বৈদেশিক বাণিজ্য
বৈদেশিক বাণিজ্য পুঁজি জাতীয় পণ্য, শিল্প কারখানার জন্য কাঁচামাল, জ্বালানি সামগ্রী ও নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিক থেকে বাংলা একটি রপ্তানিকারক এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছিল এবং ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে উদ্বৃত্ত ছিল। রেশম, সুতিবস্ত্র এবং নানা ধরনের খাদ্যপণ্যের সস্তামূল্যের কারণে এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসা শুরু করে। সপ্তদশ শতকেই ব্রিটেন, হল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক ও আরও অনেক দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলায় কুঠি প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় তারা মূলত সোনা ও রুপার বিনিময়ে বাংলার বিভিন্ন পণ্য কিনে নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করত। ১৬০০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় তার অফিস প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৬০৮ সালে সুরাটে তার প্রথম বাণিজ্য পোত স্থাপন করে। পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্যের কারণে ব্রিটিশ বণিকরা ভারত থেকে সমুদ্রপথে রপ্তানি সম্প্রসারণে নানা রকম বাধা-বিপত্তিতে পড়ে। সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে সুবাদার কাশিম খান ১৬৩২ সালে হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করেন। সুবাহদার শাহ সুজার আমল (১৬৫১) থেকে বাংলায় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বণিকরা কর অব্যাহতি ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে থাকে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অধিকার পায় ১৭১৭ সালে, সম্রাট ফররুখশিয়ারের একটি বিশেষ ফরমানের মাধ্যমে। ইংরেজদের একাধিপত্য থাকলেও বাংলায় ফরাসি এবং ওলন্দাজ বণিকদের ব্যবসায় অব্যাহত ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিসমূহ বাংলা থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি করত সেগুলির তালিকায় মূলত ছিল সিল্ক, সুতিবস্ত্র, সোরা এবং আফিম। অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে রপ্তানি হতো চিনি, চাল, গম, ঘি, সরিষার তেল, মোম, সোহাগা, লাক্ষা, কড়ি ও চটের বস্তা। তবে ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে পণ্য কিনে শুধু ইউরোপেই রপ্তানি করত না, এসব পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্যেও যেত। বিদেশি বণিকদের সঙ্গে কারবারের সূত্র ধরে ক্রমশ একটি দেশীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এবং তারাও বিদেশে পণ্য রপ্তানি শুরু করে। অনেকে নিজেরাই মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নানা দেশে গিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।
রপ্তানিমুখী বৈদেশিক বাণিজ্য বাংলার অর্থনীতিতে স্থানীয় বাজার সৃষ্টি বা রপ্তানি পণ্যের বর্ধিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনের উন্নততর ভিত্তিগঠন কোন অর্থেই তেমন একটা প্রভাব ফেলে নি। অথচ এ সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য নানাবিধ সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। সে তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় নি, বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলার আমদানি চাহিদা। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বাংলা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাজার হারাতে থাকে এবং একই সঙ্গে বিদেশি পণ্য আমদানির ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের শেষ অবধি অব্যাহত থাকে এবং এর সব কুফল নিয়েই পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তান সরকার যে বাণিজ্য নীতি পরিচালনা করে তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল ও কৃষিপণ্য জাতীয় সকল প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি করা। পাকিস্তান সরকারও পূর্ব পাকিস্তানে স্থানীয় শিল্পভিত্তি গড়ে তোলার দিকে তেমন নজর দেয় নি।
বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য খাতের অংশ সর্বদাই খুব কম ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে, ১৯৬১-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান মোট ৩৫ কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানি করে এবং ঐ বছর তার আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৮.১ কোটি ডলার। এই হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যের পরিমাণ ধরা হয় নি। মুক্তিযুদ্ধের বছরে ব্যাপক মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতির কারণে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরবর্তী বছরগুলিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৮.৩ কোটি ডলার আর আমদানি ব্যয় ছিল ১৪০.৩ কোটি ডলার। পরবর্তী ১৫ বছর ধরে বার্ষিক আমদানি ব্যয় বার্ষিক রপ্তানি আয়ের মোটামুটি তিনগুণ পরিমাণ বহাল ছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে বর্ধিত পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি বহন করতে থাকে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩২৫ কোটি টাকা, যা ১৯৯১-৯২ এবং ১৯৯৬-৯৭ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫,১৫৬ কোটি এবং ১১,৬০৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে সেগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে গার্মেন্টস সামগ্রী, হিমায়িত খাদ্য এবং চামড়া। আমদানি ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশই যায় মূলধন জাতীয় পণ্য ক্রয়ে। অন্যান্য প্রধান আমদানি পণ্য হচ্ছে খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, তুলা, পেট্রোলিয়াম, কাপড় এবং সিমেন্ট। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী ত্রিশ বছরে আমদানি ও রপ্তানি উভয় খাতেই পণ্যকাঠামোতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। তেমনি আমদানি ও রপ্তানির ভৌগোলিক বণ্টনও যথেষ্ট পাল্টে গেছে।
নীচের সারণিতে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় এবং দেশের বিদ্যমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কাঠামোর একটি চিত্র তুলে ধরা হল।
বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য (১০ লক্ষ টাকায়)
পণ্য তালিকা | আমদানি ব্যয় | রপ্তানি ব্যয় | ||
১৯৯৯-২০০০ | ২০০৭-২০০৮ | ১৯৯৯-২০০০ | ২০০৭-২০০৮ | |
প্রাথমিক পণ্য১ | ৯৮০ | ৩৪৫৫ | ৪৬৯ | ৯৮৮ |
ফিনিশড পণ্য২ | ১২০৪ | ৪৮৪৪ | ৫২৮৩ | ১৩১২৩ |
ক্যাপিটাল পণ্য | ৩১৪ | ১৬৬৪ | - | - |
অন্যান্য | ৫৮৭৬ | ১১৬৬৬ | - | - |
মোট | ৮৩৭৪ | ২১৬২৯ | ৫৭৫২ | ১৪১১১ |
বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্য (১০ লক্ষ টাকায়)
১ আমদানি: চাল, গম, তেলবীজ, অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, কাঁচা তুলা;
রপ্তানি: পাট, চা, হিমায়িত খাদ্য, অন্যান্য কৃষিপণ্য;
২ আমদানি: ভোজ্যতেল, পেট্রোলিয়াম পণ্য, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্টাপল ফাইবার, সুতা;
রপ্তানি: পাটজাত দ্রব্য, চামড়া, ন্যাফথা, ফার্নেস ওয়েল এবং বিটুমিন, তৈরিপোশাক, নীটওয়ার, রাসায়নিক পণ্য, কারুশিল্প, জুতা, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, অন্যান্য শিল্প পণ্য।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪,১৮০ কোটি টাকা এবং এটি ছিল ঐ বছরের রপ্তানি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ (১.৯ গুণ)। মোট আমদানি ব্যয়ের ৮০.৫% ছিল নগদে আমদানি এবং বিনিময় বাণিজ্য, ওয়েজ আর্নার্স খাতে আমদানি এবং ঋণ অনুদান খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ০.৫%, ৯.৯% এবং ৯.১%। নগদে আমদানির আওতায় প্রধান যেসব পণ্য কেনা হয়েছিল সেগুলি হচ্ছে তুলা (১৮%), যন্ত্রসরঞ্জাম ও তাদের খুচরা যন্ত্রাংশ (৮.২%), খনিজ জ্বালানি ও তাদের থেকে পরিশোধনকৃত পণ্য (৭.৬%), লোহা ও ইস্পাত (৫.২%), কৃত্রিম তন্তু (৪.৩%), লবণ, গন্ধক, পাথর, চুনাপাথর ও সিমেন্ট (৪.২%), প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জাত চর্বি (৪%), বৈদ্যুতিক যন্ত্রসরঞ্জাম (৩%), নৌকা, জাহাজ ও অন্যান্য ভাসমান যানসামগ্রী (২.৮%), সেলাই ও বুনন সামগ্রী (২.৭%), প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক দ্রব্যাদি (২.