চুনাপাথর

চুনাপাথর (Limestone)  এক প্রকার পাললিক শিলা যা প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দ্বারা গঠিত। প্রকৃতিতে ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট সহযোগে অথবা ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেটের উপস্থিতি ব্যতীত খনিজ ক্যালসাইট হিসেবে চুনাপাথর পাওয়া যায়। গৌণ উপাদানের মধ্যে চুনাপাথরে সাধারণত সিলিকা, ফেল্ডস্পার, কর্দম, পাইরাইট ও সিডারাইট উপস্থিত থাকে। জৈব অথবা অজৈব উভয় প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর গঠিত হতে পারে। অধিকাংশ চুনাপাথরই উচ্চমাত্রায় জীবাশ্মসমৃদ্ধ (fossiliferous) এবং সুস্পষ্টভাবে প্রাচীনকালের ঝিনুকরাজি অথবা প্রবাল বলয়ের সঞ্চয়নকে উপস্থাপন করে থাকে। সিমেন্ট তৈরির প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে চুনাপাথর।  কাগজ, স্টীল, চিনি, কাচ ও চুন তৈরিতেও এটি ব্যবহূত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চুনাপাথরের ভূ-পৃষ্ঠীয় (surface) এবং অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠীয় (sub-surface) বা ভূগর্ভস্থ উভয় প্রকার মজুত রয়েছে।  কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনস দ্বীপ এবং  সুনামগঞ্জ জেলার ভাঙ্গেরঘাট-লালঘাট-টাকেরঘাট এলাকায় চুনাপাথরের ভূ-পৃষ্ঠীয় ও ভূ-পৃষ্ঠের স্বল্পগভীরতায় মজুত রয়েছে।  জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাটে রয়েছে চুনাপাথরের অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠীয় বা ভূগর্ভস্থ মজুত। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বিরাজমান চুনাপাথর নবীন প্লাইসটোসিন (Late Pleistocene) সময়কালের এবং উপরে উল্লিখিত অন্যান্য স্থানের মজুতগুলি ইয়োসিন যুগীয়। সীতাকুন্ডের ভূ-পৃষ্ঠীয় চুনাপাথর নবীন মায়োসিন যুগীয় বলে ধারণা করা হয়।

চুনাপাথর, সীতাকুন্ড

বাংলাদেশে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ১৯৫৭ সালে সর্বপ্রথম চুনাপাথরের মজুত আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে, পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর বা জি.এস.পি (বর্তমানে  বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর বা জি.এস.বি) ১৯৫৮ সালে এ মজুত এলাকায় জরিপ কার্য পরিচালনা করে এবং প্রায় ০.০৬ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে ১.৮ মিলিয়ন টন ঝিনুক খোলস (shelly) ও প্রবালসমৃদ্ধ (coralline) চুনাপাথরের মজুত সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তবে আবিষ্কৃত এ চুনাপাথর উন্নত মানের নয়। সুনামগঞ্জ জেলার টাকেরঘাটে ১৯৫১ ও ১৯৫৭ সালের মধ্যে চুনাপাথরের কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মজুত পাওয়া যায়। জি.এস.পি এ সকল মজুতের বিস্তৃতি অনুসন্ধানের জন্য ১৯৬১ সালে টাকেরঘাট এলাকায় খননকার্য পরিচালনা করে এবং ৬৬টি  কূপ খননের মাধ্যমে জেলার বাগালিবাজার-টাকেরঘাট-ভাঙ্গেরঘাট এলকায় চুনাপাথরের বিস্তৃতি খুঁজে পায়।

