লোকসঙ্গীত
লোকসঙ্গীত লোকমানস থেকে উদ্ভূত সঙ্গীত, যা সাধারণত শ্রুতি ও স্মৃতিকে নির্ভর করে বহমান থাকে। প্রাচীন নাথগীতিকা থেকে শুরু করে বর্তমান কালের বাউল, মরমিয়া ও দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতাদের নাম-ভণিতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাটিয়ালি ব্যক্তিচেতনাজাত একক কণ্ঠের গান হলেও ক্রমে তা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে সমাজমানসে উত্তীর্ণ হয়।
গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপই হচ্ছে সঙ্গীত। এদিক থেকে লোকগীতি, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপকেই লোকসঙ্গীত বলা যায়। বাউল সঙ্গীত লোকসঙ্গীতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, কারণ তা গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয়।
বাংলা লোকসঙ্গীত বৈচিত্র্যময়। পল্লীর শ্রমজীবী জনমানসের সংস্কারগত চিন্তা-ভাবনা, বারোমাসে তেরো পার্বণের উৎসব-অনুষ্ঠান, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঔৎসুক্য, বাংলার নিসর্গশোভা, নদী ও নৌকার রূপকাশ্রয়ী চিন্তা-চেতনা, দারিদ্র্য, সমাজের অন্যায়-অবিচার, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য প্রভৃতি বিষয়গত বোধ ও অলৌকিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে গ্রামবাংলার মানুষ এ গান বেঁধেছে। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকসংস্কারগত আচার-অনুষ্ঠানই প্রাধান্য পেয়েছে; সেই সঙ্গে নদী ও নৌকাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে জগৎ ও জীবনের রূপকাশ্রয়ী অধ্যাত্মলোকের মরমি গান।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক বলে বাংলা লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক দেশের জাতীয় চরিত্র যেমন প্রধানত তার নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তেমনি লোকসঙ্গীতও প্রধানত দেশের প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি সকল অঞ্চলে এক নয় কোথাও নদীবিধৌত, কোথাও অরণ্যাকীর্ণ; আবার কোথাও নিরস প্রস্তরভূমি, কোথাও বা তরাই অঞ্চল। এসব কারণে লোকসঙ্গীতের সুর সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করলেও তা মুখ্যত আঞ্চলিক; যেমন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, পূর্বাঞ্চলের ভাটিয়ালি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাউল-মারফতি ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশ নদীমাতৃক হলেও বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদীর প্রকৃতিতে পার্থক্য আছে; পদ্মা, মেঘনা, সুরমা ও ধলেশ্বরীর যে রূপ, মধুমতি, ইছামতি, ভৈরব প্রভৃতির রূপ তা থেকে ভিন্ন। সুতরাং নদ-নদীর সঙ্গে নানাভাবে জনসমাজের যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়, তা বাংলাদেশের সর্বত্র এক রকম নয়। এ কারণে যে অঞ্চলের জীবনধারা যেভাবে গড়ে উঠেছে, সে অঞ্চলের লোকসঙ্গীতও সেভাবেই সৃষ্টি ও বিকশিত হয়েছে।
বাংলা লোকসঙ্গীতে আরও একটি বিষয় বৈচিত্র্য এনেছে, সেটি হলো ভিন্ন ভাষাভাষী আদিম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রভাব। বাংলাদেশে যেসব আদিম জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারা বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি পরস্পর ভিন্ন। সেসব সংস্কৃতি দ্বারা বাংলা লোকসঙ্গীত বিষয়, সুর ইত্যাদি দিক থেকে অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছে।
