নৃত্যকলা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৪৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

নৃত্যকলা  নৃত্য মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি। নৃত্য প্রদর্শনী দেখলে মানুষ তার যোগাযোগের বিভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে তুলনা করে। কেননা নৃত্য এবং ভাষা কাজ করে একসূত্রে। নৃত্যের বিবর্তনকে চার ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে : প্রাচীন বাঙলার নাট্য ও সাহিত্যে নৃত্য প্রসঙ্গ, মধ্যযুগে বাংলার নৃত্য, উপনিবেশিক সময় এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নৃত্যচর্চা।

প্রাচ্যদেশে নৃত্যকলার বিকাশ হয়েছে তিনটি উপায়ে; যথা—নাট্য, নৃত্ত এবং নৃত্য। নাট্য—(নাটক) হলো কথা ও অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে ভাব ব্যক্ত করা। নৃত্ত—(তালাশ্রয়) ভাবাভিনয় বর্জিত তাল ও লয়যোগে নৃত্য উপস্থাপন। এবং নৃত্য—(ভাবাশ্রয়) লীলায়িত অঙ্গভঙ্গি, তাল ও লয়ের সংযোগে প্রদর্শিত হয়। প্রাচীন নৃত্যকলাকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা যায়—ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নৃত্য, শাস্ত্রীয় নৃত্য এবং লৌকিক নৃত্য। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নৃত্য হলো লঘু নৃজাতির পার্বনিক নাচ। শাস্ত্রীয় নাচের পদ্ধতিগত ব্যাকরণ থাকে যা আনুষ্ঠানিকভাবে চর্চা হয়। অন্যদিকে লৌকিক নৃত্যের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনোরঞ্জন করা। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মতো লৌকিক নৃত্যে অনমনীয় কোনো পদ্ধতি গড়ে ওঠে না। এছাড়া পৃথিবীর নানা দেশে আধুনিক ও সমকালীন নাচের চর্চা রয়েছে। এ নাচ প্রধানত সম্মেলক সৃষ্টি—এতে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাকরণ মানা হয় না।

হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত নৃত্য কলা

উপমহাদেশে, সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নিদর্শন হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো। এ দুটি সভ্যতায় সুদৃশ্য মূর্তি, মাটির পুতুল, মাটির ছাপের জন্তু-জানোয়ার অাঁকা সীলসহ বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত তামার তৈরি নৃত্যরত নারী-মূর্তি উপমহাদেশীয় নৃত্যকলার প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে। বৈদিক আর্যযুগে রচিত ‘ঋকবেদ’ (সবচেয়ে প্রাচীন), ‘যযুর্বেদ’, ‘সামবেদ’ ও ‘অর্থব্যবেদ’-এ নৃত্যের প্রমাণ লভ্য। ঋকবেদে ঊষা দেবীকে তুলনা করা হয়েছে নৃত্যশিল্পী হিসেবে। দেবরাজ ইন্দ্র নিজেই নৃত্যশিল্পী ছিলেন। অথর্ব্যবেদে কণ্ঠ, যন্ত্রসঙ্গীত ও নৃত্যের উল্লেখ রয়েছে। নৃত্যের ‘মার্গীয়’ ও ‘লৌকিক’ ধারার সূত্রপাত ঘটে সামবেদ থেকে।

পৌরাণিক যুগে, বাল্মীকি প্রণীত ‘রামায়ণ’-এর পৌরাণিক চরিত্র অপ্সরাগণ নৃত্য পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ধারণা করা হয়, রাম এবং রাবণ উভয়ই নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন। তবে রামায়ণে ‘নাটক’ এবং ‘নৃত্য’কে পৃথক করে দেখা হতো। ব্যাসবেদ সংকলিত ‘মহাভারত’-এ উল্লেখ্য ঘৃতাচি, মেনকা, রম্ভা, স্বয়ম্প্রভা, উর্বশী এবং মিশ্রকেশী ছিলেন অপ্সরা। তাদের ছিল নর্তনশালা। উক্ত গ্রন্থে আরও আলোচিত হয়েছে গায়ক, নৃত্যশিল্পী, বাদক, স্ত্ততি, দেবদুন্দুভি, শঙ্খ, বীণা, বেণু, মৃদঙ্গ, তাল ও লয় প্রসঙ্গ।

পরে জিনসেন হরিবংশ সংকলিত ‘হরিবংশ পুরাণ’-এ (আ.স. ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ‘রাস’, ‘ছালিক্য’ ও ‘আসারিত’ প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে। উল্লিখিত ‘রাস’ মণিপুরী নৃত্যধারার অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত।

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনি রচিত ‘পারাশর্যশিলালিভ্যাং ভিক্ষুনটসূত্রয়োঃ’ এবং কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ নট ও নটীর শরীরী অভিনয়, সঙ্গীত এবং নৃত্য প্রসঙ্গ উল্লেখ হয়েছে। ওই সময় নারীদের দ্বারা নাট্য এবং নৃত্য মঞ্চায়িত হতো। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা ছিল। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ (আ.স. খ্রিস্টপূর্ব ২০০) মতে, চৌষট্টি কলার মধ্যে কমপক্ষে আটটি কলা সঙ্গীত ও নৃত্যের সঙ্গে যুক্ত। যথা—গীত, নৃত্য, বাদ্য, নাট্য, আলেখ্য, নেপথ্য প্রয়োগ, ছন্দোজ্ঞান, ব্যয়ামিকী বিদ্যাজ্ঞান।

ক্লাসিক্যাল যুগে, ভরতমুণির ‘নাট্যশাস্ত্র’-এ নৃত্য ও নাট্যের বৈয়াকরণিকরূপ স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে নন্দীকেশ্বর প্রণীত ‘অভিনয়দর্পণ’ (ত্রয়োদশ শতাব্দী) এ শুদ্ধ নৃত্য (নৃত্ত) এবং অভিনয়ের (নৃত্য ও অভিনয়) বিবরণ লভ্য।

