শিগেলোসিস
শিগেলোসিস শিগেলা (Shigella) নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সৃষ্ট এক ধরনের রক্ত আমাশয় যাহা ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি নামে অধিক পরিচিত। এ ব্যাকটেরিয়ার চারটি প্রজাতি Shigella dysenteriae, S. flexneri, S. sonnei এবং S. boydii মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। সাধারণত দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে এ রোগজীবাণু অন্ত্রে প্রবেশ করে। খাদ্যদ্রব্য খাওয়া বা নাড়াচাড়া করার আগে হাত ধুয়ে নিলে এ রোগের আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। এসব ব্যাকটেরিয়া ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছে সংখ্যা বৃদ্ধি করে, বিষাক্ত দ্রব্য তৈরি করে এবং অন্ত্রের আবরণী কলা আক্রমণ করে ও রোগের সূচনা ঘটায়। ফলে পাতলা পায়খানা, জ্বর ও পেটে তীব্র বেদনা অনুভূত হয়। মলের পরিমাণ অল্প হলেও রক্ত এবং মিউকাস মিশ্রিত থাকে। এর সাথে জ্বরও দেখা দেয়। এ অবস্থাকে সাধারণত রক্ত আমাশয় বলা হয়। রোগের তীব্রতা সাধারণত এক সপ্তাহ থাকে। ঠিকমতো চিকিৎসা (অ্যান্টিবায়োটিকসহ) না হলে বিভিন্ন জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়, এমনকি কিডনি নষ্ট হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে মৃত্যু এবং অসুস্থতার অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি বা রক্ত আমাশয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগের শিকার হয় পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুরা।
রক্ত আমাশয় সারাবছরই কমবেশি দেখা দেয়। কোন কোন বছর মহামারী আকারে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত্যুর কারণ। শীতকালে এ রোগের প্রকোপ কিছুটা কম। ফেব্রুয়ারি মাসে আমাশয়ের হার সর্বনিম্ন; কিন্তু এর পর থেকে পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হয় এবং রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় বর্ষাকালে জুন-জুলাই মাসে। কোন কোন বছর বর্ষা বা বন্যার পর পর রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেখা গেছে অন্যান্য আন্ত্রিক রোগের মতো রক্ত আমাশয় ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার পর বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা এবং অস্বাস্থ্যকর পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা এর প্রাদুর্ভাব ও বিস্তৃতির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে রক্ত আমাশয়ে আক্রান্তদের সংখ্যা বছর ভেদে ভিন্ন হয়। এটা নির্ভর করে মহামারীর তীব্রতার উপর। তবে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যেরও অভাব রয়েছে। মহামারীর তীব্র প্রাদুর্ভাব না ঘটলেও বাংলাদেশে দুই থেকে তিন লক্ষ লোক রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত হয়। মহামারী দেখা দিলে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
কলেরা এবং অন্যান্য উদরাময়ের মতো এ রোগে সাধারণত প্রচুর পাতলা পায়াখানা হয় না, ফলে পানিশূন্যতাও দেখা দেয় না; তাই এ রোগে খাওয়ার স্যালাইনের ব্যবহার নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। যদিও যেকোন ধরনের পাতলা পায়খানায় খাওয়ার স্যালাইন ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে। রক্ত আমাশয়ের প্রাথমিক পর্যায়েও অনেক সময় পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এ রোগ অনেক সময় এমনিতেই সেরে যায়, তবুও যথাযথ পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা শ্রেয়।
বেশ কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক রক্ত আমাশয় চিকিৎসায় কার্যকর, যেমন অ্যাম্পিসিলিন, ট্রাইমিথোপ্রিম এবং কুইনোলোনজাত অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন সিপ্রোফ্লক্সাসিন। উন্নয়নশীল দেশে এ রোগ চিকিৎসায় অহেতুক মাত্রাতিরিক্ত এবং অনিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। শিগেলা ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বর্তমানে আমাশয় চিকিৎসায় এটি একটি বড় সমস্যা।
আমাশয় হলে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই গড়ে ওঠে। একবার আমাশয়ে আক্রান্ত হলে রোগী পরবর্তী আক্রমণ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। মনে করা হয় কার্যকর ভ্যাকসিন এ রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। যেহেতু শিগেলার অনেক প্রজাতি রয়েছে, তাই প্রত্যাশা করা হয় ভ্যাকসিন সব ধরনের শিগেলা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারবে। অতীতে মৃত পূর্ণ কোষ (killed whole-cell) টিকা মুখে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে দেখা গেছে এটি কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে অক্ষম। সম্প্রতি ব্যাকটেরিয়াকে জীনতাত্ত্বিকভাবে কম আক্রমণাক্তক করে স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার করে লাইভ (live) ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপ্ত করে। এ ধরনের লাইভ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে মানবদেহে শিগেলা প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তোলার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এখনও ব্যাপক ব্যবহার উপযোগী কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় নি। আমাশয় প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উনয়ণনে ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক ক্লিনিক, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং মাঠপর্যায়ে গবেষণা সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ আইসিডিডিআর.বি নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সারাদেশে বেশ কয়েকটি গবেষণা এলাকা আছে, যেখানে জনস্বাস্থ্য গবেষণা এবং মানবদেহে ঔষধ ও টিকার প্রতিক্রিয়া বিষয়ক গবেষণা হয়। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এলাকা হচ্ছে মতলব। ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত এ এলাকার অধিবাসী প্রায় ২ লক্ষ। সারা বছর ধরে সার্ভিলেন্স কার্যক্রমের আওতায় অধিবাসীদের রোগ, জনমিতিসূচক এবং বরিহাগমন পর্যবেক্ষণ করা হয়। ধারণা করা হয়, উন্নয়নশীল অন্য দেশের তুলনায় মতলবে অতি সন্তোষজনক সার্ভিলেন্স সুবিধা গড়ে উঠেছে।
সারা দেশে যেসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় লিপ্ত, সেসবও যৌথভাবে আইসিডিডিআর.বি-র সঙ্গে শিগেলার উপর গবেষণা করছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবের কারণে শিশুদের মাঝে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। ঢাকা শিশু হাসপাতাল তাই যৌথভাবে আইসিডিডিআর.বি-এর সাথে আমাশয় ও অন্যান্য ডাইরিয়া রোগ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে।
[জিয়া উদ্দিন আহমেদ]
আরও দেখুন আমাশয়; উদরাময় রোগ; কলেরা; খাওয়ার স্যালাইন।