হান্টার, স্যার উইলিয়ম উইলসন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
'''হান্টার, স্যার উইলিয়ম উইলসন '''(১৮৪০-১৯০০) ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য, বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও সংকলক এবং একজন ঐতিহাসিক। গোত্র, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব, কূটনীতি ও সাংবাদিকতায় তাঁর ছিল প্রগাঢ় আগ্রহ। | '''হান্টার, স্যার উইলিয়ম উইলসন''' (১৮৪০-১৯০০) ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য, বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও সংকলক এবং একজন ঐতিহাসিক। গোত্র, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব, কূটনীতি ও সাংবাদিকতায় তাঁর ছিল প্রগাঢ় আগ্রহ। | ||
[[Image:HunterWilliamWilson.jpg|thumb|right|স্যার উইলিয়ম উইলসন হান্টার]] | |||
হান্টার ১৮৪০ সালের ১৫ জুলাই গ্লাসগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এন্ড্রু হান্টার উৎপাদনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পিতামাতার তিন ছেলের মধ্যে হান্টার ছিলেন দ্বিতীয়। হ্যামশায়ারের কুইন্সউডে কোয়েকার সেমিনারীতে ১৮৫৪ সালে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এখানে বছরখানেক সাফল্যজনক পড়াশুনার পর তিনি গ্লাসগো অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। পরে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রসায়ন, যুক্তিবিদ্যা, ল্যাটিন ভাষা, গ্রিক ভাষা, অঙ্কশাস্ত্র, নৈতিক দর্শন ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৮৬০ সালের এপ্রিলে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সুযোগসুবিধা হান্টারকে প্রলুব্ধ করেছিল। এতদিন ভারতে এই চাকরিগুলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের পোষ্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের জন্য একান্তভাবে সংরক্ষিত ছিল। সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা চালু হওয়ার ফলে সাম্রাজ্যের যুবকদের জন্য তাদের ভাগ্য পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৮৬২ সালে হান্টার ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে চাকরি করার জন্য মনস্থির করেন। | হান্টার ১৮৪০ সালের ১৫ জুলাই গ্লাসগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এন্ড্রু হান্টার উৎপাদনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পিতামাতার তিন ছেলের মধ্যে হান্টার ছিলেন দ্বিতীয়। হ্যামশায়ারের কুইন্সউডে কোয়েকার সেমিনারীতে ১৮৫৪ সালে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এখানে বছরখানেক সাফল্যজনক পড়াশুনার পর তিনি গ্লাসগো অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। পরে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রসায়ন, যুক্তিবিদ্যা, ল্যাটিন ভাষা, গ্রিক ভাষা, অঙ্কশাস্ত্র, নৈতিক দর্শন ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৮৬০ সালের এপ্রিলে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সুযোগসুবিধা হান্টারকে প্রলুব্ধ করেছিল। এতদিন ভারতে এই চাকরিগুলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের পোষ্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের জন্য একান্তভাবে সংরক্ষিত ছিল। সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা চালু হওয়ার ফলে সাম্রাজ্যের যুবকদের জন্য তাদের ভাগ্য পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৮৬২ সালে হান্টার ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে চাকরি করার জন্য মনস্থির করেন। | ||
হান্টার ১৮৬২ সালের নভেম্বরে বাংলায় পৌঁছেন। ১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে ভাষাগত যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বীরভূম জেলায় সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কুষ্টিয়ায় শ্রমিক পরিবহণ তত্ত্বাবধায়ক, স্কুল পরিদর্শক এবং স্ট্যাম্প ও স্টেশনারি তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৬৯ সালের জুলাই মাসে তার চাকরি ভারত সরকারের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং তাঁকে Bengal Gazetteer এর সংকলক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীসময়ে ১৮৭১ সালের জানুয়ারিতে তিনি Gazetteer of India সংকলকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে তাঁর জন্য ভারত সরকারের Director-General of Statistics পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এই পদে যোগ দেন। The Statistical Account of Bengal ([[স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল|স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল]]) এবং The Imperial Gazetteer of India সংকলনের কাজে ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের অর্ধেক সময় তাকে ইংল্যান্ডে কাটাতে হতো। | হান্টার ১৮৬২ সালের নভেম্বরে বাংলায় পৌঁছেন। ১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে ভাষাগত যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বীরভূম জেলায় সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কুষ্টিয়ায় শ্রমিক পরিবহণ তত্ত্বাবধায়ক, স্কুল পরিদর্শক এবং স্ট্যাম্প ও স্টেশনারি তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৬৯ সালের জুলাই মাসে তার চাকরি ভারত সরকারের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং তাঁকে Bengal Gazetteer এর সংকলক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীসময়ে ১৮৭১ সালের জানুয়ারিতে তিনি Gazetteer of India সংকলকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে তাঁর জন্য ভারত সরকারের Director-General of Statistics পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এই পদে যোগ দেন। The Statistical Account of Bengal ([[স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল|স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল]]) এবং The Imperial Gazetteer of India সংকলনের কাজে ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের অর্ধেক সময় তাকে ইংল্যান্ডে কাটাতে হতো। | ||
৩২ নং লাইন: | ৩১ নং লাইন: | ||
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ছাড়াও হান্টার ছিলেন উৎসাহী সাংবাদিক এবং ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখক। ১৮৮৮ সাল থেকে মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পূর্ব পর্যন্ত তিনি দি টাইমস পত্রিকায় Indian Affairs শিরোনামে সাপ্তাহিক ফিচার লিখতেন। টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিশেষ প্রবন্ধগুলি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত The India of the Queen and Other Essays নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়। লেডী হান্টার এ বইয়ের সম্পাদনা করেন এবং হান্টারের জীবনীকার এফ.এইচ স্ক্রিন বইটির ভূমিকা লিখেন। | প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ছাড়াও হান্টার ছিলেন উৎসাহী সাংবাদিক এবং ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখক। ১৮৮৮ সাল থেকে মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পূর্ব পর্যন্ত তিনি দি টাইমস পত্রিকায় Indian Affairs শিরোনামে সাপ্তাহিক ফিচার লিখতেন। টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিশেষ প্রবন্ধগুলি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত The India of the Queen and Other Essays নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়। লেডী হান্টার এ বইয়ের সম্পাদনা করেন এবং হান্টারের জীবনীকার এফ.এইচ স্ক্রিন বইটির ভূমিকা লিখেন। | ||
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রশাসক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে হান্টার প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দৃষ্টবাদী মতাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ভারতের মহাফেজখানা থেকে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেন। ফলে ভারতের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা লব্ধ ইতিহাস জ্ঞান ও তথ্য বিশাল সহায়ক তথ্যশালার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাস্তবিক পক্ষে পাশ্চাত্য জগতে ভারত সম্পর্কিত জ্ঞান বিস্তারে হান্টারের চেয়ে বেশি অবদান খুব কম পন্ডিতই রাখতে পেরেছেন। হান্টার ১৯০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওকেন হল্টে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। | অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রশাসক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে হান্টার প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দৃষ্টবাদী মতাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ভারতের মহাফেজখানা থেকে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেন। ফলে ভারতের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা লব্ধ ইতিহাস জ্ঞান ও তথ্য বিশাল সহায়ক তথ্যশালার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাস্তবিক পক্ষে পাশ্চাত্য জগতে ভারত সম্পর্কিত জ্ঞান বিস্তারে হান্টারের চেয়ে বেশি অবদান খুব কম পন্ডিতই রাখতে পেরেছেন। হান্টার ১৯০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওকেন হল্টে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। [এম দেলওয়ার হোসেন] | ||
[এম দেলওয়ার হোসেন] | |||
