নাজিমউদ্দীন, খাজা
নাজিমউদ্দীন, খাজা (১৮৯৪-১৯৬৪) রাজনীতিবিদ। তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৮৯৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার খাজা পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খাজা নিজামউদ্দীন এবং মাতার নাম নওয়াবজাদী বিলকিস বানু। খাজা ফখরউদ্দীন ও নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ ছিলেন যথাক্রমে তার পিতামহ ও মাতামহ।
খাজা নাজিমউদ্দীন কৈশোরে গৃহশিক্ষকের নিকট শিক্ষাগ্রহণ পরে আলীগড় কলেজে, লন্ডনের ডানস্টাবল গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি হল থেকে এম.এ এবং মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন।
খাজা নাজিমউদ্দীন ১৯২২ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ঐ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যও ছিলেন। ১৯১৯ সালের ভারত আইনের অধীনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক কাউন্সিলে তিনি ১৯২২, ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বরিশাল (মুসলমান) নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। তিনি ডিসেম্বর ১৯২৯ থেকে জুন ১৯৩৪ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩০ সালে তাঁর মন্ত্রিত্বকালে প্রাথমিক শিক্ষা বিল পাস হয়। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় সরকারের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাঁর বিশেষ উদ্যোগে ১৯৩৫ সালে ‘বঙ্গীয় ঋণ সালিশি বোর্ড’ বিল এবং ১৯৩৬ সালে ‘বঙ্গীয় পল্লী উন্নয়ন বিল’ পাস হয়।
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দীন মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে পটুয়াখালী থেকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ.কে ফজলুল হক কর্তৃক পরাজিত হন। কিন্তু পরে উত্তর কলকাতা নির্বাচনী এলাকা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর ছেড়ে দেওয়া আসনটি লাভ করেন। ঐ সময় তিনি মুসলিম লীগ পুনর্গঠন কাজে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন এবং বঙ্গদেশে মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় নেতারূপে পরিচিত হন। ১৯৩৭ সালের এপ্রিলে এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় খাজা নাজিমউদ্দীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। হক-জিন্নাহর মতবিরোধের কারণে তিনি ১৯৪১ সালে ১ ডিসেম্বর জিন্নাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪২-৪৩ সালে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার সময়ে বিরোধী দলীয় নেতারূপে সংসদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৩ সালে ২৮ মার্চ শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে খাজা নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করে। ১৯৪৫ সালের ২৮ মার্চ উক্ত মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৯৪৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরিত ভারতীয় খাদ্য প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন এবং ১৯৪৬ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শেষ অধিবেশনে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে খাজা নাজিমউদ্দীন পূর্ব বাংলার (পূর্বপাকিস্তান) মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ ইন্তেকাল করলে তিনি ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন।
রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন হওয়ায় তিনি প্রগতিবাদী নেতাদের সাথে সহজে তাল মিলাতে পারতেন না। তাঁর মাতৃভাষা ছিল উর্দু এবং বাংলা ভাষা তিনি ভাল জানতেন না। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাবেন বলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে চুক্তি করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের চাপে তিনি সে চুক্তি বাস্তবায়িত করতে পারেন নি।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দীন ১৭ অক্টোবর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহন করেন। কেন্দ্রীয় অর্থ সচিব গোলাম মুহম্মদকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হলে খাজা নাজিমউদ্দীন ১৯৫১ সালে ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ বছরই নভেম্বরে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৬ নভেম্বর মুসলিম লীগের সভাপতি মনোনীত হন।
১৯৫২ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে তিনি সমালোচিত ও নিন্দিত হন। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট গোলাম মুহম্মদ খাজা নাজিমউদ্দীনকে পদচ্যুত করেন এবং বগুড়ার মুহম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে তিনি মুসলিম লীগের সভাপতির পদটিও ত্যাগ করেন এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। ১৯৬৩ সালে তিনি রাজনীতিতে ফিরে এসে পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন।
খাজা নাজিমউদ্দীন একজন উৎসাহী ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের এবং ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত ভারতীয় হকি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ইংল্যান্ডে অধ্যয়নকালে নাজিমউদ্দীন ফুটবল ও টেনিস খেলায় যশ অর্জন করেছিলেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সভাপতি ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৩২ সালে কলকাতা থেকে মুসলিম মালিকানাধীনে সর্বপ্রথম ইংরেজি পত্রিকা স্টার অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত হয়। তিনি কলকাতা ‘শহর মুসলিম বণিক সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্রিটিশ সরকার ১৯২৬ সালে তাঁকে সি.আই.ই এবং ১৯৩৪ সালে কে.সি.আই.ই উপাধি প্রদান করে। ১৯৪৬ সালে রাজনৈতিক কারণে তিনি উপাধিগুলি পরিত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব নিশান-ই-পাকিস্তান এ ভূষিত হন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর খাজা নাজিমউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। ঢাকা হাইকোর্টের পশ্চিমে তিন নেতার মাযার নামে পরিচিত সমাধি সৌধের অভ্যন্তরে তিনি সমাহিত রয়েছেন। [মোহাম্মদ আলমগীর]