সোমপুর বিহারের মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ফলক

প্রাচীন নৃত্যকলার আরও প্রমাণ মেলে শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ গ্রন্থে। সেখানে ‘কাংসতাল’ বা ধাতুনির্মিত করতাল বাজিয়ে মঞ্চে প্রবেশের বর্ণনা রয়েছে। জয়সেনার ‘নৃত্যরত্নাবলী’ এবং ভজনাচার্য্য সুধাকলার ‘সঙ্গীত উপানিষৎ স্বরধারা’ জৈন সঙ্গীত এবং নৃত্য সাহিত্যের ঐতিহ্য বহন করে। উড়িষ্যার মহেশ্বর মহাপাত্রের ‘অভিনয়চন্দ্রিকা’, পন্ডিত রঘুনাথের ‘সঙ্গীত দামোদর’ এবং গজপতি নারায়ণ দেবের ‘সঙ্গীত নারায়ণ’, আসাম অঞ্চলে প্রাপ্ত পন্ডিত শুভঙ্করের ‘শ্রীহস্ত মুক্তাবলী’, রাজস্থানের কুম্ভকর্ণের ‘নৃত্যরত্নকোষ’ এবং মধ্যভারতের মহম্মদ শাহ কৃত ‘সঙ্গীত মল্লিকা’ গ্রন্থে নৃত্যের নানা নিদর্শন পাওয়া যায়।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে বর্ণিত ডোম্বীরা ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী। চর্যাপদে প্রাচীন বাংলার বাদ্যযন্ত্র একতারা, হেরুক, বীণা, ডমরু, ডমরুলি, বাঁশি, মাদল, পটহ-এর কথা স্থান পেয়েছে। বীণাপা (নবম শতক) রচিত ১৭ সংখ্যক চর্যায় বজ্রাচার্যের নৃত্য প্রদর্শন ও বুদ্ধনাটকের কথা উল্লেখ হয়েছে।

প্রাচীনকালে নাট্যমাত্রই নৃত্য আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। বুদ্ধনাটক বা তুম্বুরু নাট্যে—নৃত্য ছিল এ অনুমানে বাধা নেই। সেকালের নৃত্য বা নাট্যের অভিনয়, আহার্য প্রভৃতি ‘লোকায়ত ধারা’র পরিচয় পাওয়া যায় পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে। কাহ্নুপা রচিত ১০ সংখ্যক পদে একটি পদ্ম ফুলের চৌষট্টি পাপড়ির উপর নৃত্যপটিয়সী ডোম্বীর নৃত্যের কথা উল্লেখ হয়েছে, যার প্রামাণিক চিত্র আজও পাহাড়পুরে রয়েছে। ওই টেরাকোটা চিত্রে কান, গলা, হাত ও পায়ে নানা অলঙ্কার পরিহিত নৃত্যকী দৃশ্যমান। সেখানে নৃত্য পরিবেশনার জন্য দু’টি কক্ষের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছে। চর্যা রচয়িতাদের মধ্যে অন্তত দুইজন পদকর্তা ভিক্ষু বা সিদ্ধাচার্য হিসেবে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করেছিলেন।

চর্যাপদের কালেই (৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন বাংলার নৃত্য, গীত ও নাট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাঙালির নৃত্যকলার কোনো লিখিত শাস্ত্র নেই। বাংলার নৃত্য ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, নৃত্যশৈলী, বিষয়-বৈভব, পরিবেশনারীতির বিস্তৃত প্রমাণ মেলে প্রচলিত বিভিন্ন উপাখ্যান, দেবদেবীর কৃত্যে, পীর-ফকিরদের আসরকেন্দ্রিক বর্ণনা ও গীত উপস্থাপনায়। ওই সময় নাথপন্থীদের সর্বপ্রাণবাদী সূত্র ধরে বাংলায় গোর্খনৃত্যের উদ্ভব। এ নৃত্যের বিষয় ছিল গুরুশিষ্যের লীলাভিনয়। গোর্খনৃত্য মূলত পায়ের আঙুলের ওপর ভর করা নৃত্যকৌশল। এ কৌশল দেখা যায় ভরতনাট্যম নৃত্য পরিবেশনকালে বিভিন্ন করণ উপস্থাপনায়। গোর্খনৃত্যে মাদল ও আহার্যাভিনয়ে ঘাঘরি ব্যবহূত হতো। ঘাঘরি মূলত রাজস্থানের নারীদের পোশাক। কত্থক নৃত্যে ঘাঘরি পরিধেয় হিসেবে ব্যবহূত হয়।

বাংলায় শিবনৃত্যের পরিচয় পাওয়া যায় ‘গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাসে’। প্রাচীনকালে মন্দির প্রাঙ্গনে শিব এবং গৌরী ভূত, পিশাচের মুখোশসহযোগে নৃত্যলীলায় মত্ত হতো। চৈত্রসংক্রান্তি বা সূর্যপূজা উপলক্ষে ঢাক বাদনসহ শিবের তান্ডব নাচ আজও গ্রাম বাংলায় প্রচলিত। ‘গম্ভীরা’ শিবোৎসবের অন্যতম অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচ্য। গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাসে বাংলার ‘বিদ্যাধরী নৃত্য’র তাল, লয়, বাদ্যযন্ত্র, আঙ্গিকাভিনয় ও রস নিষ্পত্তির কৌশলসহ মঞ্চসজ্জার বিবরণ পাওয়া যায়। ‘বিদ্যাধরী’ হলো স্বর্গের নৃত্যপটিয়সী। তাঁরা মূল্যবান পাট করা শাড়ি পরে বাম হাতে সোনার বাটা, ডান হাতে সোনার ঝাড় ও গলায় মালা সহকারে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করতেন। তাঁদের ঠোঁট লাল বর্ণে রঞ্জিত থাকতো।

হলায়ূধ মিশ্র কৃত ‘সেক-শুভোদয়া’ গ্রন্থে প্রাচীন ভাদু গানের উল্লেখ রয়েছে। শূণ্যপুরাণ বাংলা পাঁচালি ধারার প্রথম কাব্য। এখানে পাঁচালীরীতির পরিবেশনায় ‘দেবস্থানে’ শিবের নৃত্যচর্চার কথা বলা হয়েছে। শিবের নৃত্য সহকারে গান প্রাচীন বাংলার নিজস্ব ‘নাটগীত’। ‘নাটগীত’ মূলত সুর-তাল-লয়ে নৃত্যাভিনয়।

দ্বাদশ শতকে বাংলায় নারদ নৃত্য প্রচলিত ছিল। কৌতুকাশ্রিত নারদনৃত্য পরিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল লোকরঞ্জন করা। নারদ ঢেঁকির পিঠে চড়ে যাগেশ্বর বা শিবের উদ্দেশে গমন করে। তার নৃত্য ‘তেঠঙ্গ’ বা ‘ত্রিভঙ্গ’, কণ্ঠে ব্যাঙের ডাক (তেঠঙ্গ হইয়া জাঅ/ভেকর সঙ্গীত গাঅ) থাকবে। শূণ্যপুরাণের ধারায় ‘ধর্মমঙ্গল’ হরিশ্চন্দ্র নৃত্যের কথা জানা যায়। জয়দেব কৃত (১২ শতক) ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের অভিনয় ও নৃত্য ছিল রাগ, রাগিণীনির্ভর। জয়দেব এবং তার স্ত্রী পদ্মাবতী দুজনই নৃত্য-গীতিতে পারদর্শী ছিলেন।

