পানি সম্পদ
পানি সম্পদ (Water Resources) ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের প্রাচুর্যে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদনদীর প্রবাহিত পানি এবং খালবিল, পুকুর, হাওর, বাঁওড় প্রভৃতি স্থিতিশীল জলাশয়ের পানি ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি সম্পদের বার্ষিক পরিমাণ ঋতুভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে আগস্ট মাসে এই পরিমাণ থাকে সর্বোচ্চ। তখন প্রায় ১,৪০,০০০ কিউমেক পানি দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে শুষ্ক ঋতুতে ফেব্রুয়ারি মাসে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির পরিমাণ সর্বনিম্নে উপনীত হয় এবং প্রায় ৭,০০০ কিউমেক পানি প্রবাহিত হয়। দেশের প্রধান দুটি নদী ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গার মধ্য দিয়ে ৮০ ভাগেরও বেশি পানি প্রবাহিত হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের কাছে গঙ্গা নদীতে ১৯৮৭ সালে সর্বোচ্চ বন্যা প্রবাহ ৭৬,০০০ কিউমেক পরিমাপ করা হয়েছিল এবং বাহাদুরাবাদের কাছে ১৯৮৮ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের সর্বোচ্চ বন্যা প্রবাহ পরিমাপ করা হয়েছিল ৯৮,৬০০ কিউমেক। উল্লিখিত নদীদ্বয়ের সর্বনিম্ন প্রবাহ পরিমাপ করা হয়েছিল যথাক্রমে ২৬১ কিউমেক এবং ২৮০০ কিউমেক। গঙ্গা নদীর গড় দৈনিক প্রবাহ প্রায় ১০,৮৭৪ কিউমেক যা শুষ্ক ঋতুতে ১,৩৬৬ কিউমেকে নেমে আসে। গঙ্গার সর্বোচ্চ প্রবাহ প্রায় ৪৪,০০০ কিউমেক এবং এই প্রবাহ সচরাচর আগস্ট মাসে অর্জিত হয়ে থাকে। ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনা নদীর বার্ষিক গড় প্রবাহ প্রায় ৪,৮০০ কিউমেক এবং সর্বোচ্চ প্রবাহ সাধারণত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশের পাললিক সমভূমিতে বিদ্যমান ভূগর্ভস্থ জলস্তরসমূহ দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূগর্ভস্থ জলাধার হিসেবে বিবেচিত। এই ভূগর্ভস্থ জলস্তর ব্যবস্থা তিনটি শিলাতাত্ত্বিক এককে গঠিত: একটি ঊর্ধ্ব পলিময় কর্দম ও পলিস্তর, মিহি থেকে অধিক মিহি বালুগঠিত একটি মধ্যবর্তী স্তর এবং মিহি থেকে মোটা বালুগঠিত একটি নিম্নতর স্তর যা প্রধান ভূগর্ভস্থ জলস্তর গঠন করে। ঊর্ধ্বস্তরটি সচরাচর ৩০ থেকে ৬০ মিটার পুরু, মধ্যবর্তী স্তরের পুরুত্ব প্রায় ২০ মিটার এবং নিম্নতর জলস্তরটির পুরুত্ব প্রায় ১০০ মিটার। প্রধান ভূগর্ভস্থ জলস্তরের পরিবহতা (transmissibility) দৈনিক ৫০০ থেকে ২,৫০০ বর্গ মিটার এবং সঞ্চয়ক সহগ (storage coefficient) ১ শতাংশেরও কম থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্থানবিশেষে ভূ-পৃষ্ঠের অল্প কয়েক মিটার নিচেই ভূগর্ভস্থ জলস্তর পাওয়া যায়। তাছাড়া জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিসর উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যথাক্রমে প্রায় ৩,২০০ মিমি থেকে ১,৬০০ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বার্ষিক বারিপাত চক্রে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বাষ্পীভবনের হারের তুলনায় বৃষ্টিপাতের হার প্রায় ১০ শতাংশ ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। পক্ষান্তরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত এবং বাষ্পীভবনের হার প্রায় সমান। কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাষ্পীভবনের হার বৃষ্টিপাতের হারের তুলনায় ১০ শতাংশ অধিক হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত বিস্তৃত শুষ্ক সাত মাসে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ব্যতীত অন্যত্র গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন অধিকতর হয়ে থাকে। বৃষ্টির পরে সৃষ্ট আর্দ্র পরিবেশে মাটিতে অধিকাংশ শীত ও গ্রীষ্মের সবজি সহজেই ফলানো যায়। বাংলাদেশ পানি প্রাচুর্যের দেশ- একথা সাধারণভাবে বলা গেলেও এর পানি সম্পদ সকল ঋতুতে সর্বত্র সুষমভাবে বণ্টিত নয়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি একদিকে যেমন প্রায়ই ধ্বংসাত্মক বন্যা সংঘটিত করে, আবার অন্যদিকে শুষ্ক ঋতুতে পানির ঘাটতি বিভিন্ন অঞ্চলে খরার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে শস্যহানি, গবাদিপশু হানি, জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা, পরিবেশ অবনতি প্রভৃতি সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।
