ্যগুলোতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো: (১) জলবায়ু, ভূমিরূপ ও মৃত্তিকা সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রচিত কৃষি প্রতিবেশ এলাকার পরিশোধন/পুনর্বিন্যাস; (২) থানা পর্যায়ে মৃত্তিকা সম্পদের পরিসংখ্যাপত্র (৩) ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বিষয়ভিত্তিক মানচিত্র তৈরিকরণ; (৪) মৃত্তিকা অবনয়ন পরিমাপকরণ; (৫) দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ুগত উপাত্ত-ভান্ডার (database) উন্নতকরণ এবং (৬) ভূ-পৃষ্ঠের ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের উপাত্ত-ভান্ডার তৈরিকরণ। বর্ণিত উদ্দেশ্যগুলো বাংলাদেশে যতটুকু অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতোমধ্যে প্রস্ত্তত করা হয়েছে কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল মানচিত্র, যাতে সমগ্র দেশকে ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে এবং ভূ-প্রকৃতি, প্লাবন গভীরতা, জলবায়ু ও মৃত্তিকার ওপর ভিত্তি করে আরো ৮৮টি উপবিভাগ প্রদর্শন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ থানার মৃত্তিকা সম্পদ মানচিত্র প্রস্ত্তত করা হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে (Bangladesh Agriculture Research Council - BARC) একটি  জিআইএস (GIS) ও কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল- এ.ই.জেড (AEZ) তথ্যভিত্তি প্রণয়ন ও উন্নয়ন সাধন প্রযুক্তি ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে।

চাষাবাদ পদ্ধতি গবেষণা (Cropping system research)  এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে: (১) দক্ষতাপূর্ণ ও অধিক নিবিড় চাষপদ্ধতির উন্নয়ন এবং সমগ্র দেশের কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কৃষি প্রযুক্তি অনুসন্ধান; (২) শস্য-জলবায়ু উৎপাদন মডেল প্রণয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে শস্য-জলবায়ু সম্পর্ক অনুধাবন; (৩) অধিক লাভের লক্ষ্যে অধিক মূল্যবান শস্য অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে চাষাবাদ ব্যবস্থার বহুমুখীকরণ; এবং (৪) জৈববস্ত্তর (biomass) উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এফএসআর দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে প্রচারণা চালানো। শস্য পদ্ধতি গবেষণায় যতটুকু অর্জিত হয়েছে তা থেকে কয়েকটি বহুশস্য চাষ পদ্ধতির (multiple cropping system) উন্নয়ন করা হয়েছে। কৃষকের অনুসরণের জন্য এসব পদ্ধতির মূল্যায়ন ও মাঠ পর্যায়ে যথার্থতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা (Nutrient management)  জমিতে জন্মানো শস্যসমূহ মৃত্তিকা থেকে ব্যাপক পরিমাণে পুষ্টি উপাদান অপসারণ করে। শস্য কর্তৃক ব্যবহূত মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় সময় নতুনভাবে সরবরাহ না করলে শস্য উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং ফলশ্রুতিতে ভূমি অবনয়ন ঘটে। সুতরাং পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা গবেষণা মৃত্তিকার স্বাস্থ্য অক্ষত রাখতে উপযুক্ত প্রতিকার ব্যবস্থা নির্ণয়ে পরামর্শ প্রদান করে থাকে। এর উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে: (১) শস্যের অধিকতর ফলন লাভের জন্য সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা; (২) স্থানীয় সম্পদসমূহ ব্যবহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং (৩) বিভিন্ন চাষাবাদ ব্যবস্থার জন্য সমন্বিত পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনা কৌশল বের করা। এই ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হলেও তা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত, অরীতিবদ্ধ এবং অব্যবহূত। গবেষণার এসব ফলাফল বিভিন্ন কৃষি প্রতিবেশ এলাকায় জমির যথার্থতা যাচাই করা প্রয়োজন।

পানি ব্যবস্থাপনা  শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পানি ব্যবস্থাপনা। পানি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে: (১) বিদ্যমান ও সহজলভ্য পানিসম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করা; (২) সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা; (৩) অধিকতর জমি সেচের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সম্মিলিত ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং (৪) নিম্নমানের ভূগর্ভস্থ পানি, নিষ্কাশিত জল এবং পয়ঃজল সেচের জন্য ব্যবহার করা। এই ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের পরিমাণ সীমিত এবং বিভিন্ন কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রকার শস্য ও চাষাবাদ ব্যবস্থায় প্রয়োগের জন্য সম্প্রসারিত ক্ষেত্র প্রয়োজন।