গ্রন্থপঞ্জি Francis Henry Skrine, Life of Sir William Wilson Hunter, London, 1901; M Delwar Hussain, 19th Century Indian Historical Writing In English, Dhaka, 1992. | '''গ্রন্থপঞ্জি''' Francis Henry Skrine, Life of Sir William Wilson Hunter, London, 1901; M Delwar Hussain, 19th Century Indian Historical Writing In English, Dhaka, 1992. | ||
[[en:Hunter, Sir William Wilson]] | [[en:Hunter, Sir William Wilson]] |
০৬:২৩, ২৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
হান্টার, স্যার উইলিয়ম উইলসন (১৮৪০-১৯০০) ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য, বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও সংকলক এবং একজন ঐতিহাসিক। গোত্র, ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব, কূটনীতি ও সাংবাদিকতায় তাঁর ছিল প্রগাঢ় আগ্রহ।
হান্টার ১৮৪০ সালের ১৫ জুলাই গ্লাসগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এন্ড্রু হান্টার উৎপাদনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পিতামাতার তিন ছেলের মধ্যে হান্টার ছিলেন দ্বিতীয়। হ্যামশায়ারের কুইন্সউডে কোয়েকার সেমিনারীতে ১৮৫৪ সালে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এখানে বছরখানেক সাফল্যজনক পড়াশুনার পর তিনি গ্লাসগো অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। পরে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রসায়ন, যুক্তিবিদ্যা, ল্যাটিন ভাষা, গ্রিক ভাষা, অঙ্কশাস্ত্র, নৈতিক দর্শন ও নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৮৬০ সালের এপ্রিলে ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সুযোগসুবিধা হান্টারকে প্রলুব্ধ করেছিল। এতদিন ভারতে এই চাকরিগুলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের পোষ্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের জন্য একান্তভাবে সংরক্ষিত ছিল। সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা চালু হওয়ার ফলে সাম্রাজ্যের যুবকদের জন্য তাদের ভাগ্য পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৮৬২ সালে হান্টার ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে চাকরি করার জন্য মনস্থির করেন।
হান্টার ১৮৬২ সালের নভেম্বরে বাংলায় পৌঁছেন। ১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে ভাষাগত যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বীরভূম জেলায় সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কুষ্টিয়ায় শ্রমিক পরিবহণ তত্ত্বাবধায়ক, স্কুল পরিদর্শক এবং স্ট্যাম্প ও স্টেশনারি তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৬৯ সালের জুলাই মাসে তার চাকরি ভারত সরকারের অধীনে ন্যস্ত করা হয় এবং তাঁকে Bengal Gazetteer এর সংকলক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীসময়ে ১৮৭১ সালের জানুয়ারিতে তিনি Gazetteer of India সংকলকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করেন। ইতোমধ্যে তাঁর জন্য ভারত সরকারের Director-General of Statistics পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এই পদে যোগ দেন। The Statistical Account of Bengal (স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল) এবং The Imperial Gazetteer of India সংকলনের কাজে ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের অর্ধেক সময় তাকে ইংল্যান্ডে কাটাতে হতো।
১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে হান্টার ভারতে ফিরে আসেন। তাঁকে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে অতিরিক্ত সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১৮৮২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৮৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিনি শিক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এই কমিটি সরকারের নিকট একটি রিপোর্ট পেশ করে। একই সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন। ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ফাইন্যান্স কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। এটিই ছিল চাকরি জীবনে তার শেষ নিযুক্তি। ১৮৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে Companion of the Indian Empire, Commander of the Star of India এবং সর্বশেষে Knight Commander of the Star of India উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