পানি সম্পদের চাহিদা ও প্রাপ্যতা পানির চাহিদা বিস্তৃত ও ব্যাপক। কৃষি, গৃহস্থালি ও শিল্প প্রয়োজনে পানির রয়েছে ভোগ্য (consumptive) চাহিদা। আবার নৌচলাচল, মৎস্য, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, দূষণ হ্রাসকরণ প্রভৃতি প্রয়োজনে রয়েছে পানির অ-ভোগ্য (non-consumptive) চাহিদা। প্রতিবেশগত প্রতিরক্ষা এবং জলাভূমি সংরক্ষণে পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পানি সম্পদের ব্যবহার ও উন্নয়ন সম্পর্কিত যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে প্রকৃতিতে লভ্য পানি সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তবে এ কাজটি খুবই কঠিন। বছরের শুষ্ক মাসগুলোতে বাংলাদেশে পানির ঘাটতি দেখা দেয় এবং মার্চ মাসে তা চরমে পৌঁছে। সরকারের মাস্টার প্ল্যান অর্গানাইজেশন (এম.পি.ও, বর্তমানে Water Resources Planning Organization- WARPO) সংকটপূর্ণ মার্চ মাসে পানির প্রাপ্যতা ও চাহিদা নির্ণয়ে প্রথম মূল্যায়নকার্য সম্পন্ন করে এবং ১৯৮৬ সালে প্রণীত জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা (National Water Plan)-তে উপস্থাপন করে। ১৯৯১ সালে এম.পি.ও পানির চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে জাতীয় পানি পরিকল্পনাকে সংশোধন করে। পানির মোট চাহিদা ধরা হয়েছে সেচকার্যে পানির চাহিদা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, নদনদীর মৎস্যসম্পদ রক্ষা, অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল, গৃহস্থালি এবং শিল্পকারখানায় পানির চাহিদার ভিত্তিতে। দেশে পানির মোট চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ২৪,৩৭০ মিলিয়ন ঘনমিটার। এই মোট চাহিদার মধ্যে কৃষিকাজে পানির চাহিদা ১৪,২০৯ মিলিয়ন ঘনমিটার; নৌচলাচলে পানির চাহিদা ৯,৯১০ মিলিয়ন ঘনমিটার এবং গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় পানির চাহিদা ১৭০ মিলিয়ন ঘনমিটার। মার্চ মাসে পানির মোট সরবরাহ হচ্ছে ২৩,৪৯০ মিলিয়ন ঘনমিটার যার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি ৫,৩৬০ মিলিয়ন ঘনমিটার; ৬,৩৯০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরবরাহ হয়ে থাকে আঞ্চলিক নদনদী, বিল ও হাওর থেকে এবং প্রধান নদনদীসমূহ থেকে পাওয়া যায় ১১,৭৪০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি। মোট পানি চাহিদার ৫৮.৬ শতাংশ কৃষিখাতে; নৌচলাচল, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ ও মৎস্যচাষে চাহিদা ৪০.৭ শতাংশ এবং গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় পানির চাহিদা মোট চাহিদার মাত্র ০.৭ শতাংশ। পানির মোট চাহিদার মধ্যে ৭৭.২ ভাগ ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি থেকে এবং অবশিষ্ট ২২.৮ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানি দ্বারা পূরণ হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে।
মার্চ মাসে পানিসাম্যের একটি প্রাক্কলন ১৯৯১ সালে এম.পি.ও কর্তৃক হিসাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৯৮৩ সালকে বেঞ্চমার্ক বছর বা ভিত্তিবছর হিসাবে ধরে ১৯৯০ সালের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং ২০০৫ ও ২০১৮ সালে পরিস্থিতি কি হতে পারে তার একটি অভিক্ষেপ নির্ণয় করা হয়েছে। অবশ্য গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র বাঁধ প্রকল্পসমূহের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন কাজ ২০১৮ সালের পূর্বেই শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উপরে প্রদর্শিত পানি সাম্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিবছর সকল ভোগ্য ও অ-ভোগ্য চাহিদার প্রয়োজনীয় পানির চেয়ে অধিক পানি দেশের ভূভাগের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাচ্ছে। ভিত্তি বছর ১৯৮৩ সালের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে দেশে ৩৯৯০ কিউমেকস পানি প্রবেশ করেছে যা মোট পানি প্রবেশের বা মোট অন্তঃপ্রবাহের ৬৯ শতাংশ। মোট অন্তঃপ্রবাহে গঙ্গার অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। অন্যান্য সকল পরিমাপকৃত উপনদীসমূহের অন্তঃপ্রবাহের পরিমাণ মাত্র ৭.৭ শতাংশ এবং অপরিমাপকৃত উপনদীসমূহের নিট অন্তঃপ্রবাহ আনুমানিক ৮.৩ শতাংশ। অবশিষ্ট (নিট) অপরিমাপকৃত অন্তঃপ্রবাহ ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী বাহাদুরাবাদ (ভারত সীমান্ত থেকে ৮০ কিমি ভাটিতে), গঙ্গা নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ (ভারত সীমান্ত থেকে ৩০ কিমি পূর্বে) এবং বারুরিয়ার (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগ স্থলের ভাটিতে) অন্তঃপ্রবাহ ও বহিঃপ্রবাহের মোট যোগফলের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রত্যাশা করা হয় যে ২০০৫ সাল নাগাদ প্রায় ৬০০ কিউমেকস পানি বিদ্যমান খাল নেটওয়ার্ক থেকে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পাম্পিং-এর মাধ্যমে প্রত্যাহার করে ব্যবহার করা হবে। ভবিষ্যতে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ১৮৩০ কিউমেকস পানি প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে।