মধ্যযুগে শিবভক্তদের দ্বারা পরিবেশিত বীররসাশ্রিত ছৌ-নৃত্যের প্রচলন ছিল। নৃত্য পরিবেশনকালে শিল্পী বাঁদর, ভাল্লুক, গরুর মাথা সদৃশ মুখোশ পরতো। ছৌ-নাচে গণেশ অন্যতম পূজ্য দেবতা। দুর্গা নৃত্য, মহিষাসুর বদ, কিরত-অর্জুনের যুদ্ধ, বালি বধ প্রভৃতি আখ্যানকে কেন্দ্র করে পরিবেশিত হয় ছৌ-নৃত্য। এর গানের ঢঙ ঝুমুর প্রকৃতির। ঝুমুর এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাওতাঁল, ওঁরাও এবং মাহালীদের সোইরাই, বাহা ও জিতিয়া উৎসবের প্রধান সুর। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যেমন বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবিত কিছু রাগ গৃহীত হয়েছিল, তেমনি ভাবা যায়, নৃত্যের ক্ষেত্রে সেরূপ কিছু শাস্ত্রীয় নৃত্যেরও সৃষ্টি হয়েছিল, যা কালপর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গীতের সমান্তরাল নৃত্য, কাজেই বাঙালির শাস্ত্রীয় রাগের সঙ্গে নিজস্ব ঘরানার শাস্ত্রীয় নৃত্যের অস্তিত্বের ধারণা অবাস্তব কিছু নয়। সুতরাং ‘বুদ্ধ’ বা ‘নৈরামণী নৃত্য’, ‘পাখুড়ি নৃত্য’, ‘বিদ্যাধরী নৃত্য’, ‘গোর্খনৃত্য’, ‘রামায়ণ নৃত্য’, ‘শিবনৃত্য’ প্রভৃতি বাংলার নিজস্ব শাস্ত্রীয় ধারার নৃত্য।

চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে, বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ত্রয়োদশ খন্ডে বিভক্ত সুবৃহৎ আখ্যানকাব্য। রসাশ্রয়ী ও বর্ণনামূলক কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ধামালী এবং ঝুমুর গানের প্রভাব বিদ্যমান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাটগীতরূপে অভিনীত হওয়ার সময় বহুস্থানে নৃত্যের অবতারণা ঘটে। কৃত্তিবাস (১৩৯৮-১৪০০) কৃত ‘রামায়ণ’ ও মালাধর বসু (১৪৩৭-১৪৮০) প্রণীত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এ ‘দরবারি নৃত্য’র কথা জানা যায়। যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ধ্রুপদ অর্থাৎ ধুয়ার ব্যবহার হত। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে ‘রামায়ণ নাটের’ নানা কাহিনী নৃত্যনাট্যরূপে পরিবেশনের বিবরণ রয়েছে। রামায়ণ নাট্যে আঙ্গিক, বাচিক, সাত্ত্বিক এবং আহার্য অভিনয়ের বর্ণনা ছাড়াও ‘ভদ্রনাট’ নামে এক নৃত্য বিশারদের নাম পাওয়া যায়।

নৃত্য পোড়ামাটির ফলক, চন্দ্রকেতুগড় (খ্রি.পূ ১ শতক)

বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’ বা ‘মনসামঙ্গল’ (১৪৮৪-১৪৮৫) কাব্যে স্বর্গসভায় বেহুলার নৃত্যের একটি পর্ব ছিল ‘কাঁচাসরা নৃত্য’। নৃত্যস্থলে কাঁচা সরা বিছিয়ে নৃত্যকী (নারী নৃত্যশিল্পী) সরার উপরে উঠে সরা থেকে সরায় গমনসহ বিভিন্ন নৃত্যক্রিয়া প্রদর্শন করে। কাঁচা সরা অত্যন্ত ভঙ্গুর মৃৎপাত্রের ঢাকনি। রোদে শুকিয়ে কাঁচা সরা আগুনে পোড়ানো হয়। নৃত্যশিল্পী নৃত্য পরিবেশনকালে শরীরের ওজন শূন্য করে নৃত্যে তার দক্ষতা প্রমাণ দিতেন। বেহুলার নৃত্যের রূপসজ্জার উপকরণ ছিল-চাকিকোড়ি, মকরকুন্ডল (কর্ণাভরণ), বেসরফুল (নাসিকা), কাঁচুলী (বুকে), প্রবালমালা (কণ্ঠদেশে), কনককঙ্কণ হার (হাতে), কেজুর (বাহুতে), আঙ্গুরী (আঙ্গুলে), নূপুর (পায়ে), গুজরাটি ঘুঙুর (পায়ে), মেঘডম্বুর শাড়ি (বস্ত্রসজ্জা), কুসুম উড়ানি (মসলিনের আবরণ)। ‘গুজরাটি ঘঙ্গুর’ কথাটা থেকে বোঝা যায় বাংলায় এক সময় গুজরাটি নৃত্যের প্রচলন ছিল।

মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গল’ এর পালাসমূহ অষ্টমঙ্গলারূপেই পরিবেশিত হতো। প্রতিটি পালার পদশীর্ষে পদ, বোলাম কথা, দিশা, নাচাড়ী (ও পুন নাচাড়ী) পরিবেশনা সঙ্কেত দেখা যায়। তবে মানিক দত্তের চন্ডীমঙ্গলে বর্ণনা, নৃত্য, দিশা ও উক্তি-প্রত্যুক্তির শ্রেণিভেদে পাঁচটি অঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়; কিন্তু সেখানে পাঁচালি, ভাবকলি, বৈঠকী, দাঁড়া ইত্যাদির নির্দেশ নেই। বৃন্দাবন দাস কৃত ‘চৈতন্যভাগবত’ (১৫৪৫ থেকে ১৫৫৩-৫৫ খ্রিস্টাব্দ) মতে-চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে বাংলায় বিচিত্রসব নৃত্যের সূচনা হয়। তারমধ্যে রুক্ষ্মিনীহরণ নাট্য, স্বানুভব নৃত্য অন্যতম।

পঞ্চদশ শতকে সাপের ভয় নিবারণের জন্য ডঙ্কনৃত্যের চর্চা হতো। ডঙ্কশিল্পীরা রূপসজ্জায় সাপের চিত্র, সর্পলেখা অঙ্কিত বা সাপের অনুকৃতি পরত। ডঙ্কনাট্যের অভিনয়স্থান ছিল গৃহ (মন্দির) অর্থাৎ গৃহাঙ্গন। এ নৃত্যে মৃদঙ্গ, মন্দিরা, তারবাদ্য (একতারা, দোতারা) ব্যবহূত হতো। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে প্রণীত। জয়ানন্দ কীর্তনকেন্দ্রিক নৃত্যকে বলেছেন ‘সংকীর্তন নাচ’। লোচনদাশের ‘শ্রী চৈতন্যমঙ্গল’-এ ‘রুক্মিনী নৃত্য’ যা প্রকারান্তরে গোপীকা নৃত্য’র বিবরণ রয়েছে। চৈতন্যদেবের কালে ‘জলনাট্য’ বা নৃত্যের প্রচলন ছিল।