বাংলা লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন ধারার গানের পরিচয় পাওয়া যায়। সেসব গান বিশেষণ করলে দেখা যায়, কতক গান একক কণ্ঠে গীত হয়, কতক সমবেত কণ্ঠে। বাউল, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুরশিদি ও মারফতি প্রথম শ্রেণির গান; এগুলির রচয়িতাও ব্যক্তিবিশেষ। কবিগান, লেটোগান, আলকাপ গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি সমবেত কণ্ঠের গান; দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে এসব গান পরিবেশন করে। দ্বিতীয়ত কতক গান আঞ্চলিক, কতক সর্বাঞ্চলীয়। অনেকগুলি লোকসঙ্গীত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত; আবার কতগুলি শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। তৃতীয় ধারার কিছু গান আছে যেগুলি সম্প্রদায়গত, বিশেষত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ে বিভক্ত। চতুর্থত কতগুলি গান শুধু মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত, যেমন ব্রতগান, মেয়েলি গীত ইত্যাদি; এগুলি মেয়েরাই রচনা করে এবং তারাই পরিবেশন করে। ছাদপেটানোর গানে নারী-পুরুষ একত্রে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে লোকসঙ্গীতের অঞ্চলগুলি এরূপ: বাউল, দেহতত্ত্ব কুষ্টিয়া, বীরভূম ও পূর্বাঞ্চল; জারি গান ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ; ভাওয়াইয়া কুচবিহার, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা; গম্ভীরা রাজশাহী, মালদহ; গাজন, নীলপূজা বাংলাদেশে নীলপূজা ও পশ্চিমবঙ্গে গাজন; বিয়ের গীত কমবেশি সব অঞ্চলেই প্রচলিত; ছাদ পেটানোর গান বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও বাঁকুড়া; সারি সিলেট ও ময়মনসিংহসহ ভাটি অঞ্চল; ভাটিয়ালি সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিলা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর; রাখালিয়া ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ; ব্রতগান ও মেয়েলি গীত উভয় বঙ্গের প্রায় সর্বত্র; ভাদুগান বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দক্ষিণ বীরভূম ও পশ্চিম বর্ধমান।
বাংলা লোকসঙ্গীতের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো: ক. জনমানস থেকে এর উদ্ভব ও মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত; খ. সম্মিলিত বা একক কণ্ঠে গীত হতে পারে; গ. এর চর্চার জন্য নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না; ঘ. সাধারণত নিরক্ষর মানুষ এর রচয়িতা বা সুরকার এবং সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অকৃত্রিম হূদয়ের প্রকাশ ঘটে; ঙ. সহজ ভাষা, আঞ্চলিক উচ্চারণ ও সুরের স্বতঃস্ফূর্ততা; চ. কথা ও সুরের সম্মিলনে হূদয়গ্রাহী আবেদন; ছ. সুরের আবেদন সর্বজনীন হলেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার স্বস্ব অঞ্চলকে চিহ্নিত করে; জ. প্রকৃতি-নির্ভরতা নিসর্গ, প্রান্তর, নদী, নৌকা প্রভৃতি গ্রামীণ পরিবেশের বহুল ব্যবহার; ঝ. দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার নিরাভরণ প্রকাশ; ঞ. সহজ-স্বাভাবিক ছন্দের ব্যবহার এবং ট. মানবিক প্রেমের বিরহ-মিলনজাত ভাবাবেগের প্রাবল্য।
লোকসঙ্গীতের সুরেও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। অধিকাংশ লোকসঙ্গীতের গঠনরীতির মূল ভঙ্গিমাটুকু থাকে পূর্বাঙ্গে। এদিক থেকে লোকসঙ্গীতকে মোটামুটিভাবে চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণির সুর ‘সা রা মা পা’, দ্বিতীয় শ্রেণির ‘সা গা মা পা’, তৃতীয় শ্রেণির ‘সা রা গা পা’ এমনিভাবে আরোহণ করে এবং চতুর্থ শ্রেণির সুর ‘সা রা গা মা পা’ এমনিভাবে পঞ্চম পর্যন্ত সরলভাবে আরোহণ করে। সুরের এ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, লোকসঙ্গীতে তা কঠোরভাবে পালন করা হয়। লোকসঙ্গীতের আরও দুটি দিক হলো: ক. সত্যিকার লিরিকধর্মী গান সুর ছাড়া শুধু কথায় যার গতি পঙ্গু, যেমন ভাটিয়ালি, বাউল ইত্যাদি এবং খ. এমন সব গান, যেগুলিকে সুর ছাড়া কেবল গানই নয়, কবিতা বলাও দুষ্কর, যেমন ভাটের গান।
