সাহা, চিত্তরঞ্জন
সাহা, চিত্তরঞ্জন (১৯২৭-২০০৭) গ্রন্থ প্রকাশক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক। ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার লতিফপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কৈলাশচন্দ্র সাহা একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন, মাতা তীর্থবাসী সাহা। ১৯৪৩ সালে তিনি নোয়াখালির রামেন্দ্র হাই স্কুল থেকে মাট্রিক এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি চৌমুহনী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
চিত্তরঞ্জন সাহা এক কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হয়েও ১৯৫১ সালে চৌমুহনীতে তিনি প্রথম বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। পরে তিনি একই সঙ্গে বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পুঁথিঘর প্রকাশনী নাম দিয়ে তিনি মাট্রিক পরীক্ষার নোট বই ও টেস্টপেপার প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁর ব্যাবসায়ী অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে এক পর্যায়ে পুঁথিঘর প্রকাশনীর ব্যবসা সাফল্যের তুঙ্গে উঠে। প্রকাশনা ব্যবসার অংশ হিসেবে তিনি চৌমুহনীতে একটি ছা্পাকল স্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি চৌমুহনী থেকে ঢাকায় তাঁর পুস্তক ব্যবসা স্থানান্তর করেন। প্রথমে পাটুয়াটুলিতে পরে বাংলাবাজারে বইয়ের দোকান দিয়ে তিনি বই-ব্যবসার গোড়া পত্তন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি নতুন আঙ্গিকে পুঁথিঘর প্রাইভেট লি: প্রতিষ্ঠা করে নানা ধরণের বই প্রকাশ করেন এবং অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন।
চিত্তরঞ্জন সাহা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী ফরাশগঞ্জে তাঁর পুঁথিঘরের অফিস, দোকান ও গুদাম পুড়িয়ে দেয়। তিনি নিরাপত্তার জন্য কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি অবস্থানরত বাংলাদেশের লেখক-সাহিত্যিকদের সমাবেত করেন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য। তিনি নিজ উদ্যোগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান-এর সম্পাদনায় রক্তাক্ত বাংলা নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থে জিলুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, জহির রায়হান, সৈয়দ আলী আহসান, শওকত ওসমান, আহমদ ছফা, আব্দুল গাফফার চৌধুরীসহ অনেকের লেখা সঙ্কলিত হয়। গ্রন্থটির মুখবন্ধ লেখেন অধ্যাপক আজিজুর রহমান মলিক এবং এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তধারা’-র সূচনা করেন। তাছাড়া তিনি এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেসময় কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশের লেখকদের ৩২টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে প্রথম বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গনে অমর একুশে বই মেলার সূচনা ঘটে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমীতে সাত দিনব্যাপী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে একাডেমীর সামনের আমগাছের নিচে চট বিছিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা নিজের প্রকাশনার বই দিয়ে একরকম অঘোষিতভাবে বইমেলার যাত্রা শুরু করেন। এভাবে কেবল তাঁর উদ্যোগে ১৯৭৫ সালে একই স্থানে ‘মুক্তধারা’র সঙ্গে যোগ দেয় ’নওরোজ কিতাবিস্তান’, ’খান অ্যান্ড ব্রাদার্স’ এবং চট্টগ্রামের ’বইঘর’ সমেত আরও কতকগুলি বাংলাবাজার ভিত্তিক পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এ বই মেলার প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ দেখে বাংলা একাডেমী বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৭৮ সাল থেকে বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে ‘একুশে বই মেলা’ প্রবর্তন করে। উত্তরকালে এ বই মেলা বাঙালির জাতীয় জীবনের বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়।
চিত্তরঞ্জন সাহা প্রথম দিকে বাণিজ্যিক নোট বই প্রকাশ করলেও পরে তিনি সৃজনশীল বই প্রকাশে বেশি উদ্যোগী হন। ‘মুক্তধারা’ ছিল তাঁর এক স্বপ্নের ফসল। তিনি তরুণ লেখকদের উৎসাহ প্রদানের জন্যে ‘মুক্তধারা পুরস্কার’, ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। বই প্রকাশের পাশাপাশি তিনি বইয়ের খবর এবং সাহিত্যপত্র শীর্ষক ত্রৈমাসিক প্রকাশনা শুরু করেন।
একজন সমাজসেবক এবং গ্রন্থ প্রকাশনা জগতে বিশিষ্ট অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে একুশে পদক ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সেরা প্রকাশক স্বর্ণপদক, ১৯৮৬ সালে নাট্যদল থিয়েটারের শ্রদ্ধাঞ্জলি, ১৯৮৮ সালে নাট্যসভা পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা অর্জন করেন। ২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন সাহার মৃত্যু হয়।
[মামুনূর রশীদ]