নৃত্যরত নারী, পোড়ামাটির ফলক, পাহাড়পুর (৮-৯ শতক)

ষোড়শ শতকে দুঃখী শ্যামদাসের ‘গোবিন্দমঙ্গল’-এ ‘বড়ায়ি’ নাচের কথা বলা হয়েছে। ময়ূরভট্টর ‘ধর্মমঙ্গল’ (১৭১১-১৭১২) কাব্যে পাঁচালি নাট্যে ‘বেত্র নৃত্যের’ প্রসঙ্গ আছে। রামানন্দ যতি কৃত ‘চন্ডীমঙ্গলে’ (১৭৬৬) এ রত্নমালার নৃত্যের কথা বলা হয়েছে। রত্নমালা (স্বর্গের অপ্সরা) শঙ্খে ফুৎকার দিয়ে তান্ডবনৃত্য দেখাতেন। ‘অন্নদামঙ্গলে’ উল্লিখিত ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর নৃত্য যাত্রারূপে উপস্থাপিত হতো। শৃঙ্গার রসের বিদ্যাধরী নৃত্যের আরেক নাম ছিল ‘তাফানৃত্য’। ‘তাফা’ অর্থ অপ্সরা। এ সময় প্রণয়মূলক পাঁচালির উদ্ভব ঘটে। এ ধারার প্রথম কাব্য শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’য় জোলেখা আজিজের বিবাহোত্তর বিড়াম্বনায় নৃত্যগীতের উল্লেখ রয়েছে। দৌলত উজীর বাহরাম খান কৃত ‘লাইলী মজনু’ কাব্যে বিভিন্ন নৃত্য-গীত-নাট্যের উল্লেখ হয়েছে।

সপ্তদশ শতকে, কোরেশী মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যে ‘নাট’ প্রসঙ্গ রয়েছে। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাব্য আলাওল রচিত ‘পদ্মাবতী’ কাব্য। তিনি সঙ্গীত ও নাট্য বিশারদ ছিলেন। পদ্মাবতীর ‘শাস্ত্রের সওয়াল জিজ্ঞাসা’ অধ্যায়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ ‘দাক্ষিণাত্য’ নৃত্য এবং ‘চাচরি নৃত্য’র বর্ণনা বিদ্যমান।

অষ্টাদশ শতকে, ফকির মুহম্মদ-এর ‘মানিকপীরের পাঁচালি’ নৃত্যগীত আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। রাজশাহী অঞ্চলে মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে নৃত্যগীতি সহকারে মাদারপীরের জারি অনুষ্ঠিত হয়। এ নৃত্যগীততে মূল গায়েন ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করেন। কবি দোনাগাজীর ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান’ কাব্যে নৃত্যকীদের নৃত্য ও গীতি পরিবেশনার কথা জানা যায়। নারী শিল্পীরা নৃত্যব্যবসা ছাড়াও রাজ দরবারে শিক্ষকতা করতেন। আর ওই সময় সৃষ্টি হয় অপ্সরা, দেবদাসী, বারাঙ্গনা, বাইজি, নাচনী সম্প্রদায়। সৈয়দ হামযা কৃত ‘মধুমালতী’ কাব্যে রাজপুত্র মনোহরের সামনে নৃত্য ও নাটক পরিবেশিত হতো। এমনকি নাটগীত ও নৃত্য পরিবেশনার জন্য অর্থ-পুরস্কারেরও ব্যবস্থা ছিল।

উনিশ শতকে, পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলের পাশাপাশি ঢাকার জনপ্রিয় নাট্যগীতি ছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। ধনী বৈষ্ণব কীর্তনওয়ালী আনান। সম্ভ্রান্ত ধনীদের আসর জমতো বাইজি নাচে। ওই সময় ডঙ্ক কীর্তন বা বাইজির হাবভাবের সঙ্গে কীর্তন গানের প্রচলন ছিল। ঢাকায় হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-অষ্টমীর মিছিলে এবং অনুষ্ঠানে ভক্তরা নৃত্য পরিবেশন করতো। ঢাকায় প্রথমবারের মতো দরবারী নৃত্যের প্রবর্তন করেন সুবেদার ইসলাম খান। তাঁর দরবারে নিয়মিত নাচ-গানের আসর বসতো। এমনকি ইসলাম খার দরবারে ‘কাঞ্চনী’ নামে সহস্রাধিক নৃত্যশিল্পী ছিল। যাত্রার জন্যও ঢাকা ছিল বিখ্যাত। ‘সীতার বনবাস’ হলো ঢাকায় মঞ্চস্থ প্রথম যাত্রাপালা। যাত্রাপালায় নৃত্য পরিবেশনা ছিল অপরিহার্য। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে ফরাসিদের রঙমহলে (আহসান মঞ্জিল) নিয়মিত নৃত্যগীতির আসর বসত। নওয়াব আব্দুল গনির প্রতিদিনের রুটিন ছিল দুপুর ১২-১টা পর্যন্ত এবং রাত ১১-১টা পর্যন্ত নাচ-গান উপভোগ করা। ১৮৭৫ থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে কোনো এক সময় আহসান মঞ্জিলে ১৬ দিনব্যাপী নৃত্য ও গানের উৎসব হয়।

উনিশ শতকে, ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনি (১৮১৩-১৮৯৬) এবং নওয়াব আহসান উল্লাহর (১৮৪৬-১৯০১) সময়ে নিয়মিত দরবারি নৃত্যগীতির আসর বসতো। ওই সময় এক নর্তকী তার নবজাত সন্তানের অন্নপ্রাসন উৎসবে খরচ করেছিল ২৫ হাজার টাকা! যখন ১মণ চালের দাম ছিল মাত্র ৪টাকা! দরবারি নৃত্যের পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস পায় ১৯০১ থেকে ১৯১৫ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর সময়। ১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি খাজা কলিমুল্লার পুত্র খাজা হামিদুল্লাহর বিয়ে উপলক্ষে যে নাচের অনুষ্ঠান হয় তাতে দেবী বাইজি নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। অবশেষে বিশ শতকের প্রথম ভাগে মাদ্রাজ আইনসভায় আইন পাস করে উপমহাদেশের দেবদাসীপ্রথা বন্ধ করা হয়।

