আহমদ, এ.এফ সালাহ্উদ্দীন
আহমদ, এ.এফ সালাহ্উদ্দীন (১৯২৪-২০১৪) উদারবাদী, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তক, ইতিহাসবিদ এবং বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। সাধারণ্যে এ.এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ নামে সুপারিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহমদ। তিনি বিশ্বাসে ও আচরণে ছিলেন সত্যানুসন্ধানী ও মানবতাবদী এবং এ আদর্শ তাঁর ইতিহাস চর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদের পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাঁশবাড়িয়ায়। তবে, তিনি ১৯২৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর তাঁর পিতার তৎকালীন কর্মস্থল বিহারের চম্পারণ জেলা সদরের মতিহারি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। সালাহ্উদ্দীন আহমদের পিতা আবু আহমেদ ফয়জুল মহী, পিতামহ মৌলভী আহমেদ এবং মাতামহ আজিজুল হক সকলেই ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র এবং পেশাগত জীবনে উচ্চপদাধিকারী সরকারি চাকুরিজীবী। পিতার চাকুরির সূত্রে সালাহ্উদ্দীন আহমদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কলকাতায় এবং সেখানকার তালতলা হাইস্কুল থেকে ১৯৩৮ সালে তিনি মেট্রিকুল্যাশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৪০ সালে কলকাতা রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ^বিদ্যালয়) থেকে ১৯৪৩ সালে ইতিহাস বিষয়ে বি.এ (সম্মান) এবং ১৯৪৪ সালে একই বিষয়ে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং সেখানকার পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে তাঁর দ্বিতীয় এম.এ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এ.এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (ঝঙঅঝ) থেকে ১৯৬১ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘ঝড়পরধষ ওফবধং ধহফ ঝড়পরধষ ঈযধহমব রহ ইবহমধষ ১৮১৮-১৮৩৫’। তাঁর এ অভিসর্ন্দভটি পরিমার্জিতরূপে ১৯৬৫ সালে নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান লেইডেন থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতে বাংলায় যে বহুমুখী পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল, এ গ্রন্থটিতে সেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে। সালাহ্উদ্দীন আহমদের এ গ্রন্থটি তাঁকে একজন বিদগ্ধ সমাজিক ইতিহাসবিদ হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি দান করে। ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ, ঢাকা থেকে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ-চিন্তা ও সমাজ বিবর্তন ১৮১৮-১৮৩৫ শিরোনামে এ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
১৯৪৮ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ-এর ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সালাহ্উদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন এবং রিডার ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এর ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরে ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে চলে আসেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অবসরগ্রহণের পরও কয়েক বছর সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবে পাঠদান ও গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। সালাহ্উদ্দীন আহমদ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর ন্যাশনাল কালচার এন্ড হেরিটেজ ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ বিভিন্ন বিদেশি বিশ^বিদ্যালয়েও পাঠদান এবং গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ইউনেস্কো ফেলো হিসেবে জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটিতে আধুনিক জাপানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ও শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে পাঠদান করেন। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে মৌলিক ও অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে সালাহ্উদ্দীন আহমদকে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করে।
সালাহ্উদ্দীন আহমদ একজন প্রগতিশীল, উদার সংস্কৃতিবান, যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি কলকাতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির প্রতিও তাঁর এক সময় ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন রায় নামে সমাধিক পরিচিত) সাথে পরিচয়ের সূত্রে তিনি তাঁর ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি ‘কলকাতা পোর্ট কমিশনর্স শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর যুগ্ম সম্পাদক এবং ‘অল বেঙ্গল পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ১৯৪৬ সালের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি রাজনীতি ছেড়ে দাঙ্গা রোধ এবং ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার জন্য রেডক্রসে যোগদান করেন। ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতার সময় তাঁর বন্ধু জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও হাবিবুর রহমান প্রমুখের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘র্যাশনালিস্ট ক্লাব।’ ক্লাবের মুখপত্র হিসেবে ‘মুক্তি’ নামে একটি সাময়িকপত্রও প্রকাশ করা হয়েছিল। অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার জন্য গঠিত বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি এ সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। যৌথভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ‘ইতিহাস’ পত্রিকার। তিনি ইউনাইটেড ন্যাশনস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। সালাহ্উদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি-ও কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমিসহ অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ ইতিহাসচর্চা ও লেখা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার প্রধান আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল উনিশ শতকের বাংলা। তবে, তাঁর লেখার পরিম-ল ছিল আরো প্রসারিত। দীর্ঘ সময়ে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সম্পাদনাও করেছেন কয়েকটি গ্রন্থ। ইতিহাসের একজন শিক্ষক হিসেবে সালাহ্উদ্দীন আহমদ নিজেকে কেবল একাডেমিক ইতিহাস চর্চার মধ্যেই আবদ্ধ রাখেননি, বরং একজন সমাজ সচেতন ও দেশ-প্রেমিক মানুষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করায়ও সচেষ্ট থেকেছেন। ফলে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখার পাশাপশি সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য নিবন্ধ লিখেছেন। এ সব নিবন্ধের কিছু কিছু তাঁর সংকলন গ্রন্থসমূহে যুক্ত হয়েছে। সালাহউদ্দীন আহমদের রচিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো। ঝড়পরধষ ওফবধং ধহফ ঝড়পরধষ ঈযধহমব রহ ইবহমধষ ১৮১৮-৩৫ (১৯৬৫); ইধহমষধফবংয: ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ ঞৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ (১৯৮৭); ওহফরধ, চধশরংঃধহ, ইধহমষধফবংয: চবৎংঢ়বপঃরাব ড়হ ঐরংঃড়ৎু, ঝড়পরবঃু ধহফ ঈঁষঃঁৎব (২০০১); ইবহমধষর ঘধঃরড়হধষরংস ধহফ ঊসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয: অহ ওহঃৎড়ফঁপঃড়ৎু ঙঁঃষরহব (১৯৯৪); ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঐবৎরঃধমব: জবভষবপঃরড়হং ড়হ ঝড়পরবঃু চড়ষরঃরপং ধহফ ঈঁষঃঁৎব ড়ভ ঝড়ঁঃয অংরধ (২০০৭); বাংলাদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ (১৯৯১); বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৯২); ইতিহাসের সন্ধানে (১৯৯৫); বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র (১৯৯৩); বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত (২০০০); এবং ইতিহাস, ঐতিহ্য, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র (২০১৩)।
ইতিহাসচর্চা, শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে মৌলিক ও অনন্য অবদানের জন্য জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ (১৯৯১) এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (১৯৯৯) অন্যতম। এছাড়াও, বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ফেলোশিপ প্রদানের মাধ্যমে সস্মানিত করে।
এ.এফ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ ২০১৪ সালের ১৯শে অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]