বহিঃশুল্ক
বহিঃশুল্ক দেশে প্রবেশকারী বা দেশ পরিত্যাগকারী পণ্যের ওপর আরোপিত কর। বহিঃশুল্ককে অনেক সময় বহিঃস্থ আবগারি কর-ও বলা হয়, যার মধ্যে আমদানি শুল্ক ও রপ্তানি শুল্ক অন্তর্ভুক্ত। বহিঃশুল্ক প্রাচীন কালের প্রথাসিদ্ধ করারোপণ থেকে উদ্ভূত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-৩০০ অব্দ) অনুসারে সর্বোচ্চ রাজস্ব কর্মকর্তাকে বলা হতো সমাহর্তা এবং তার দায়িত্ব ছিল সাত ধরনের স্থান থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করা, যার মধ্যে সপ্তম স্থানটিতে ছিল দুই ধরনের বাণিজ্যপথ ভূমিপথ ও সমুদ্রপথ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুগল আমলে (১৫২৬-১৭০৭) চুঙ্গি কর আরোপ করা হতো। দেশ তখন সুবাহ বা প্রদেশে বিভক্ত ছিল এবং এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে চলাচলকারী দ্রব্যের ওপর চুঙ্গি কর আরোপ করা হতো। সমুদ্রপথে আমদানিকৃত পণ্যের ওপরও বহিঃশুল্ক আরোপ করা হতো। তৎকালীন চুঙ্গি ঘর সম্ভবত বর্তমান কালের শুল্ক ভবন। ব্রিটিশ ভারতে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৮ সালে বহিঃশুল্ক বাতিল করেন, কিন্তু ১৮০১ সালে তা পুনরায় চালু করা হয়। ১৮৩৯-৪০ সালে সংগৃহীত বহিঃশুল্কের পরিমাণ ছিল ৪১,০৩,২৯৮ রুপি, যা ছিল সরকারি রাজস্বের ৫%। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমদানি-রপ্তানির ওপর আরোপিত কর ছিল সরকারি রাজস্বের সপ্তম প্রধান উৎস।
বর্তমানের শুল্কায়ন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং শুল্ক সংগ্রহের যাবতীয় আইন ও শাসনযন্ত্র ১৮৭৮ সালে সমন্বিত করা হয়, যখন ব্রিটিশ শুল্ক আইনের অনুরূপ একটি আইন সমুদ্র শুল্ক আইন নামে প্রবর্তিত হয়। উক্ত আইনের বলে বহিঃশুল্ক আরোপ ও আদায় করতে আইনানুগ কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করা হয়। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বহিঃশুল্ক প্রশাসন ছিল প্রাদেশিক সরকারের অধীনে। এরপর কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড আইন ১৯২৪-এর অধীনে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড গঠন করে শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব উক্ত বোর্ডের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯২৪ সালেই ভূমি শুল্ক আইন জারি করা হয় এবং এর অধীনে ভূমিপথে পণ্য ও যাত্রীদের চলাচলের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ভূমিপথে সংলগ্ন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার সীমান্ত অতিক্রমের সময় বা উপমহাদেশের উপর দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবেশের সময় ভূমি শুল্ক আইন প্রযোজ্য ছিল। বহিঃশুল্ক সংক্রান্ত আইনসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি একীভূত করে বহিঃশুল্ক আইন ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের ৪ নম্বর আইন) জারি করা হয়। উক্ত আইনের ২২০ ধারার অধীনে ৪টি আইন (সমুদ্র শুল্ক আইন ১৮৭৮, আন্তর্দেশীয় শুল্কাধীন পণ্যাগার আইন ১৮৯৬, ভূমি শুল্ক আইন ১৯২৪ এবং ট্যারিফ আইন ১৯৩৪) এবং সাধারণ বিমানচালন অধ্যাদেশ ১৯৬০-এর ১৪ ধারা বাতিল করা হয়। এর ফলে সমুদ্র শুল্ক, ভূমি শুল্ক ও বিমান শুল্কের পৃথক আইনি বৈশিষ্ট্যের সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে সর্বোচ্চ কর কর্তৃপক্ষ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গঠন করা হয় এবং বহিঃশুল্কের প্রশাসন এর ওপর ন্যস্ত করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৪৮ নম্বর আদেশ অনুসারে বহিঃশুল্ক আইন কার্যকর করা হয়।
বহিঃশুল্ক কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক কাজই হলো বহিঃশুল্ক আইন ১৯৬৯ এবং মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর অধীনে সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থাপনা করা। শুল্ক কর্তৃপক্ষ প্রধানত আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের ওপর আরোপনীয় বহিঃশুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য কর ধার্য করে ও আদায় করে থাকে। শুল্ক কর্তৃপক্ষের বাড়তি দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে চোরাচালান দমন, আমদানি ও রপ্তানি (নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৫০-কে কার্যে পরিণতকরণ এবং বৈদেশিক বিনিময় নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭-এর প্রয়োগ। এছাড়া সহায়ক কাজ হিসেবে শুল্ক কর্তৃপক্ষ অস্ত্র আইন ১৮৭৮, বিস্ফোরক আইন ১৮৪৪, পণ্যদ্রব্য চিহ্ন আইন ১৮৮৯, পশুসম্পদ আমদানি আইন ১৮৯৮, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০, ইত্যাদি বিভিন্ন আইনের অধীনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের কর-রাজস্বের সিংহভাগ হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর সংগৃহীত শুল্ক কর। ২০০৫-০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট করের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসে পরোক্ষ কর থেকে, যার প্রায় ৭০% সংগ্রহ হয় শুল্ক স্টেশনসমূহে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) সাথে চুক্তি মোতাবেক শুল্কহার কমানোর কারণে সামগ্রিক কর কাঠামোতে বহিঃশুল্কের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৮-০৯ সালের সংশোধিত বাজেটে প্রত্যক্ষ কর সমগ্র করের ৭১.৪% ও ৬৯.৯% এবং ২০০৯-১০ সালের বাজেটে বহিঃশুল্ক সংগ্রহের পরিমান ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৯,৫৭০ কোটি টাকা এবং ১০,৪৩০ কোটি টাকা যা সম্পূর্ণ করের ১৭.২% এবং ১৬.৩%। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলি অনুসমর্থিত হওয়ার পর থেকে শুল্ক হার ক্রমাগত হ্রাসের ফলে কর কাঠামোতে বহিঃশুল্কের অংশ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হ্রাস পাচ্ছে। [স্বপন কুমার বালা এবং হেলাল উদ্দিন আহমেদ]