বিশ শতকে, ঢাকার নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে নির্মিত ‘দ্য লাস্ট কিস’ (১৯৩১) চলচ্চিত্রে জিন্দাবাহারের দেবী বাইজির নৃত্য পরিবেশনার কথা জানা যায়। হরিমতি বাইজি ‘দ্য লাস্ট কিস’-এ অভিনয় করেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বাইজি নাচ, ঝুলন যাত্রা বা জন্মাষ্টমীর মিছিল উপভোগ করত। তখন ঢাকার বিখ্যাত বাইজি ছিলেন অভিনেত্রী নার্গিসের মা জদ্দন বাঈ, কজ্জন বাঈ, আখতারী বাঈ, ফয়েজাবাদী, শিল্পী ইন্দুবালা ও হরিমতি।


কলকাতা নিউ এম্পায়ার থিয়েটাওে ১৯৩৬ সালে নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা উপভোগরত রবীন্দ্রনাথ

বাঙালির নৃত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি ১৯১৯ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী নাচ দেখে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে নৃত্য অন্তর্ভুক্ত করেন, ১৯২৬ সালে। শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানে প্রথম নৃত্য উপস্থাপন করা হয়। পরে নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চন্ডালিকা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘নটীরপূজা’ ইত্যাদি রচনা এবং নৃত্য প্রয়োগের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির নৃত্যের নতুন এক শিল্পরূপ দেন। এজন্য তিনি জাভা-বালীর নৃত্য, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি নৃত্যসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় ও আঞ্চলিক নৃত্যের সমন্বিত ঐক্যতান ঘটান।

উপমহাদেশীয় নৃত্যের লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন উদয়শঙ্কর (১৯০০-১৯৭৭)। তিনি রুশ ব্যালেরিনা আনা পাভলোভার দলে যোগ দিয়ে নানা দেশে নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নেন। ১৯৪০ সালে আলমোড়ায় ‘ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সূচনা করেন ‘শঙ্করস্কোপ’ নামে নতুন এক শিল্পধারা। তাঁর বিখ্যাত নৃত্যসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘নিরাশা’, ‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’, ‘গ্রেট রিনানসিয়েসন’, ‘মেলোডি’, ‘গৌতম বুদ্ধ’, ‘আসাম ব্যালে’, ‘প্রকৃতি আনন্দ’ ইত্যাদি। ১৯৪৮ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র। কিছুকাল তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত আকাদেমির আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।

বুলবুল চৌধুরী (১৯১৯-১৯৫৪) ‘শিশুদের মুক্ত বায়ু সেবন সমিতি’র সভাপতি হেমলতা মিত্রের সহযোগিতায় নৃত্যশিল্পী সাধনা বসুর (১৯১৪-১৯৭৩) সহশিল্পী হিসেবে পরিবেশন করেন ‘কচ ও দেবযানী’, ‘মেঘদূত ও স্ট্রিট হাঙ্গার’ নৃত্য।

শিব পার্বতী নৃত্যে উদয়শঙ্কর ও অমলাশঙ্কর

১৯৩৫-৩৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কলকাতা কালচারাল সেন্টার’ এবং ‘ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন’। তিনি ভারতীয় নৃত্যের নতুন এক আঙ্গিক নির্মাণ করেন। মাত্র ৩৫ বছরের শিল্পিজীবনে বুলবুল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেশ প্রেমিক’, ‘দুন্দভির আহবান’, ‘ইন্দ্রসভা’, ‘ভারত ছাড়ো’, ‘শিব ও দেবযানী’সহ ৮২টি নৃত্য সৃষ্টি করেছিলেন।

গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১) ও হেমাঙ্গ বিশ্বাসের (১৯২২-১৯৮৭) নেতৃত্বে ‘ব্রতচারী সোসাইটি’ এবং ‘ব্রতচারী লোকনৃত্য সমিতি’র উদ্যোগে বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারি, ঝুমুর, সারি, কাঠি, রায়বেঁশে, ঢালি নাচ প্রভৃতি পরিবেশন করা হতো। তাঁদের চেষ্টায় বাংলার লৌকিক নৃত্যসমূহ একটি কাঠামোগত রূপ লাভ করে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গওহর জামিল (১৯২৭-১৯৮০) বন্ধু রবিশঙ্কর চ্যাটার্জিকে নিয়ে ঢাকার র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিল্পকলা ভবন’। এ ভবনের মাধ্যমে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক নৃত্যচর্চার সূত্রপাত। ওই স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী ছিলেন জয়শ্রী, শিপ্রা নাথ ও তপতী। ১৯৪৭-৪৮ সালে ঢাকার নৃত্যাঙ্গনে কেস্ট পাল নামে একজন নৃত্য শিক্ষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষার্থী ছিল টলি রায় পালঠি, মঞ্জু খাসনবীশ, রুনু ভৌমিক ও মঞ্জু ভৌমিক, নার্গিস মুর্শিদা ও সেলিনা বাহার। ১৯৪৯ সালে গওহর জামিল এ দেশের প্রথম নৃত্যনাট্য ‘ইন্দ্রের সভা’ পরিচালনা করেন। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ওস্তাদ মীর কাশেম খান (১৯২৮-১৯৮৪)। নৃত্যনাট্যের কেন্দ্রীয় চরিত্রে নৃত্য পরিবেশন করেন গওহর জামিল ও তাঁর বোন শীপ্রা নাথ। আর এ বছরই অর্থাভাবে শিল্পকলা ভবন বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলার স্ব^াস্থ্যমন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার (১৯০৬-১৯৬৬)-এর উদ্যোগে যক্ষ্মা নিবারণী অভিযানের তহবিল সংগ্রহের জন্য কলকাতা থেকে বুলবুল চৌধুরীর নৃত্যদল ঢাকায় আসেন।

নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ও লক্ষ্ণীরায়

তাঁর দলের সদস্য ছিলেন তিমির বরণ, শম্ভু ভট্টাচার্য, অজিত সান্যাল, পরিতোষ সেন, গওহর জামিল, মীর কাশেম খান, মাহমুদ নুরুল হুদা, আফরোজা বুলবুল ও বুলবুলের মেয়ে নার্গিস। তাঁরা ‘দুন্দুভির অভিযান’, ‘প্রকৃতির আহবান’, ‘জীবন ও মৃত্যু’, ‘ইরানের এক পান্থশালা’, ‘পাছে ভুলে না যাই’ এবং ‘সাপুড়ে নৃত্য’ প্রদর্শন করেন সদরঘাটের ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে।