যদিও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি প্রবাহিত হয়ে যায় তবুও বেশকিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই পানির সীমিত অংশই ব্যবহার করা সম্ভব হয়। এ সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রবাহিত পানি সংরক্ষণের জন্য কোন ভূ-পৃষ্ঠস্থ সংরক্ষণাধার না থাকা এবং গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের গতিপ্রবাহে বাঁধ ব্যতীত অভিকর্ষীয় উপায়ে পানি প্রত্যাহারের খুবই কম সুযোগ থাকা। বিদ্যমান অবস্থায় এই দুই প্রধান নদনদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত পানির বার্ষিক পরিমাণ ভারত থেকে আগত পানির প্রায় সমপরিমাণ। বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাহারকৃত পানির পরিমাণ খুবই সামান্য। সর্বাধিক পানির চাহিদাপূর্ণ শুষ্ক মার্চ মাসে পানি সাম্য সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে যে সেচের জন্য এই মাসে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পানি ব্যবহূত হলেও নিট পানি প্রত্যাহারের পরিমাণ মোট অন্তঃপ্রবাহের মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ।
সেচকার্যে ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসসমূহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। শীত মৌসুমে স্বল্প বৃষ্টিপাত এবং নদনদী ও খালবিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বোরো ধান চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে উজানে অবস্থিত দেশগুলো কতৃক আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো থেকে ক্রমবর্ধমান হারে পানি প্রত্যাহারের দরুন এ সকল নদীর মাধ্যমে দেশে আগত পানির পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে।
পানির গুণাগুণ প্রধানত পৌরবর্জ্য এবং শিল্প কারখানা থেকে নদনদীতে সরাসরি নির্গত অশোধিত বর্জ্যের দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি দূষিত হয়ে থাকে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রধানত ট্যানারী বর্জ্য এবং গৃহস্থালি বর্জ্যের কারণে এমনটি হচ্ছে। অন্যান্য শিল্পনগরী যেমন, খুলনা ও চট্টগ্রামের নিকটে অবস্থিত নদীগুলোও দূষিত হয়ে পড়েছে। কোন কোন স্থানে ডায়িং বা রংকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও মারাত্মক পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। নদী কর্তৃক অধিক পরিমাণে বাহিত পলল পানির গুণাগুণে সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে, কারণ সেক্ষেত্রে শোধন ব্যতীত বিভিন্ন প্রয়োজনে পানির ব্যবহার অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পাবনা, আটঘড়িয়া, ঠাকুরগাঁও, আশুগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের ভূগর্ভস্থ পানিতে লৌহের উপস্থিতি নির্ণয় করা গিয়েছে। গভীরতর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে সাধারণভাবে এই সমস্যার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ বর্তমানে ব্যাপক রূপ লাভ করেছে। আর্সেনিক দূষিত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করার কারণে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল সর্বাধিক আর্সেনিক দূষণ কবলিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দেশে বিদ্যমান আর্সেনিক সমস্যার কারণ নির্ণয় এবং তা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে সমীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোন পূর্ণাঙ্গ সফলতা অর্জিত না হলেও বিভিন্ন ফিল্টার পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আর্সেনিক দূরীকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একমাত্র কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে আর্সেনিক ঝুঁকি এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি পান বন্ধ করা এবং বিকল্প হিসেবে পুকুর ও বৃষ্টির পানি তথা ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা।
জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা (National Water Plan) যুুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর (IECO) সহায়তায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড) পানি সম্পদের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ সালে প্রথম একটি রীতিবদ্ধ এবং সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং সেসময় পানি সম্পদের একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণীত হয়। এই মাস্টার প্ল্যানে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের ওপর প্রধানত জোর দেওয়া হয় এবং এ লক্ষ্যে মূলত বিশাল এলাকাজুড়ে বন্যা প্রতিরোধী ভেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে দেশের ব্যাপক এলাকাকে বন্যামুক্ত করার কথা বলা হয়। ১৯৮৫ সালের মধ্যে ৫৮টি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রায় ১২ মিলিয়ন একর জমিকে বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন সুবিধা প্রদান এবং প্রায় ৮ মিলিয়ন একর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে মাস্টার প্ল্যানে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ সকল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৯৯৬০ মিলিয়ন রুপি (তৎকালীন মূল্যে ২,১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার) এবং বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয় ১৯৮৫ সাল নাগাদ ২১ বছর। অধিকাংশ প্রকল্পই ১৯৬০ এর দশকের মধ্যভাগ থেকে ১৯৮০ এর দশকের মধ্যভাগে বাস্তবায়িত হয়। এ সকল প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্প (Coastal Embankment Project), যা ১৯৮০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হয় এবং এর মাধ্যমে ৯,৫০,০০০ হেক্টর জমিকে বন্যামুক্ত করা হয়; ব্রহ্মপুত্র ডানতীর ভেড়িবাঁধ প্রকল্প (Brahmaputra Right Embankment Project), যার মাধ্যমে ২,২৫,৯০০ হেক্টর জমিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন সুবিধার আওতায় আনা হয়। প্রকল্পটি ১৯৭০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (G-K Project) প্রথম পর্যায়য়ে ৪৮,০০০ হেক্টর জমিতে খরিপ সেচ সুবিধা প্রদান করা হয় এবং ১৯৭০ সালের মধ্যে তা সম্পন্ন করা হয়। ১৯৬৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা সেচ স্কীমে মাধ্যমে ৪,০০০ হেক্টর জমিকে বন্যামুক্ত ও সেচ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হলেও বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর পরিধি সম্প্রসারণের ফলে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে।
১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) চলন বিল প্রকল্প, ঢাকা দক্ষিণ-পশ্চিম প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, কর্ণফুলি সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, মেঘনা-মুহুরী ট্রান্সফার স্কীমসহ নির্ধারিত সমকালের মধ্যে বাস্তবায়িত সকল বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বৃহৎ কর্মসূচির প্রস্তাবনাও প্রণয়ন করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার দীর্ঘমেয়াদি পানি সম্পদ উন্নয়ন কৌশল প্রস্তাব করে যাতে এই মেয়াদকালে একটি জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা (NWP) প্রণয়ন করা যায়। জাতীয় পানি সম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যক্রমসমূহ তত্ত্বাবধান ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় পানি সম্পদ কাউন্সিল (NWC) গঠন করা হয়। একই সময় মাস্টার প্ল্যান অর্গানাইজেশন (Master Plan Organization)-এম.পি.ও গঠন করা হয় এবং এটিকে জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এম.পি.ও ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং ১৯৯১ সালে এটিকে হালনাগাদ করে। ১৯৯২ সালে এম.পি.ও- কে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা বা সংক্ষেপে ‘ওয়ারপো’ হিসেবে পুনর্নামকরণ করা হয়। ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার পর বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও বন্যা ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা (Flood Action Plan- FAP) প্রণয়নের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন লাভ করা যায়। ১১টি প্রধান এবং ১৫টি সহায়ক সমীক্ষা সম্বলিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বা ‘ফ্যাপ’-এর কার্যক্রম ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদে সম্পন্ন হয়। দাতাগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তা, বিশ্বব্যাঙ্কের সমন্বয় এবং দেশি-বিদেশি একাধিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতায় বৃহৎ মাত্রার বন্যা সমীক্ষা কার্যক্রম-ফ্যাপ পরিচালিত হলেও বন্যা সমস্যার সমাধানে বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়নে এর অর্জন ছিল খুবই সামান্য। শুধুমাত্র ১৯৯৫ সালে প্রণীত বাংলাদেশ পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা কৌশল রিপোর্টটি ছিল ফ্যাপের উল্লেখযোগ্য অবদান, যা ১৯৯৮ সালে পরিমার্জন করা হয়। ১৯৯৮ সালে ওয়ারপো পুনরায় জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (National Water Management Plan-NWMP) প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত হয় এবং ২০০১ সালের মার্চ মাসে তা সম্পন্ন করা হয়। জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা চারটি প্রধান উপাদানে গঠিত, যথা: (১) উন্নয়ন কৌশল - জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ইস্যুর বর্ণনা সম্বলিত একটি ঐকমত্যপূর্ণ দলিল; (২) পানি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি - ২০২৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি অঞ্চল এবং জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন উপযোগী কাঠামোগত (structural) এবং অ-কাঠামোগত (non-structural) পদক্ষেপসমূহ চিহ্নিত ও মূল্যায়ন করা; (৩) জাতীয় পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় ‘ওয়ারপো’ প্রস্ত্ততকৃত জাতীয়, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক প্রকল্পসমূহের বিনিয়োগ তালিকা এবং (৪) গঙ্গা নির্ভর অঞ্চল সমীক্ষা - ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৃষ্ট হওয়া সুযোগ সুবিধাসমূহ পর্যালোচনা করা।
এই প্রকল্পের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জনসমূহ হচ্ছে জাতীয় পানি সম্পদ ডাটাবেস (National Water Resources Database) তৈরি করা, জনগণের অংশগ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা, পানি সম্পদ খাতের প্রকল্পসমূহের ক্ষেত্রে ওয়ারপো’র ছাড়পত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করা, এবং আইনগত সংস্কার, নীতিমালা প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণকারী ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলী এবং পরিবেশ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রসঙ্গে রিপোর্ট প্রণয়ন।
জাতীয় পানি নীতি' (National Water Policy) পানি সম্পদ ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পানি সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং কাঙ্খিত উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত বিধিমালা। ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-পৃষ্ঠ উভয় উৎস থেকে প্রাপ্ত পানির যৌথ ব্যবহারের ওপর এই পানি নীতি গুরুত্ব প্রদান করেছে। নদী অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, পানির অধিকার ও তার সুষ্ঠু বণ্টন, সরকারি ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্তকরণ, সরকারি বিনিয়োগ, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, মৎস্যসম্পদ, নৌচলাচল, কৃষি, শিল্প ও পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে পানি নীতিতে নির্দেশনা ও নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে।
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বছরের শুষ্ক মৌসুমে ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে উভয় দেশের মধ্যে নিম্নের ফর্মুলা অনুযায়ী পানি বণ্টিত হবে।
চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমের মার্চ মাসের ১১ তারিখ থেকে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত প্রতি ১০ দিন অন্তর অন্তর ছয়টি পর্যায়ে উভয় দেশ কমপক্ষে ৩৫,০০০ কিউসেক পানি লাভ করার গ্যারান্টি অর্জন করেছে। ফারাক্কা পয়েন্টে যদি কোন কারণে গঙ্গার পানি প্রবাহ ৫০,০০০ কিউসেকের নিচে নেমে যায় সেক্ষেত্রে উভয় দেশ জরুরী আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক কারও কোন প্রকার ক্ষতি না করে সমতার নীতিতে গঙ্গার পানি বণ্টন করে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। অধিকন্তু ভারত ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার নিম্নপ্রবাহে পানি প্রত্যাহারের সীমা সর্বোচ্চ ২০০ কিউসেক পর্যন্ত বজায় রাখবে। সেইসঙ্গে ভারত নদীটির জলপ্রবাহের মাত্রা বিগত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। [মোহাম্মদ ফজলুল বারী]