জারি গান
জারি গান পয়ার ছন্দে রচিত আখ্যানমূলক গাথা বা পাঁচালি। ‘জারি’ ফারসি শব্দ, অর্থ ক্রন্দন, বিলাপ বা প্রচার করা। এর উদ্ভব কারবালার হূদয়বিদারক বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার জন্য মুহররম মাসের প্রথম দশদিন হযরত ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের স্মরণে মর্সিয়া এবং জারি গান গীত হয়ে থাকে। পরে অবশ্য এ বিষয়টি ছাড়াও জারি গানের আঙ্গিক ও সুরে অন্য অনেক বিষয় স্থান পেয়েছে। ফলে অঞ্চল বিশেষে এ গানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চলে এর বিষয়বৈচিত্র্য রয়েছে। মক্কার জন্মকথা, জহরনামা, সাদ্দাদের জারি, শাহজালালের জারি, সোহরাব-রোস্তমের জারি ইত্যাদির পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যঙ্গরসাত্মক বিষয়, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ক জারি গান সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
জারি গানের উদ্ভবকাল অনুমাননির্ভর। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত বাংলা কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় সতেরো শতকে। কবি মুহম্মদ খান ১৬৪৫ সালে মকতুল হোসেন শীর্ষক কারবালা-কেন্দ্রিক একখানি শোকগাথা রচনা করেন। এটিকেই জারি গানের আদি নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়। মুগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পারস্য থেকে বহু শিয়া মুসলমান এদেশে এসেছিলেন, যাঁদের অনেকেই এখানে রাজদরবারে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তাঁদেরই উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি হিজরি সনের প্রথম মাস মুহররমের প্রথম দশ দিন কারাবালার করুণ ঘটনাকে স্মরণ করে আনুষ্ঠানিক পর্ব পালনের সূচনা হয়।
# #চিত্র:জারি গান html 88407781.png
- #জারি গান
বাংলাদেশে জারি গানের যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায় তাঁর মূলে রয়েছে কারবালা প্রান্তরে রসুল-দৌহিত্র ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারবর্গের করুণ পরিণতি, যা সকল শ্রেণীর মানুষের আবেগকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। এ উপলক্ষে এক সময় শুধু মর্সিয়া গীত হতো, পরবর্তীকালে জারি গানও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ‘মাতম জারি’ বলতে যে জারি গানের কথা জানা যায় তা মুহররম উপলক্ষেই গীত হয়। এছাড়া পালার আঙ্গিকেও জারি গান হয়। এসব গান এত ব্যাপকতা পায় যে, এক সময় হিন্দুদের দুর্গাপূজা উপলক্ষেও জারি গান পরিবেশিত হতো বলে জানা যায়।
ছোট ছোট আকারে বিশেষ সুরে যে গান গাওয়া হয় তাকে বলে মর্সিয়া, আর বয়াতি আলাদা সুরে বিস্তৃতভাবে যে গান পরিবেশন করে তাকে বলে জারি গান। এছাড়া ধুয়ার সুরে যখন ঘটনা প্রকাশ করা হয় তখন তাকে বলে ধুয়া গান। মুহররম উপলক্ষে এ তিনটি ধারায়ই গীত পরিবেশিত হয়।
জারি গানে দুটি দল থাকে। প্রত্যেক দলে একজন করে মূল গায়ক বা বয়াতি থাকে। তাঁর সঙ্গে দোহার থাকে দুই থেকে চারজন এবং বাদক থাকে কমপক্ষে চারজন। অবশ্য অধিকাংশ বয়াতি নিজেও একজন বাদকের কাজ করে। গান পরিবেশনের সময় বয়াতি দোতারা, সারিন্দা, বেহালা বা ডুগডুগি বাজায়; আর যন্ত্রীরা বাজায় ঢোলক, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, বাঁশি, জুড়ি বা ঘুঙুর, খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি। মূল গায়ক বা বয়াতি প্রথমে দর্শক-শ্রোতাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ধুয়া গান ধরে এবং দোহাররা তা সমবেত কণ্ঠে গায়।
দুই জারিয়াল দলের মধ্যে প্রশ্নোত্তরমূলক যে গান গাওয়া হয় তা সাধারণত তিনটি পর্বে বিভক্ত, যথা: বন্দনা, গোষ্ঠগান ও মূল জারি গান। মূল গায়কই সবকিছু শুরু করে এবং দোহাররা তাঁর চতুর্দিকে বসে তাকে সাহায্য করে। বয়াতি দোহারদের চারদিকে আস্তে আস্তে হাঁটে এবং বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে গান পরিবেশন করে। জারি গানে মেয়ে-পুরুষ, জীবাত্মা-পরমাত্মা, রাম-হনুমান, গুরু-শিষ্য, শরিয়ত-মারিফত, আদম-শয়তান, গণতন্ত্র-রাজতন্ত্র, সুফি-মোল্লা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এসব বিষয় অবলম্বনে দুদল জারিয়াল প্রশ্নোত্তর আকারে গান পরিবেশন করে। গানের শেষদিকে দুদল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপস্থিত বুদ্ধিমতো প্রশ্নোত্তর কাটাকাটি করে, যাকে বলা হয় ‘জোটক’। এ অংশটি মূলত কবিগানেরই অনুরূপ।
পুরুষদের মতো মেয়েদেরও জারিয়াল দল আছে। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামে মুহররমের একাদশ ও দ্বাদশ দিবসে মেয়েরা জারি গান পরিবেশন করে। পূর্ব ময়মনসিংহে জারিগানের পাশাপাশি জারি নৃত্যেরও প্রচলন আছে। গুরুসদয় দত্তের একটি প্রবন্ধে এরূপ জারি নৃত্যের সচিত্র বর্ণনা পাওয়া যায়। জারি নৃত্যের এ ধারা এখনও বজায় আছে। নৃত্য সহকারে পরিবেশিত এ জারি গানে আসামের বিহু উৎসবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিহু উৎসবে নাচতে নাচতে কিছুক্ষণ পরপর ডাইনা (মূল গায়ক?) ‘লাল-গো-লাল’ বলে যে ধ্বনি দেয় তাঁর উত্তরে অংশগ্রহণকারী সকলে সমবেতভাবে বলে ওঠে ‘বিহু লাল’। এ থেকেই বিহু উৎসব নামকরণ হয়েছে।
জারি গান পরিবেশনায় ঝিনাইদহের পাগলা কানাই ছিলেন প্রবাদতুল্য। পরবর্তীকালে আবদুল মালেক দেওয়ান, আবদুল খালেক দেওয়ান, আবদুল গণি বয়াতি, দারোগ আলী বয়াতি, সাই আলী বয়াতি, আববাস আলী ভাসান, মোহাম্মদ আলী আকবর মিয়া প্রমুখ বয়াতি জারি গানের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। [মোমেন চৌধুরী]
আরও দেখুন লোকসাহিত্য।
গ্রন্থপঞ্জি জসীমউদ্দীন, জারীগান, কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, ১৯৬৮; এস.এম লুৎফর রহমান, বাংলাদেশী জারীগান, ঢাকা, ১৯৮৬; Mary Frances Dunhan, Jarigan : Muslim Epic Songs of Bangladesh, The University Press Limited, Dhaka, 1997.