১৯৫০ সালে ঢাকার অভিজাত পরিবারের মেয়ে লায়লা সামাদ, বেগম রোকেয়া কবীর, কুলসুম হুদা, নাঈমা হুদা, বেগম লিলি খান, জিনাত (ছোট খুকি), মেহের (বড় খুকি), রোজী মজিদ নৃত্যচর্চায় নাম লেখান। আর এ সময় গওহর জামিল গড়ে তোলেন ‘সাংস্কৃতিক সংস্থা কলাভবন’। কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫১ সালে ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারা বাহার চৌধুরীর (১৯১৮-১৯৮৭) উদ্যোগে চালু হয় ‘সুরবিতান’। এখানে নৃত্য শিক্ষক ছিলেন গওহর জামিল। ১৯৫৫ সালে আনোয়ারা বাহার ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে বদলি হওয়ায় সুরবিতানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর মাহমুদ নুরুল হুদার উদ্যোগে ঢাকার ওয়াইজ ঘাটে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’।

রাজশাহীর বজলুর রহমান বাদল (১৯২৬) কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কোরিওগ্রাফি করেন, ১৯৫৪ সালে। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি পরিচালনা করেন ‘রাধা-কৃষ্ণ’, ‘মহিষাসুর বধ’, ‘সতীদাহ’ নৃত্যনাট্য। ওই সময় দিনাজপুরের রাধাপদ অধিকারী (১৯২৩-২০০০), রংপুরের কুঞ্জলাল সরকার (১৯২৪), বরিশালের মিহির দত্ত (১৯৩৫), যশোরের বরেন বিশ্বাস (১৯৩৬), সিলেটের কামেশ্বর সিংহ, অনিল কিষণ সিংহ (১৯৩৭), শঙ্কর, হরিদাশ ও শেফালী নৃত্যচর্চায় বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরোদ অনুষ্ঠানে সিলেটের শিল্পী শেফালী মণিপুরী নৃত্য পরিবেশন করেন।

১৯৫৫ সালে ঢাকার গেন্ডারিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের (মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক বাসন্তী গুহঠাকুরতার (১৯২২-১৯৯৩) উদ্যোগে মঞ্চস্থ হয় নৃত্যনাট্য ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’। পরিচালনা করেন অজিত সান্যাল। এ নৃত্যনাট্যের রাখাল চরিত্রে নৃত্য পরিবেশন করেন রাহিজা খানম ঝুনু। অজিত সান্যাল ১৯৫৫ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে (বাফা) যোগ দেন।

চট্টগ্রামের ‘আর্য সঙ্গীত সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মী- শিল্পী ধীরেন সেন, চুনিলাল সেন, রুনু বিশ্বাস ও অনিলকুমার মিত্র নৃত্যচর্চায় অনন্য ভূমিকা রাখেন। চুনিলাল সেন ‘সঙ্গীত পরিষদ’ (১৯৩৯), অনিল মিত্র ‘প্রাচ্য ছন্দ গীতিকা’ এবং রুনু বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমী’ (১৯৬৭)। এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন মীনা পাল কবরী, লক্ষ্মী রক্ষিত, উমা বল, সতী বল, ডলি ভট্টাচার্য, নিম্নি রহমান, রাহনুমা আফতাব, মেহের নিগার, কুন্তলা বড়ুয়া, শীলা দাশ ও শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার রূপমহল হলে মুক্তি পায় আব্দুল জববার খান (১৯১৭-?) পরিচালিত পূর্ববাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত এ চলচ্চিত্রের নৃত্য পরিচালক ও শিল্পী ছিলেন গওহর জামিল। ১৯৬১ সালে জি.এ মান্নান (১৯৩১-১৯৯২) (জসীমউদ্দীন প্রণীত)  নক্সী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন। নৃত্যনাট্য রূপ দেন এ কে এম মুজতবা এবং সঙ্গীত সংযোজন করেন ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান। জি.এ মান্নান ১৯৬৩ সালে চালু করেন ‘নিক্কন ললিতকলা একাডেমী’। তাঁর বিখ্যাত নৃত্যনাট্যের মধ্যে রয়েছে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘মহুয়া’, ‘কাশ্মীরী’, ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ ইত্যাদি।

১৯৫৯ সালে গওহর জামিল ও রওশন জামিল (১৯৩১-২০০২)-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাগো আর্ট সেন্টার’। তাঁদের হাতে তৈরি হয় দেশের নতুন নৃত্য রুচি। ১৯৬৩ সালে কবি সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন (১৯৩৩), কামাল লোহানী (১৯৩৬)-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন’। ছায়ানটের প্রযোজনায় রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ২৮ এপ্রিল কার্জন হলে মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ‘চন্ডালিকা’। নৃত্যনাট্যের প্রকৃতি-র চরিত্রে রূপ দেন মন্দিরা নন্দী এবং মায়ের চরিত্রে রূপ দেন সেলিনা বাহার। আর আনন্দ সেজেছিলেন আমিনুল ইসলাম তুলা। অজিত সান্যাল পরিকল্পিত এ নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা করেন ভক্তিময় দাশগুপ্ত। লায়লা হাসানের শিক্ষকতার মাধ্যমে ছায়ানটের নৃত্যকলা বিভাগ চালু হয়।

১৯৬৪ বারীন মজুমদার (১৯১৯-২০০২) প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কত্থক নৃত্যশিল্পী জীনাৎ জাহান (১৯৪০-২০০২)। তিনি ছিলেন কলকাতার ব্রজেন্দ্রকিশোর সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় থেকে নৃত্যকলায় স্নাতক। তাঁর নির্দেশিত নৃত্যনাট্য ‘এসো বসন্ত ফিরে যেও না’, ‘দূর দ্বীপবাসিনী’, ‘শ্যামা’ এবং ‘মায়ার খেলা’।

১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহের যোগেশচন্দ্র দাশ (১৯২৬-২০০৬) নাচ শিখেছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনীতা দাশগুপ্তের কাছে। তিনি ‘নটরাজ শিল্পী নিকেতন’ (১৯৬৫) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিচালনা করেন নৃত্যনাট্য ‘মহুয়া’, ‘যমুনাবতীর দুঃখ’, ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’, ‘রাখাল বন্ধু’ ও ‘অগ্নীবীণা’। ১৯৬৫ সালে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান বৈতালিকের প্রযোজনা ও লায়লা হাসানের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। তাঁর নির্দেশিত নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শাপমোচন’, ‘আমার বর্ণমালা’, ‘নারী মহীয়সী’ অন্যতম।

১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহের মুকুল ফৌজের নৃত্য শিক্ষক ইউনুস আহমেদ বাবলু (১৯৪৩-২০০৭) পরিচালনা করেন ‘মন পবনের নাও’, ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’ ও ‘অগ্নিবীণা’ নৃত্যনাট্য। তৎপরবর্তী শিল্পী আমানুল হক (১৯৩৮) পরিচালনা করেন ‘ব্যাটল অব বাংলাদেশ’, ‘জুলফিকার’, ‘মন বেসাতির হাট’ ও ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে’ নৃত্যনাট্য।