হান্টার বহুবিধ বিষয়ে বিরামহীনভাবে লিখে গেছেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্র-পত্রিকায় লিখে তিনি বাড়তি অর্থসংস্থান করেন। বীরভূম জেলার ইতিহাস সংকলনের কাজে ১৮৬৬ সালের মার্চ মাসে তাঁর নিযুক্তি হান্টারের সাহিত্যিক জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করে। এখানে তিনি ভারতের ইতিহাসের ওপর অনেক অনাবিষ্কৃত তথ্যের সন্ধান পান। এই তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ভারতের ইতিহাসের এক অভিনব ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ The Annals of Rural Bengal, Vol.1 ১৮৬৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। তিনি তিন খন্ডে গ্রন্থটি সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। অবশিষ্ট দুই খন্ড পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ A Comparative Dictionary of the Languages of India and High Asia with a Dissertation ১৮৬৮ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এই উন্নত মানের কাজের জন্য বাংলা সরকার তাঁকে একশ পাউন্ড এবং ভারত সরকার দু হাজার পাউন্ড অনুদান দেন।
The Annals of Rural Bengal এবং Comparative Dictionary of the Languages-এর লেখক তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মেয়োর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি হান্টারকে ১৮৬৯ সালে বেঙ্গল সার্ভিস থেকে ইন্ডিয়ান সার্ভিসে নিয়ে যান। তিনি দীর্ঘ বারো বছর The Gazetteer of India-এর মতো বিশাল কর্মের সংকলন কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ফলপ্রসূ এই বছরগুলিতে তাঁর সম্পাদনায় ও এককভাবে অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ সময়ে তিনি বেশ কিছুসংখ্যক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন এবং আরও কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সর্বোপরি এ সময়ে তিনি বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং অবশিষ্ট জীবনে সেগুলি সফলভাবে কাজে লাগান।
১৮৭১ সালে হান্টারের নতুন গ্রন্থ A Guide to the Orthography of Indian Proper Names, with a list showing the true spelling of all post towns and villages in India প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি ভারতের বিভিন্ন স্থানের নামের বানানে যে সংশয় ও বিভ্রান্তি ছিল তদস্থলে অভিন্ন বানান উপস্থাপন করে। ঊনবিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত তথাকথিত ওহাবী আন্দোলন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখকদের নিকট একটি জনপ্রিয় বিষয় ছিল। হান্টার ছদ্মনামে ক্যালকাটা রিভিউ ও Englishman পত্রিকায় ওহাবী মতবাদের বৈশিষ্ট্য বিশেষণ করে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধগুলি ভাইসরয় লর্ড মেয়োর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অসন্তোষের কারণ বিশেষণ করে একটি গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি হান্টারকে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের ফসল হিসেবে হান্টার রচিত The Indian Musalmans: Are they bound in Conscience to rebel against the Queen ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়।
হান্টারের Rural Annals-এর অবশিষ্ট অংশ Orissa: The Vicissitudes of an Indian province Under Native and British Rule ১৮৭২ সালে দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর Famine Aspects of Bengal Districts ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। Wyllie’s Essays on the External Policy of India গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেন এবং ১৮৭৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়। লর্ড মেয়োর আকস্মিক মৃত্যু হান্টারকে মেয়োর চিন্তাধারা ও নীতির আলোচনা সম্বলিত জীবনকাহিনী প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে। ১৮৭৫ সালে The Earl of Mayo নামে এই জীবনী গ্রন্থটি দুখন্ডে প্রকাশিত হয়।
ভারতে পরিসংখ্যানগত সমীক্ষার ফলাফল ১২৮ খন্ডে প্রকাশিত হয়। হান্টার নিজে ২২ খন্ডের সম্পাদক ছিলেন। তার মধ্যে ২০ খন্ডে The Statistical Account of Bengal ১৮৭৫ ও ১৮৭৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়। The Statistical Account of Assam দুখন্ডে প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালে। ভারতের বাকি প্রদেশগুলির জেলাসমূহের তথ্য সম্বলিত ১০৬ খন্ড ১৮৮০ সালে ছাপা হয়। অন্যদিকে ১২৮ খন্ডে রচিত জেলাসমূহের বিপুল তথ্য Imperial Gazetteer of India-তে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার জন্য হান্টারের প্রচেষ্টা অবিরাম গতিতে চলতে থাকে।
