চৌধুরী, নীরদচন্দ্র
চৌধুরী, নীরদচন্দ্র (১৮৯৭-১৯৯৯) পন্ডিত ও লেখক। জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলায়। ‘নীরদ সি চৌধুরী’ নামে সমধিক পরিচিত নীরদচন্দ্র তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর জন্য বিশেষত বিদেশে নন্দিত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সমাপনের পর তিনি সরকারি চাকুরে হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অতঃপর তিনি বেতার ঘোষক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আকাশবাণীতে (All India Radio) কাজ করার জন্য ১৯৪২ সালে দিল্লি যান। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহচর নীরদচন্দ্র কলকাতায় থাকাকালে কিছুদিন শরৎচন্দ্র বসুর সচিব হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান প্রকাশ করেন, যা তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দেয়। ভারতে অটোবায়োগ্রাফি গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলেও এর কারণেই ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (BBC) নীরদচন্দ্রকে ১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ড সফরের আমন্ত্রণ জানায়।
তাঁর এই সফরকে ভিত্তি করেই তিনি রচনা করেন এ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড গ্রন্থটি। এতে তিনি ব্রিটিশ জীবন-যাপন পদ্ধতি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি ও সভ্যতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে তিনি স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন।
নীরদ চৌধুরী তাঁর অটোবায়োগ্রাফি গ্রন্থটি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মরণে উৎসর্গ করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষের জনগণ প্রজার খেতাব পেলেও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পায়নি। তাই নীরদ চৌধুরীর উপরিউক্ত গ্রন্থে ‘আমি ব্রিটিশ নাগরিক’ (Civis Britannicus sum) এই উক্তিকে প্রায় প্রত্যেক সমালোচকই চ্যালেঞ্জ করেন। নীরদ চৌধুরী তাঁর লেখনীতে ভারতবর্ষের যা কিছু ভাল, যা এ দেশের মানুষের জীবন-পদ্ধতিকে উন্নত করেছে, জীবনধারায় গতি এনেছে বা প্রগতিকে দ্রুততর করেছে, তার সবকিছুকেই ব্রিটিশ শাসনের সুফল বলে দাবি করেন। ব্রিটিশদের প্রতি এই অনুরাগ ও প্রশংসা তাঁকে ভারতীয়দের কাছে বিতর্কিত এবং অপ্রিয় করে তোলে।
অটোবায়োগ্রাফি গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি আকাশবাণীর চাকরি হারান। তখন থেকেই প্রতিটি লেখায় তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। প্রথমদিকে তাঁর লেখাগুলিকে সমালোচক ও পাঠকরা যাচ্ছে-তাই বলে অভিহিত করেন; পরে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন; কেউ কেউ তাঁকে শেষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বলেও অভিহিত করেন।
এসব সমালোচনার জবাবে তিনি বলতেন, তিনি যে ব্রিটিশদের সমালোচনাও করেছেন তা তাঁর দেশবাসী বুঝতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে তাঁর ব্রিটিশ প্রকাশকরা অটোবায়োগ্রাফি গ্রন্থটি পুনঃপ্রকাশ করে এবং এবারও তারা একে বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করে; তবে উৎসর্গের স্থান থেকে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মরণে উৎসর্গ করা হলো’ এই কথাগুলি বাদ দেয়।
নীরদ চৌধুরীর লেখা ছিল চমৎকার বর্ণনাধর্মী, পরিমিত ও যথাযথ। অটোবায়োগ্রাফির প্রথম কয়েকটি অধ্যায়ে তিনি উনিশ শতক থেকে বিশ শতকে পরিবর্তনকালে ব্রিটিশ শাসনাধীন গ্রামবাংলায় কীভাবে বেড়ে উঠেছেন তার সাবলীল বর্ণনা দিয়েছেন। এটি মূলত তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথা, পারিবারিক কাঠামো, বর্ণপ্রথা, হিন্দু-মুসলিম এবং ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যকার সম্পর্কের একটি জীবন্ত ও অন্তর্বিশ্লেষণমূলক বর্ণনা।
নীরদ চৌধুরী নববই বছর বয়সে দাই হ্যান্ড, গ্রেট অ্যানার্ক শিরোনামে তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনী রচনা করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি থ্রি হর্সমেন অব দি নিউ অ্যাপক্যালিপস শিরোনামে তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি ভারতের ব্যর্থ নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করেন। তাঁর রচনায় তাঁকে আশ্রয়দানকারী দেশের সীমা সংকুচিত হওয়ায় শোক প্রকাশ পেয়েছে। নীরদ চৌধুরী ১৯৬৮ সালে বাঙ্গালী জীবনে রমণী শিরোনামে তাঁর প্রথম বাংলা বই প্রকাশ করেন।
ডাফ কুপার মেমোরিয়াল পুরস্কার (১৯৫৬), আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৯), বিদ্যাসাগর পুরস্কার (১৯৯৭) ইত্যাদিসহ নীরদচন্দ্র চৌধুরী অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৮৯ সালে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। নীরদচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তাঁর সমুদয় পুস্তক ও চিত্রকর্ম ক্যালকাটা ক্লাবকে দান করেন। ক্লাব উক্ত দ্রব্যাদি দিয়ে ‘নীরদ চৌধুরী কর্নার’ স্থাপনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি মরণোত্তর সম্মান প্রদর্শন করে। [সৈয়দা মমতাজ শিরিন]