জলাবদ্ধতা  জলাবদ্ধতার দরুন ভূগর্ভস্থ পানি ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে মৃত্তিকাপৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসায় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতার অবনতি ঘটতে থাকে। জলাবদ্ধতার চরম অবস্থায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর ভূপৃষ্ঠের উপরে চলে আসে, যাকে স্থির পানিস্তর (ponding) বলা হয়। জলাবদ্ধতার সঙ্গে লবণাক্ততার যোগসূত্র রয়েছে এবং ত্রুটিপূর্ণ সেচ ব্যবস্থার দরুন উভয় সমস্যার সৃষ্টি হয়। উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের দ্বারা বাংলাদেশের প্রায় ৬.৯ লক্ষ হেক্টর জমি জোয়ারের প্লাবন থেকে সুরক্ষা করা হয়েছে।

লবণাক্তকরণ (salinisation)  ব্যাপক অর্থে জমিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধির দ্বারা সকল প্রকার ভূমি অবনয়নকে বুঝিয়ে থাকে। তবে সীমিত অর্থে জমিতে মুক্ত লবণ সঞ্চয়ন ও সডিফিকেশনকে (যাকে ক্ষারীয়করণও বলা হয়ে থাকে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সডিফিকেশন হলো বিনিময় কমপ্লেক্সে সোডিয়ামের প্রাধান্য ঘটা। সেচ স্কীমসমূহের ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা ও অব্যবস্থাপনার দরুন প্রধানত মানব-সূচিত এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। অত্যধিক পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির উপকূলীয় মৃত্তিকাতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলেও লবণাক্ততার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে লবণাক্ততার ফলে সৃষ্ট ভূমি অবনয়ন অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের নীট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৩০ শতাংশই উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। উপকূলীয় ও সমুদ্র দূরবর্তী ২৮.৫ লক্ষ হেক্টর জমির প্রায় ৮.৩ লক্ষ হেক্টর চাষযোগ্য জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত। মৃত্তিকার লবণাক্তকরণে যেসব নিয়ামক উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী, সেগুলো হচ্ছে: (১) বর্ষা ঋতুতে (জুন থেকে অক্টোবর) জোয়ারের সৃষ্ট প্লাবন, (২) লবণাক্ত অথবা লবণাক্ত-স্বাদু পানির দ্বারা জলমগ্ন হওয়া এবং (৩) শুষ্ক ঋতুতে (নভেম্বর থেকে মে) ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানির ঊর্ধ্বমুখী ও পার্শ্বীয় বিস্তৃতি ঘটা। বাংলাদেশে লবণাক্ততা সমস্যার তীব্রতা মৃত্তিকার শুষ্ক হওয়ার (desiccation) সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক কালে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে লবণাক্ত সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ ঘটায় লবণাক্ততার তীব্রতা ও বিস্তৃতি উভয়ই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (SRDI) একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, লবণাক্ততা আক্রান্ত এলাকার বিস্তৃতি ১৯৭৫ সালের ৮.৩ লক্ষ হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩০.৫ লক্ষ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে।

মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা  মৃত্তিকা সম্পর্কিত সীমাবদ্ধতাসমূহ প্রায়ই শস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সমস্যা দুর করার লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক বিশেষ বিশেষ প্রযুক্তি নির্ধারণ করা। ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, খরা ও লবণাক্ততা উভয় সমস্যাপীড়িত জমিতে শস্য উৎপাদন প্রভৃতির ওপর কিছু সাফল্য পরীক্ষামূলক খামার ব্যবস্থায় অর্জিত হলেও এখনও তা কৃষকের জমিতে যাচাই করার অপেক্ষায় রয়েছে।