৬%), রেল ব্যতীত অন্যান্য যানবাহন ও সেগুলির খুচরা যন্ত্রাংশ (২.৪%), কাগজ ও পেপার-বোর্ড সামগ্রী (২.১%), জৈব রসায়ন সামগ্রী (১.৯%), খাদ্যশস্য (১.৮%) এবং সার (১.৬%)। নগদে আমদানির উৎস-দেশসমূহের শীর্ষ ১৫টির তালিকায় ছিল ভারত (১৭.২%), চীন (১০.২%), হংকং (৭.৬%), দক্ষিণ কোরিয়া (৬.৬%), জাপান (৫.৯%), তাইওয়ান (৫.৬%), সিঙ্গাপুর (৫.৫%), যুক্তরাষ্ট্র (৫%), মালয়েশিয়া (৩.৯%), যুক্তরাজ্য (৩%), অস্ট্রেলিয়া (২.৮%), জার্মানি (২.৫%), ইন্দোনেশিয়া (২.৪%), সৌদি আরব (১.৬%), এবং পাকিস্তান (১.২%)। বাংলাদেশ যেসব দেশের সঙ্গে বিনিময় বাণিজ্য পরিচালনা করে সেগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে রাশিয়া, চীন ও হাঙ্গেরি এবং এসব দেশ থেকে সাধারণত যন্ত্রসরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ, রেলওয়ে ইঞ্জিন ও বগি আমদানি করা হয়। ওয়েজ আর্নার্স স্কিমের অধীনে বাংলাদেশ বহু দেশ থেকেই নানারকম পণ্য আমদানি করে, তবে এসব দেশের মধ্যে প্রধান হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এবং আমদানিকৃত পণ্যতালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যন্ত্রসরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ, ভোজ্যতেল, বৈদ্যুতিক পণ্যসামগ্রী, পানীয় ও তামাক জাতীয় পণ্যাদি। ১৯৯৬-৯৭ সালে বাংলাদেশ ঋণ-অনুদান খাতে আমদানির মূল্য ছিল মোট ৫,৪২০ কোটি। এর প্রায় ৪০% ছিল অনুদান হিসেবে আমদানিকৃত খাদ্যশস্য।
আমদানির মতো বাংলাদেশের রপ্তানিও প্রধানত নগদে পরিচালিত হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে মোট রপ্তানির মাত্র ০.৫% ছিল বিনিময় চুক্তির আওতায়। নগদে রপ্তানিকৃত প্রধান প্রধান পণ্য ছিল গার্মেন্টস ও হোসিয়ারি সামগ্রী (৬৬.৩%), পাটজাত দ্রব্যাদি (৮.৭%, চিংড়ি (৮.২%), চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি (৫.৯%) কাঁচা পাট (৩.৫%), মাছ (১.১%), এবং চা (০.৯%)। ভোগ্যপণ্য ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যসামগ্রীর অংশ ছিল যথাক্রমে ৮৭.৫% এবং ১২% আর মূলধন জাতীয় সামগ্রী বা সেসবের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৫%। বাংলাদেশের রপ্তানির সিংহভাগ দখল করে আছে তৈরি পোশাক এবং নীটওয়ার পণ্য। ১৯৯৯-২০০০ সালে রপ্তানিতে এ দুটো পণ্যের অংশ ছিল যথাক্রমে ৫৩.৬% এবং ২২%। ২০০৭-০৮ সালে এই হার হলো যথাক্রমে ৪২.৪% ও ৪৫.৫%। বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রীর প্রধান প্রধান ক্রেতার তালিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র (৩১.৫%), যুক্তরাজ্য (১০.৩%), জার্মানি (৯.৮%), ফ্রান্স (৭.১%), নেদারল্যান্ডস (৫.২%), ইতালি (৫%), বেলজিয়াম (৪.৮%), হংকং (২.৮%), জাপান (২.৫%) এবং কানাডা (১.৭%)। ১৯৯১-৯২ সালে আমদানি ছিল মোট জাতীয় আয়ের ১১%, যা ১৯৯৫-৯৬ সালে ১৫.৪% এ উন্নীত হয়। এই দুই বছর রপ্তানি ছিল জাতীয় আয়ের যথাক্রমে ৬.২% এবং ৮.৮%। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে আমদানির পণ্যকাঠামো মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। মোট আমদানিতে ভোগ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্যে আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি, মূলধন জাতীয় পণ্য এবং সেগুলির আনুষঙ্গিক পণ্যাদির অংশ ছিল যথাক্রমে ৩৯%, ২৯%, ১৪% এবং ১৮%। মোট আমদানির মাত্র এক-চতুর্থাংশ বেসরকারি খাতে সম্পন্ন হয়, বাকি অংশ আমদানি করে বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থা। তবে রপ্তানির ৯৯.৪% শতাংশই করে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই সমুদ্রপথে পরিচালিত হয়। ১৯৯৫/৯৬ সালে সমুদ্র (নৌ), আকাশ ও স্থলপথে আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮১.৫%, ৫.২% এবং ১৩.৩%। ঐ বছর রপ্তানির ৯৮.৪% অনুষ্ঠিত হয় সমুদ্রপথে, ১.৬% যায় বিমান পথে। আমদানি ও রপ্তানি মূল্যের তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় আমদানি মূল্য রপ্তানি মূল্যের তুলনায় অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য শর্তে ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। ১৯৮৯-৯০ সালে বাণিজ্য শর্ত ছিল ৯২.৮%, ১৯৯৪-৯৫ সালে তা দাঁড়ায় ১০০.১%।