১৯৬৭ সালে লক্ষনো মরিচ কলেজের শিক্ষক মনজুর হোসেন খান ঢাকায় কিছুদিন কত্থক নৃত্যের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর শিষ্য সৈয়দ আবুল কালাম (১৯৫৬) এ দেশে কত্থক নৃত্যের প্রসারে কাজ করছেন। খুলনায় রাশেদ উদ্দিন তালুকদার (১৯৪২-২০০৪) পরিচালনা করেন নৃত্যনাট্য ‘বিদ্রোহী বীর’, ‘গোলাপের সমাধি’ ইত্যাদি। ১৯৬৯ সালে তিনি খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘নজরুল একাডেমী’।

আলতামাস আহমেদ (১৯৩৭-১৯৯৮) এবং তাঁর স্ত্রী শাহেদা আলতামাস (১৯৪৬-১৯৮৬) ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নৃত্যস্কুল ‘সঙ্গীত বিতান’। তাঁদের নির্দেশিত নৃত্যনাট্য ‘শতাব্দীর স্বপ্ন’ ও ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’।

নবারন নৃত্যনাট্যে গওহর জামিল, জি.এ মান্নান ও সহশিল্পীরা

১৯৬৭ সালে শিল্পী আবুল কাশেম (১৯৪০-১৯৯১) প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঝঙ্কার ললিতকলা একাডেমী’। তাঁর পরিচালিত নৃত্যনাট্য ‘সুজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘গুনাইবিবি’ ও ‘বেদের মেয়ে’। বাফার প্রযোজনায় বাবু রাম সিংহ, হাবিবুল চৌধুরী এবং কাজল মাহমুদ (১৯৫২) নৃত্যরূপ দেন এনামুল হক রচিত ‘রাজপথ জনপথ’ নৃত্যনাট্য। এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ (১৯৩৩-১৯৭১)।

কিশোরগঞ্জের পীযূষকিরণ পাল ও নিকুঞ্জবিহারী পাল কিশোরগঞ্জ আর্ট কাউন্সিলে শিক্ষকতা করতেন। সঙ্গীত ও নৃত্যচর্চায় তাঁদের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্তর দশকের কৃতী নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে অজিতকুমার দে, ডালিয়া নিলুফার, ডালিয়া সালাউদ্দিন, গোলাম মোস্তফা খান (১৯৪০), মঞ্জুর চৌধুরী (১৯৪৫-১৯৯২), হুমায়ুন কবীর (১৯৪৮), মাইদুল ইসলাম (১৯৪৮), শারমিন হোসেন (১৯৪৯), জিনাত বরকত উল্লাহ (১৯৫১), হাসান ইমাম (১৯৫২) অন্যতম।

স্বাধীনতা উত্তর-কালে নৃত্যশিল্পী আলপনা মুমতাজ (১৯৪৮-২০০৪) প্রতিষ্ঠা করেন ‘কথাকলি সঙ্গীত বিদ্যালয়’। কথাকলি ১৯৭২ সালে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চস্থ করেন ‘চন্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য। পরবর্তীকালে ‘বৈতালিক’ এবং ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’, উপমহাদেশীয় সঙ্গীত প্রসার কেন্দ্র ‘সাধনা’ ও ‘ধ্রুপদ কলা কেন্দ্র’ দর্শনীর বিনিময়ে নৃত্যচর্চার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তবে এর ধারাবাহিকতা বেশিদিন বজায় থাকেনি।

১৯৭২ সালে শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার পরিকল্পিত ‘নতুন কুঁড়ি’ অনুষ্ঠান চালু হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। শিশুদের সৃজনশীল দক্ষতা অর্জনই ছিল এর লক্ষ্য। এ অনুষ্ঠানের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী তারানা হালিম, রুমানা রশীদ ঈশিতা ও তারিন । ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। একাডেমীর প্রশিক্ষণ বিভাগ দেশের ৬৩টি জেলা শাখায় নৃত্য বিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা করে। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিশু একাডেমী দেশের ৬০টি জেলায় সঙ্গীত, নৃত্যকলা, চারুকলা বিষয়ে শিশুদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

গওহর জামিল, জি.এ মান্নান, আলতামাস আহমেদের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা’। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা থেকে নৃত্যানুষ্ঠান, সেমিনার, সম্মাননা প্রদানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। ১৯৮০ সালে ওয়াহিদুল হক (১৯৩৩-২০০৭) সিলেট থেকে শান্তিবালা সিনহাকে ঢাকায় এনে ছায়ানটে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ওই বছর গোলাম মোস্তফা খান প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’। তাঁর নির্দেশিত নৃত্যনাট্য ‘বেণুকার সুর’, ‘তিন সুরে গাঁথা’, ‘রক্তলাল অহংকার’ অন্যতম। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচার করে শিশুদের নাচ শেখার অনুষ্ঠান ‘রুমঝুম’। অনুষ্ঠানটির প্রধান পরিকল্পক ও প্রশিক্ষক ছিলেন লায়লা হাসান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশন নৃত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘ছন্দে আনন্দে’ ও ‘নৃত্যের তালে তালে’ প্রচার করে। দেশব্যাপী নৃত্যচর্চার প্রসারে এসব অনুষ্ঠানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

আশির দশকের শিল্পীদের মধ্যে বেগম সিরাজ সেরনেয়াবাত (১৯৪৪), ইলিয়াস হায়দার (১৯৪৭), নাজমা গফুর (১৯৫০), রওশন আরা বেগম (১৯৫২), খাজা হোসেন আহমেদ লোটন (১৯৫২), মানসী দাশ তালুকদার (১৯৫২), মীনু হক (১৯৫৩), আমির হোসেন বাবু (১৯৫৩-২০০৪), পীনু খান (১৯৫৪), লুবনা মারিয়াম (১৯৫৪), সেলিনা বেগম শেলী, সালেহা চৌধুরী (১৯৫৫), রেশমা ফিরোজ (১৯৫৫), কমল সরকার (১৯৫৭-১৯৯৩), ডলি ইকবাল (১৯৫৮), অঞ্জনা রায় জবা (১৯৫৯), নিলুফার বেগম (১৯৬১), নীলুফার ওয়াহিদ পাপড়ী (১৯৬২), অনিতা সিনহা, নমিতা কুন্ডু  অন্যতম।

