গ্র্যান্ট, চার্লস
গ্র্যান্ট, চার্লস (১৭৪৬-১৮২৩) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, রাষ্ট্রনায়ক, প্রাচ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্যোক্তা। পার্বত্য অঞ্চলবাসী চার্লস গ্র্যান্ট ১৭৬৭ সালে বাংলায় আগমন করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে একজন চুক্তিবদ্ধ গোমস্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। সময়ের বিবর্তনে তিনি পরবর্তীকালে মালদায় বাণিজ্যিক আবাসে বোর্ড অব ট্রেড এর সচিব, উর্ধতন ব্যবসায়ী এবং সবশেষে বোর্ড অব ট্রেডের সদস্যপদ লাভ করেন। চার্লস গ্র্যান্ট ছিলেন ভারতে প্রচুর ধনসম্পদ আহরণকারী সেইসব ইউরোপীয়দের মধ্যে একজন যারা বাংলায় প্রচুর অর্থসম্পদ গড়ে তুলে দেশে ফিরে যান এবং সংসদীয় ও অন্যান্য প্রতিপত্তিশালী অবস্থান দখল করে তাদের সে সম্পদকে ক্ষমতায় রূপান্তর করেন। তিনি ১৭৯০ সালে দেশে ফিরে যান এবং ১৮০২ সালে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এর পরিচালক (১৮০৪) এবং পরে চেয়ারম্যান (১৮০৫) নির্বাচিত হন। তিনি ব্রিটিশ বাইবেল সোসাইটি, ফরেন বাইবেল সোসাইটি এবং প্রপ্যাগেশন অব গসপেল অ্যান্ড চার্চ মিশনারি সোসাইটির মতো খ্রিস্টান সংস্থাগুলির উন্নতি বিধানে কাজ করেন।
চার্লস গ্র্যান্ট বিখ্যাত ক্লাপহাম (Clapham) ধর্মীয় গোষ্ঠীর একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। এটি ছিল একটি দার্শনিক ও খ্রিস্টীয় দল। Zachary Macaulay, the Thorntons, John Venn, John Shore ‰es Wilberforce-এর মতো দার্শনিক ও বিখ্যাত ব্যক্তি এ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ গোষ্ঠীর বহু সংস্কার চিন্তা গ্রান্টের মাথা থেকে আসে। তার প্রস্তাব অনুসারে ভারতে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। ১৭৯২ সালে গ্র্যান্ট Observation on the State of Society among the Asiatic Subjects of Great Britain শিরোনামে একটি পুস্তিকা লিখেন এবং তা কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স, বোর্ড অব কন্ট্রোল ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করেন। এ পুস্তিকার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ভারতে মিশনারিদের আগমনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কোম্পানিকে রাজি করানো। পুস্তিকায় গ্র্যান্ট ভারতীয় সমাজকে শুধু ম্লেচ্ছ হিসেবেই নয়, উপরন্তু অনৈতিক, মিথ্যাবাদী, দুর্নীতিপরায়ণ, লম্পট, অপব্যয়ী, দুশ্চরিত্র, কামুক ও দুর্বৃত্ত হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেন। তিনি যুক্তি দেখান যে, ভারতীয় সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের জটিল আবর্ত থেকে উদ্ধার করার নৈতিক দায়িত্ব কোম্পানি সরকারের। তিনি বলেন কোম্পানি সরকার যদি খ্রিস্টান মিশনারিদের ভারতে তাদের কাজকর্ম পরিচালনার অনুমতি দেয় তাহলে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। মিশনারিদের পক্ষে গ্রান্টের অব্যাহত আলাপ-আলোচনার ফলেই কোম্পানি এবং সংসদ ভারতে ইউরোপীয় মিশনারিদের (১৮১৩) খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
ভারতে ব্রিটিশ উপস্থিতির ব্যাপারে চার্লস গ্রান্টের ধারণা লর্ড ওয়েলেসলীর ধারণার চাইতে আলাদা ছিল। ওয়েলেসলী ভারতে ব্রিটিশ স্বরাজ্য গড়ে তুলতে বাস্তব একীভূত করার পক্ষে ছিল। সংসদ সদস্য এবং কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স-এর চেয়ারম্যান চার্লস, ওয়েলেসলীর দখল করার নীতির বিরোধী ছিলেন। ওয়েলেসলীকে অভিযুক্ত করতে উদ্যোগী সংসদ সদস্যদের পক্ষ নেন চার্লস। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ওয়েলেসলীরফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রকল্প অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানান। এর পরিবর্তে তারা কোম্পানির অসামরিক লোকজনের শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে অনুরূপ কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। ওয়েলেসলীর বড়লাটের মেয়াদ শেষ হলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রকল্প বাতিল, হেইলিব্যারীতে (ঐধুষবনঁৎু) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভারতে মিশনারিদের অনুমোদনের ব্যাপারে চার্লস গ্র্যান্ট কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ও সংসদে প্রত্যক্ষ ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। গ্রান্টের ধারণা ছিল আদর্শিকভাবে ভারত জয় করা, রাজনৈতিকভাবে নয়। [সিরাজুল ইসলাম]