বাংলাদেশের সরকারি অর্থনৈতিক নীতিমালায় পরিবর্তনের ধারা অনুযায়ী বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের নীতিতেও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন এসেছে। দেশে একসময় শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাত গড়ে তোলার নীতি গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে সরকার এই নীতি থেকে খোলা বাজার অর্থনীতির নীতিতে সরে আসে এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাঠামোতে শিল্পনীতি বাস্তবায়নের কর্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসমূহের লক্ষ্য দাঁড়ায় দেশের শিল্পায়ন ও দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার লক্ষ্যে অপ্রচলিত খাতের পণ্যাদি এবং যেসব পণ্য অধিকতর মূল্য সংযোজন ঘটায় সেগুলির রপ্তানিকে অগ্রাধিকার দেয়। সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য হচ্ছে অধিকতর চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি এবং আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে পার্থক্য কমানো। বাংলাদেশ এখন যেসব নতুন ও অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি করে সেগুলি ছাড়াও সম্ভাব্য রপ্তানি তালিকায় আরও যেসব পণ্য সংযোজিত হতে পারে সেগুলি হচ্ছে ফলমূল, সবজি, ফুল, মিঠা পানির চিংড়ি, কম্পিউটার সফটওয়ার, খেলনা ও গহনা সামগ্রী।
১৯৯০-এর দশকে বাণিজ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা অনুসরণ করে এ ধরনের বিবর্তনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। তবে ১৯৮৫ সালে যেখানে নমিন্যাল প্রটেকশন হার ১০০% এর অধিক ছিল তা ১৯৯৬ সালে ২২% এ নেমে আসে। আমদানির ক্ষেত্রে কোটা অনুযায়ী প্রতিরোধের মাত্রা ছিল ৪২% যা ১৯৯৬ সালে দাঁড়ায় মাত্র ২%। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা উদারীকরণের নীতি অনুসরণ করে এবং এর মাধ্যমে উৎপাদনে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। এছাড়া এসবের মাধ্যমে সরকার রপ্তানি ও আমদানি প্রতিস্থাপন উভয় লক্ষ্যে যারা উৎপাদনে নিয়োজিত তাদের প্রতি নিরপেক্ষভাবে প্রণোদনা প্রদান করেছে এবং বাণিজ্য সুগম করাকে শুল্ক প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের অনুসৃত সংস্কার নীতিমালার মধ্যে আছে আমদানি উদারীকরণ, আমদানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ, ট্যারিফ কাঠামো যৌক্তিকীকরণ, ট্যারিফ হার এবং পরিমাণগত বিধিনিষেধ হ্রাসকরণ, নমনীয় বিনিময় হার নীতি অনুসরণ, আইএমএফ-এর নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাউন্টার ট্রেড এবং রপ্তানি সম্প্রসারণের উপযোগী সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ।
১৯৯৭-২০০২ সালের জন্য গৃহীত পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সরকার যে রপ্তানি নীতি গ্রহণ করেছে তার লক্ষ্য হচ্ছে পণ্য বৈচিত্র্যায়ন ও গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য পণ্যসমূহের বিপণনযোগ্যতা বাড়ানো, রপ্তানিমুখী শিল্পের সঙ্গে পশ্চাৎ-অন্বয়ী শিল্প স্থাপনা, স্থানীয় কাঁচামাল ও প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করার উপযোগী সেবাখাত উন্নয়ন, রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপনায় উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং বিদেশে বাংলাদেশি পণ্যসমূহের বাজার বিস্তৃতি ও সুসংহতকরণ।
সরকার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় রপ্তানি কমিশন গঠন করেছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি টাস্ক ফোর্স ও একটি রপ্তানি উন্নয়ন পরিষদ কাজ করছে। কৃষিপণ্য ও সেবাসমূহের আন্তর্জাতিক বাজার যে মুক্ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন তার প্রভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ঠ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া, বাণিজ্য উন্নয়ন ও জাতীয় বিনিয়োগ কর্মকান্ড বিষয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশকে তার সমাধান করে এগুতে হবে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের ওপর অধিক নির্ভর করতে হচ্ছে এবং আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হচ্ছে। [এস.এম মাহফুজুর রহমান]