বিশ্বের যাবতীয় লোকসঙ্গীতের মতো বাংলা লোকসঙ্গীতেও পাঁচ স্বরের (pentatonic scale) ব্যবহার দেখা যায়; যেমন সীমান্ত প্রদেশের গারো, সাঁওতাল ও হাজংদের গান। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতের স্বাতন্ত্র্য এর বিশিষ্ট রূপভঙ্গি ও সাত স্বরের বিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কেবল সুরের দিক দিয়ে নয়, ছন্দের দিক দিয়েও এর মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, রাগসঙ্গীতের উদ্ভবের পশ্চাতে রয়েছে এই লোকসঙ্গীত; আজও বহু রাগ-রাগিণীর নামকরণে এর সাক্ষ্য মেলে। আভের, সাবেরী, মালবী, কানাড়ী, পাহাড়ী, মাঢ়, বঙ্গাল প্রভৃতি জাতির নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর নামকরণ এই সত্যকেই পরিস্ফুট করে। অন্যদিকে বাংলা লোকসঙ্গীতে কোনো কোনো রাগসঙ্গীতেরও প্রভাব দেখা যায়। ঝিঁঝিট, দেশ, ভৈরবী, ভূপালি, বিভাস প্রভৃতি রাগের স্পর্শ বাংলার লোকসঙ্গীতকে মাধুর্যমন্ডিত করেছে। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। ভাটিয়ালি সুরে যে স্বরের প্রয়োগ হয়, তা রাগসঙ্গীতের খাম্বাজ ও পিলু সুরের সমগোত্রীয়। কখনো কখনো ভীমপলশ্রী ও পটদীপ রাগের সঙ্গেও এর মিল লক্ষ করা যায়। ঠাট বিচারে খাম্বাজ ও কাফী ঠাটের সঙ্গে ভাটিয়ালির নিকট সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। ঝুমুরের সুরভঙ্গির মধ্যেও খাম্বাজ তথা পিলুর আমেজ আছে। বাউলের মধ্যে আছে বেহাগ, খাম্বাজ, ভৈরবী, বিলাবল প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর প্রভাব। খাম্বাজ ও কাফী ঠাটের রাগ-রাগিণীর সঙ্গে বাংলা লোকসঙ্গীতের সুর-নৈকট্য রয়েছে।
বাংলা লোকসঙ্গীতে ঝিঁঝিট রাগের প্রভাব অনেকখানি। প্রায় সব লোকসঙ্গীত (বাউল, ভাটিয়ালি, সারি, মারফতি, মরমি প্রভৃতিতে), এমনকি কীর্তনেও এই রাগের স্বরগ্রাম বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। ঝিঁঝিট রাগের দুটি রূপ: প্রথমটি মন্দ্র সপ্তকের ধৈবত পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায় এবং তার স্বররূপ এরকম: সা রা মা/ পা মা গা রা সা ণা্ ধা্ পা্/ পা্ ধা্ সা রা গা মা গা/ ধা্ সা; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কশৌলি ঝিঁঝিট বা লোকগীতির ঝিঁঝিট, যার স্বররূপ: সা রা মা/ পা মা গা রা সা ণা্ ধা্/ ধা্ সা সা রা গা, রা গা মা। উলেখ্য যে, অধিকাংশ লোকসঙ্গীতেই স্থায়ী ও বাকি অন্তরাগুলির সুর একই রকম হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ গগন হরকরা রচিত একটি বিখ্যাত গানের উলেখ করা যায়। গানটির প্রথম পংক্তি হলো: ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’ গানটির সুররূপে সাতটি শুদ্ধ স্বর এবং মাঝে মাঝে কোমল নিখাদের ব্যবহার হয়েছে। এ গানটিতে কশৌল ঝিঁঝিটের স্বরবিন্যাস ব্যবহূত হয়েছে। ভাটিয়ালিতে খুব বেশি প্রচলিত কশৌলি ঝিঁঝিটের সুররূপটি এরকম: সা রা মা, পা মা গা ধা্ সা ণা্ ধা্, ধা্ সা সা রা গা, রা গা সা। এটি কেবল ভাটিয়ালিতেই নয়, লোকসঙ্গীতের সব ধারায়ই ব্যবহূত হয়।
লোকসুর বিশেষণে স্বাভাবিকভাবেই তাল-লয় এবং ছন্দোবৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ আসে। তাল-লয়ের দিক দিয়ে লোকসঙ্গীতকে দুভাগে ভাগ করা যায়: দ্রুত লয়ের, যেমন সারি ও ঝুমুর এবং বিলম্বিত লয়ের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত, বিশেষ করে ভাওয়াইয়া বা চটকা কোনো বিষয়বস্ত্তকে নির্দেশ করে না, কেবল সুরের লয়কেই নির্দেশ করে। চটকা দ্রুত লয়ের, যাকে ঝুমুরের সঙ্গে তুলনা করা যায়; আর ভাওয়াইয়া বিলম্বিত লয়ের, যা ভাটিয়ালির সঙ্গে তুলনীয়। কখনও কখনও অবশ্য ভাটিয়ালি তালবিহীনভাবে অর্থাৎ বৈতালিকেও গাওয়া হয়।
বাংলা লোকসঙ্গীতের সুরগত বৈশিষ্ট্য অন্যান্য দেশের লোকসঙ্গীতের তুলনায় স্বতন্ত্র। অন্যান্য দেশের লোকসঙ্গীত দুই, তিন, চার বা পাঁচ স্বরের সমন্বয়ে গঠিত; কিন্তু বাংলা লোকসঙ্গীত এসব স্বরে গঠিত হলেও তাতে সাতটি স্বরের প্রাধান্য থাকে। সুরবৈচিত্র্যেও বাংলা লোকসঙ্গীত অনেক সমৃদ্ধ এবং একে আরও ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে রাগসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের মিশ্রণ। [মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী]
আরও দেখুন লোকসাহিত্য।