হান্টার ইতোমধ্যে অবশ্য সময় করে অপর একটি ব্যক্তিগত গ্রন্থ রচনা করেন। England’s Work in India শিরোনামের গ্রন্থটি ১৮৮১ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৮৮১ সালে ৯ খন্ডে The Imperial Gazetteer of India-এর সম্পাদনা শেষ করেন। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারের বিষয়াবলির সংক্ষিপ্তসার সম্বলিত কিছু গ্রন্থও তিনি প্রকাশ করেন। এগুলির মধ্যে Indian Empire: Its People, History and Products এবং A Brief History of the Indian People ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়। ‘ইলবার্ট বিল’ বিতর্কে তিনি ইতিবাচক ভূমিকা নেন। এই বিলের ওপর তাঁর বক্তব্য ১৮৮৩ সালে ছাপা হয়। এ সময়ে তিনি Imperial Gazetteer -এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে ১৪ খন্ডে ১৮৮১ সালের আদম শুমারির সর্বশেষ পরিসংখ্যান ও ফলাফল অন্তর্ভুক্ত করে ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৮৮৭ সালে হান্টারের অবসর গ্রহণ থেকে ১৯০০ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সময় ছিল বিস্ময়করভাবে ফলপ্রসূ। অবসর নেওয়ার পর তাঁর প্রথম করণীয় কাজের মধ্যে ছিল অক্সফোর্ডের ক্লেরেন্ডন প্রেসের সাথে চুক্তি সম্পাদন। এ চুক্তিতে ছোট ছোট খন্ডে The Rulers of India নামে এক ধারাবাহিক জীবনী গ্রন্থ রচনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই সিরিজে মোট ২৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নমুনা হিসেবে তিনি ১৮৯০ সালে লর্ড ডালহৌসীর শাসনকালের ওপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে প্রকল্পটির সূচনা করেন এবং ১৮৯১ সালে লর্ড মেয়োর শাসনকাল পর্যন্ত ধারাবাহিক গ্রন্থ রচনা করেন।
ব্যাপক গবেষণাকর্মের সংগঠক ও ঐতিহাসিক ছাড়াও হান্টার ছিলেন মৌলিক সাহিত্যকর্মের প্রণেতা। এই শ্রেণিতে পড়ে The Old Missionary (১৮৯০ সালে প্রকাশিত) এবং The Thakerays in India and Some Calcutta Graves (১৮৯৭ সালে প্রকাশিত)।
হান্টার প্রণীত School History and Geography of Northern India ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় তার দুটি গ্রন্থ Bombay 1885 to 1890 ‰es A Study in Indian Administration. চার খন্ডে তাঁর Bengal Ms. Records with an Historical Dissertation on Land Tenure in Bengal ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর গ্রন্থ The Life of Brian Houghton Hodgson, British Resident at the Court of Nepal ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয়।
এ সকল প্রকাশনার পাশাপাশি হান্টার তাঁর ভারতের ইতিহাস রচনার কাজ করে যাচ্ছিলেন। বাংলায় তাঁর কর্ম জীবনের প্রথম দিকেই তিনি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার মূল পরিকল্পনা ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের ইতিহাস রচনা। কিন্তু জাহাজ ডুবির কারণে অনেক মূল্যবান তথ্য হারিয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি মূল পরিকল্পনা সংকুচিত করেন। পাঁচ খন্ডে তিনি ভারতে ব্রিটিশ রাজ্যের উদ্ভবের ইতিহাস রচনা করেন। তাঁর জীবদ্দশায় ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসে The History of British India গ্রন্থের মাত্র প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। ১৯০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুকালে দ্বিতীয় খন্ডের সাতটি অধ্যায় প্রেসে এবং অষ্টম অধ্যায়টি পান্ডুলিপির আকারে ছিল। তাঁর যোগ্য সহকারী পি.ই রবার্টস তাঁর মৃত্যুর পর ১৯০০ সালের নভেম্বর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ছাড়াও হান্টার ছিলেন উৎসাহী সাংবাদিক এবং ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখক। ১৮৮৮ সাল থেকে মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পূর্ব পর্যন্ত তিনি দি টাইমস পত্রিকায় Indian Affairs শিরোনামে সাপ্তাহিক ফিচার লিখতেন। টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিশেষ প্রবন্ধগুলি ১৯০৩ সালে প্রকাশিত The India of the Queen and Other Essays নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়। লেডী হান্টার এ বইয়ের সম্পাদনা করেন এবং হান্টারের জীবনীকার এফ.এইচ স্ক্রিন বইটির ভূমিকা লিখেন।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রশাসক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে হান্টার প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। দৃষ্টবাদী মতাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি ৩৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ভারতের মহাফেজখানা থেকে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করেন। ফলে ভারতের ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা লব্ধ ইতিহাস জ্ঞান ও তথ্য বিশাল সহায়ক তথ্যশালার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাস্তবিক পক্ষে পাশ্চাত্য জগতে ভারত সম্পর্কিত জ্ঞান বিস্তারে হান্টারের চেয়ে বেশি অবদান খুব কম পন্ডিতই রাখতে পেরেছেন। হান্টার ১৯০০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওকেন হল্টে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। [এম দেলওয়ার হোসেন]
গ্রন্থপঞ্জি Francis Henry Skrine, Life of Sir William Wilson Hunter, London, 1901; M Delwar Hussain, 19th Century Indian Historical Writing In English, Dhaka, 1992.