পটুয়া সঙ্গীত
পটুয়া সঙ্গীত এক প্রকার লোকগীতি। পটুয়ারা এ গানের রচয়িতা ও পরিবেশক বলে এর নাম হয়েছে পটুয়া সঙ্গীত। পটুয়ারা পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনী অবলম্বনে বিভিন্ন ধরনের পট তৈরি করে এবং সেসব পটের বিষয় অনুযায়ী গান রচনা করে। এই গানগুলি তারা গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সময় পরিবেশন করে। গানের সঙ্গে কখনও কখনও নৃত্যও পরিবেশিত হয়। এর মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে।
পটুয়াদের পট এবং গানের বিষয় বিচিত্র। তার মধ্যে যমলোক, বৌদ্ধ জাতক, গাজী পীর, রামকাহিনী, কৃষ্ণকাহিনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় সামাজিক কোনো ঘটনা নিয়েও পটুয়া গান রচিত হয়। কৃষ্ণের অবতারবিষয়ক একটি গানে এরূপ একটি সামাজিক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়: ‘রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়/ গিন্নির পাপে গিরস্ত নষ্ট ঘরের লক্ষ্মী উড়ে যায়। মহারাজের দেশে দেখ জল নাইক হ’ল/ রাজার প্রজাগণ কষ্ট পেয়ে পলাইতে লাগিল।’
গাজীর পট দেখানোর সময় প্রথমে গাজীর বন্দনা, পরে তার পরিচয়, লীলা, অলৌলিক ক্ষমতা ইত্যাদি গানের সুরে বর্ণনা করা হয়। যমপট দেখানোর সময় মৃত্যুর পরে যমপুরীতে কার কী অবস্থা হয় তা গানের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। এ জগতে যারা পাপ করে যমপুরীতে তাদের শাস্তি সম্পর্কে একটি গানে বলা হয়েছে: ‘যম রাজের মায় বইসা আছে তামার ডেকচি লইয়া। অতি পাপী মানুষের কল্লা দিছে সে ডেকে ফেলাইয়া\’
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে পটুয়া গানের প্রচলন রয়েছে। গুরুসদয় দত্ত সংকলিত পটুয়া সঙ্গীত গ্রন্থে সেসব গান প্রকাশিত হয়েছে। এতে কৃষ্ণলীলা, ব্রজলীলা, রাম অবতার, রাম-লক্ষ্মণ, সিন্ধুবধ ইত্যাদি বিষয়ে পটুয়াদের রচিত গান স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক সময় পটুয়া গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিশেষ করে গাজীর গানের ছিল ব্যাপক সমাদর। এ গানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংস্কারমূলক কাহিনী বর্ণনা করা হতো। ছেলে-বুড়ো সকলের নিকটই এ গান ছিল সমান জনপ্রিয়। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে এর প্রচলন অনেকটা হ্রাস পেলেও অঞ্চলভেদে লোকসঙ্গীতের এই ধারাটি এখনও একটি সম্প্রদায়ের জীবিকা হিসেবে টিকে আছে।
ঢাকার সুধীর আচার্য অঙ্কিত গাজীর পট এক সময় বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে তাঁর পুত্র শম্ভু আচার্য এই লোকজ শিল্পের লালনে নিযুক্ত আছেন। বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত জনৈক কোনাই মিয়া গাজীর গান গেয়ে এবং পট নাচিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
[মোমেন চৌধুরী]
আরও দেখুন পটচিত্র, পটুয়া।