১৯৮১ সালে ন্যাশনাল পারফরমিং আর্টস একাডেমী ছয় মাস মেয়াদী নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী সৃষ্ট বিভিন্ন নৃত্যের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। এর প্রশিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। ১৯৮৫ সাল থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিকাশে শুক্লা সরকার (১৯৬১) ও বেলায়েত হোসেন খান (১৯৫৫) অনন্য ভূমিকা রাখছেন। ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সালে ভারতীয় নৃত্যশিল্পী সংযুক্তা পানিগ্রাহী এবং সানি মহাপাত্র ঢাকায় ওড়িশি নৃত্যের কর্মশালা পরিচালনা করেন। তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি মীনু হক ও তামান্না রহমান (১৯৬৫) ওড়িশি নৃত্যচর্চা অব্যহত রেখেছেন। নববই দশকের গুরুত্বপূর্ণ নৃত্যশিল্পী সুলতানা হায়দার (১৯৫২), আবদুস সামাদ পলাশ, দীপা খন্দকার (১৯৫৯), শামীম আরা নীপা (১৯৬১), মুসা খান, সফিকুর রহমান (১৯৫৬), রফিকুল ইসলাম শফিক, মীনা নজরুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম মনি, মো. শরিফুল ইসলাম, সোহেল রহমান, কবিরুল ইসলাম রতন, সারোয়ার আহমেদ, আব্দুর রশীদ স্বপন, ফাতেমা কাশেম, ইকবাল আহমেদ, এম আর ওয়াসেক, আজিজুল ইসলাম, স্বপন দাশ প্রমুখ।

বাংলাদেশে চর্চিত শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে ভরতনাট্যম, মণিপুরী, কত্থক, ওড়িশি, কথাকলি অন্যতম। ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ভরতনাট্যম নৃত্যে সোমা মুমতাজ (১৯৬৫), আনিসুল ইসলাম হিরু, শুভ্রা সেনগুপ্তা, বেবি রোজারিও; কত্থক নৃত্যে শিবলী মহম্মদ, সাজু আহমেদ (১৯৬০), মুনমুন আহমেদ (১৯৬৬), তাবাচ্ছুম আহমেদ (১৯৭০), অরুনা হায়দার, কচি রহমান, কাজী রকিবুল হক; মণিপুরী নৃত্যে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাসুদুর রহমান, তামান্না্ রহমান; ওড়িশি নৃত্যে বেনজির সালাম, প্রমা অবন্তী, কথাকলি নৃত্যে লুবনা চৌধুরী প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে তাঁরা পদ্ধতিগত নৃত্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সাম্প্রতিককালে নৃত্য পরিবেশনায় উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছেন পারভীন সুলতানা, স্বন্দীপ রায়, সাদিয়া ইসলাম মৌ, ফারহানা চৌধুরী বেবী, নাজমুল হক লেলিন, আবদুস সাত্তার, কস্ত্তরী মুখার্জ্জি, লিখন রায়, মোস্তাক সেলিম, গোপাল কুন্ডু, সঞ্জীব চক্রবর্তী, আবুল হাসান তপন, এনামুল হক, সালমা মুন্নি, সামিনা হোসেন প্রেমা, ওয়ার্দা রিহাব, ইভান শাহরিয়ার, শহিদুল ইসলাম, অনিক বসু, নিলঞ্জনা দাশ জুঁই, অনন্যা বড়ুয়া, ল্যালডি মোহন মৈত্র প্রমুখ।

বাংলাদেশে রবীন্দ্র গীতিনৃত্য চর্চার ক্ষেত্রে লায়লা হাসান, লুবনা মারিয়াম, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুক্লা সরকার অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশে পশ্চিমা আধুনিক নৃত্যের প্রথম শিল্পী আনিসুল ইসলাম হিরু। তিনি অস্ট্রিয়ার ইন্টারন্যাশনাল সামার ব্যালে এবং জার্মানির ব্রেমেন স্টেট থিয়েটারে ড্যান্স শেখেন। তার নির্দেশিত ‘ঈর্ষা’ বেশ প্রশংসিত কাজ। আমেরিকার মার্থা গ্রাহাম স্কুলের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমানও আধুনিক ব্যালে নিয়ে কাজ করছেন। এছাড়া নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ লন্ডন থেকে ব্যালে নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।

১৯৮২ সালে নৃত্যবিদ জ্যঁ জর্জ নোভেরের জন্মদিনকে (২৯ এপ্রিল, ১৭২৭ প্যারিস) স্মরণ করে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই) ২৯ এপ্রিল আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস ঘোষণা করে। ১৯৯২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা যৌথ উদ্যোগে শোভাযাত্রা, সেমিনার, নৃত্যমেলা, নৃত্য প্রদর্শনী, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে এ দিবস উদযাপন করছে।

বিশ শতকের শেষ দশক (২০০১-২০১০) নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যধারা’, ‘নৃত্যাঞ্চল’, ‘সৃষ্টি কালচার সেন্টার’ ও ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ বেশ কয়েকটি নৃত্য উৎসবের আয়োজন করে। এছাড়া বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উদ্যোগে দেশব্যাপী চারটি জাতীয় নৃত্য উৎসব ও বুলবুল চৌধুরী নৃত্য উৎসব হয়েছে। যেখানে দেশের ক্ষুদ্র নৃজাতির শিল্পীসহ শাস্ত্রীয় ও লৌকিক ধারার সহস্রাধিক শিল্পীরা অংশ নেয়। সংস্থা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে নৃত্য অন্তর্ভুক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র নৃত্যকলা বিভাগ চালুর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ঐতিহ্যবাহী নৃত্য সংরক্ষণের জন্য গবেষণামূলক লোকজ নৃত্য সন্ধ্যা ‘ফিরে চল মাটির টানে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মাত্র দুটি অনুষ্ঠানের পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়।

দেশে ২২৫টির অধিক নৃত্যস্কুলে নৃত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর ৩৯টি দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির আওতায় দেশ থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে নৃত্যশিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রসারিত হচ্ছে নৃত্যকলা, সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের সংস্কৃতি।  [শেখ মেহেদী হাসান]

গ্রন্থপঞ্জি  সুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, কলিকাতা, ১৯৯১; নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, কলকাতা, অগ্রহায়ণ, ১৩৮২; সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তিন হাজার বছরের লোকায়ত জীবন, কলিকাতা ১৩৮৩; আহমদ শরীফ, বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, ঢাকা, এপ্রিল ২০০০; অতীন্দ্র মজুমদার, চর্যাপদ, কলকাতা, নয়াপ্রকাশ, চতুর্থ মুদ্রণ, ১৩৮৮; সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাংলা নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬; Syed Jamil Ahmed, Achinpakhi Infinity: Indigenous Theatre of Bangladesh, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ঢাকা, ২০০০।