বাগালিবাজারে খনির অবস্থান ভূ-পৃষ্ঠের ৩০ থেকে ১০০ মিটার গভীরে। খনির গড় পুরুত্ব ১৫২.২ মিটার এবং প্রায় ০.৭৭ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত খনিতে ১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন চুনাপাথর মজুত রয়েছে। লালঘাটে ভূ-পৃষ্ঠের ৬ থেকে ১০ মিটার গভীরতায় রয়েছে চুনাপাথরের অবস্থান। খনির পুরুত্ব ২২ মিটার থেকে ৭৬ মিটার পর্যন্ত এবং প্রায় ০.২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত খনিতে চুনাপাথরের মজুত ৯.৮ মিলিয়ন টন। টাকেরঘাটে ভূ-পৃষ্ঠের ৭ মিটার থেকে ৫৭ মিটার গভীরতায় চুনাপাথর খনি অবস্থিত। এ খনির পুরুত্ব ২.৮ মিটার থেকে ৪৪ মিটার পর্যন্ত যার বিস্তৃতি প্রায় ০.০৪২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী। টাকেরঘাটের খনিতে চুনাপাথরের অনুমিত মজুত ২.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ভাঙ্গেরঘাটে ভূ-পৃষ্ঠের ২৯ মিটার গভীরে চুনাপাথর পাওয়া গিয়েছে। প্রায় ০.০১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং ২১ মিটার থেকে ৩৭ মিটার পুরুত্ববিশিষ্ট এ চুনাপাথর খনিতে মজুতের পরিমাণ ১ মিলিয়ন টন। ১৯৮২ সালে জিএসবি বাগালীবাজারে আরও ৫টি কূপ খনন করে এবং এ কূপসমূহের ওপর ভিত্তি করে ভূ-পৃষ্ঠের স্বল্প গভীরতায় চুনাপাথরের আরও মজুত প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে চুনাপাথর উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। এ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে ছাতকে অবস্থিত ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে সরবরাহের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে চুনাপাথর আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন টাকেরঘাটের চুনাপাথর খনি থেকে চুনাপাথর উৎপাদন করে তা ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে সরবরাহ করা শুরু করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এ খনি থেকে প্রায় ০.৬১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন চুনাপাথর উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে টাকেরঘাটের মজুত প্রায় শূন্যের কোঠায়, নতুন মজুত আবিষ্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও সিলেটের  ডাউকি নদী এলাকায় চুনাপাথরের একটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় রয়েছে। স্থানীয় জনগণ কর্তৃক আহরণের দরুন এ সঞ্চয়ও বর্তমানে প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার পথে।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ চুনাপাথরের সঞ্চয় আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৯ সালে। আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি  বগুড়া জেলার কুচমাতে তেল অনুসন্ধান কূপ খননকালে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৯৬৭ মিটার নিচে সর্বপ্রথম এ চুনাপাথর স্তরের সন্ধান পায়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে জিএসপি ইউ.এন-পাক (UN-PAK) মিনারেল সার্ভে প্রকল্পের অধীনে এ এলাকায় বিস্তারিত ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থগত জরিপকার্য পরিচালনা করে ইয়োসিন সময়ের চুনাপাথর স্তর আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়। এতদঞ্চলে কূপ খনন করা হলে  নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ৩৩০ মিটার গভীরতায়, জয়পুরহাট জেলার পাহাড়পুরে ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ৪৯৫ মিটার গভীরতায় এবং জয়পুরহাট-জামালগঞ্জ এলাকায় ভূ-পৃষ্ঠের নিচে ৫১৭ মিটার থেকে ৫৪৮ মিটার গভীরতায় চুনাপাথরের স্তর প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। ১৯৬৬ সালে জার্মানির ফ্রাইড ক্রুপ রোসটফ (Fried Krupp Roshtoff) নামক খনি পরামর্শক কোম্পানি খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে এবং তারা তাদের প্রদত্ত রিপোর্টে জয়পুরহাটে একটি ভূগর্ভস্থ চুনাপাথর খনি ও তার সঙ্গে একটি সিমেন্ট কারখানা স্থাপন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে বলে মত প্রকাশ করে। এ মতামতকে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্যের পাওয়েল ডফরিন টেকনিক্যাল সার্ভিসেস (Powell Doffryn Technical Services) পরামর্শক দলকে নিয়োগ করা হলে তারাও এ ব্যাপারে একই রকম মত প্রকাশ করে। দু’দফায় ইতিবাচক মতামত পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জয়পুরহাট চুনাপাথর খনি ও সিমেন্ট প্রকল্প গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্যয়সাধ্য বরফীকরণ পদ্ধতিতে খাড়া খনন শ্যাফট তৈরি করার মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের প্রকল্প অনুমোদন করে। জিএসবি ১৯৭৮ সালে প্রস্তাবিত খনি এলাকায় দুটি কূপ খনন করে ৬.৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২৭০ মিলিয়ন টন চুনাপাথর রয়েছে বলে হিসাব করতে সমর্থ হয় যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুত ১০০ মিলিয়ন টন। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের সিমেন্টেশন মাইনিং লিমিটেড (Cementation Mining Ltd) নামক সংস্থা খনি এলাকার ভূগর্ভস্থ তাপমাত্রা হিসাব করে এ মর্মে মত প্রকাশ করে যে, এ তাপমাত্রা সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাভাবিক গভীরতা নতিমাত্রা তাপমাত্রার (general depth gradient temperature) তুলনায় সামান্য বেশি যার ফলে খনি শ্যাফট নির্মাণে বরফীকরণ পদ্ধতির ব্যয় অনুমিত ব্যয়ের তুলনায় অধিক হবে এবং খনিটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। এ প্রতিষ্ঠানের মতামত পাওয়ার পর জয়পুরহাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। জিএসবি তুলনামূলক কম গভীরতা থেকে চুনাপাথর পাওয়ার আশায় ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে পুনরায় দুটি কূপ খনন করে, তবে এ প্রচেষ্টা সফল হয় নি। [কিউ.এম আরিফুর রহমান]