কঠিন অন্তর্ভূমি স্তর সৃষ্টি (Pan formation)  বছরের পর বছর দেশীয় লাঙ্গল দ্বারা চাষ করে রোপা ধান আবাদ করার ফলে দেশীয় লাঙ্গলের ফলার সীমার নিচে প্রায় ৩ থেকে ৫ সেমি অকর্ষিত কঠিন অন্তর্ভূমি স্তর তৈরি হয়। এই কঠিন অন্তর্ভূমি স্তর মূলের বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং শস্যের বৃদ্ধির জন্য অন্তঃমৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে যে, তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও বরেন্দ্র এলাকার প্রায় ২০/৩০ লক্ষ হেক্টর জমিতে এ ধরনের শক্ত অন্তর্ভূমি স্তর গঠিত হয়েছে।

অম্লকরণ (Acidification)  পাহাড়ি, সোপান ও অন্যান্য পললভূমিতে বিদ্যমান চাষের জমি কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত বনভূমির বেশিরভাগ পৃষ্ঠমৃত্তিকা (topsoil) বিভিন্ন মাত্রায় অম্লীয়। অত্যধিক চরম মাত্রার এসিডিকরণ উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬২,০০০ হেক্টর সক্রিয় অম্ল সালফেট মৃত্তিকায় লক্ষ্য করা গিয়েছে। নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে এখানে চরম অম্লত্ব (পি.এইচ মাত্রা ২ থেকে ৪) সৃষ্টি হয়েছে যার সঙ্গে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম বিষাক্ততা ও ফসফেট আবদ্ধকরণ সমস্যা। পিরাইটীয় সালফাইডের অণুজীবীয় জারণের মাধ্যমে সালফেট ও সালফিউরিক এসিড উৎপন্ন হওয়ার ফলে এ অম্লত্বের সৃষ্টি হয়। জোয়ারে প্লাবিত নবীন ভূমির সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সুপ্ত অম্ল সালফেট মৃত্তিকা বিদ্যমান। সিলেট অববাহিকা, নিম্ন আত্রাই অববাহিকা এবং মধুপুর ও বরেন্দ্রভূমির কিছু প্রশস্ত উপত্যকা এলাকার ভারী কর্দম মৃত্তিকাতে তীব্র অম্লকরণের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহের উল্লেখযোগ্য গভীরতা পর্যন্ত মৃত্তিকা চরম অম্লকরণের শিকার হয়েছে।

বন উজাড়করণ ও মরুকরণ  গাছপালা কেটে ফেলা এবং চরম ক্ষেত্রে বর্তমানের বনভূমি এলাকাগুলোর পুনরায় বনভূমি হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা না থাকাই হচ্ছে বনভূমি অবনয়ন। গাছ জন্মানোর ক্ষমতার চেয়ে অধিক বৃক্ষ কর্তনের ফলে বনভূমির অবনয়ন ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক বনভূমির গাছপালা কাটা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে অবৈধ বৃক্ষ নিধনের ঘটনাও ঘটে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মানুষের কর্মকান্ড এবং জলবায়ুর পরিবর্তন মরুকরণের প্রধান কারণ। বাংলাদেশে এ দুটি নিয়ামক বিদ্যমান থাকায় সমস্যাটি দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে। শুষ্ক মৌসুমে উজানের দেশ কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। ফলে বাংলাদেশের সমগ্র উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মৃত্তিকার পানি উচ্চহারে নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং এর পরিণতিতে ঐ অঞ্চল মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হয়। এই বিপর্যয় এড়ানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে পানি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনও মরুকরণের জন্য দায়ী, কেননা, শুষ্ক শীত মৌসুমে বৃষ্টিপাত খুবই স্বল্প অথবা কখনও কখনও একেবারেই হয় না। কৃষি-বনায়ন (agro-forestry) ব্যবস্থাটি যদিও পুরনো ও সনাতনী, তথাপি এই ব্যবস্থাটি নবভাবে প্রবর্তিত হয়েছে। এই ব্যবস্থাটির উদ্দেশ্যসমূহ হচ্ছে: (১) বহুমুখী প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ প্রজাতি শনাক্তকরণ, (২) বিভিন্ন কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের জন্য কৃষি-বনায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং (৩) কৃষি-বনায়ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পতিত ভূমির উৎপাদন ক্ষমতাকে ধরে রাখা। তবে কৃষকরা ব্যাপক আকারে ব্যবহারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য দেখাতে পারে নি।  [এস.এম রহমান]