সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন''' (Sea Level Change) সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় সীমার পরিবর্তন। এটিকে পৃথিবীপৃষ্ঠের উচ্চতা ও গভীরতা মাপার জন্য নির্দেশক রেখা হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীব্যাপী উষ্ণতার ফলশ্রুতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি ইত্যাদি বিষয় বর্তমান যুগে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থলভাগের নিম্ন উচ্চতা, নদীসমূহের স্বল্প নতিক্রম এবং সমুদ্রের কোলে অবস্থিতির কারণে বাংলাদেশ [[জলবায়ু|জলবায়ু]] পরিবর্তন ও সমুদ্র স্ফীতির প্রতিকূল প্রভাবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বন্যা, জলনিকাশ ব্যবস্থা, [[কৃষি|কৃষি]], [[জোয়ারভাটা|জোয়ারভাটা]] ও [[জলাভূমি|জলাভূমি]]র ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায় না। | '''সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন''' (Sea Level Change) সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় সীমার পরিবর্তন। এটিকে পৃথিবীপৃষ্ঠের উচ্চতা ও গভীরতা মাপার জন্য নির্দেশক রেখা হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীব্যাপী উষ্ণতার ফলশ্রুতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি ইত্যাদি বিষয় বর্তমান যুগে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থলভাগের নিম্ন উচ্চতা, নদীসমূহের স্বল্প নতিক্রম এবং সমুদ্রের কোলে অবস্থিতির কারণে বাংলাদেশ [[জলবায়ু|জলবায়ু]] পরিবর্তন ও সমুদ্র স্ফীতির প্রতিকূল প্রভাবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বন্যা, জলনিকাশ ব্যবস্থা, [[কৃষি|কৃষি]], [[জোয়ারভাটা|জোয়ারভাটা]] ও [[জলাভূমি|জলাভূমি]]র ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায় না। | ||
''ইতিহাস'' তামিল, সংস্কৃত এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে (উপনিষদ) বহুকাল আগে থেকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন সম্পর্কে জানা গিয়েছিল। চীনে বহু প্রাচীনকাল থেকে যেমন অষ্টম ও নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে স্থলভাগের পরিবর্তন সমুদ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন স্থলভাগের সাপেক্ষে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে ফ্রিজি (আর.জে.এন ভিভয়, ১৯৮৭-তে) তাঁর থিওরী অব আর্থ রোটেশন-এ ফেনোস্ক্যান্ডিয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের নেমে যাওয়া এবং ভূমধ্যসাগরে এটির স্ফীতি বর্ণনা করেন। স্থলভাগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর আরও মাঠ পর্যায়ের তথ্য-প্রমাণাদি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পাওয়া গিয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাল প্রাচীরের ঊর্ধ্বমুখী ক্রমবৃদ্ধিকে সি.আর ডারউইন (১৮৪২) সমুদ্রতলের নেমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে উলেখ করেছেন। আর.এ ড্যালি (১৯২০) কর্তৃক দৃষ্টান্ত সহযোগে ব্যাখ্যাকৃত সি ম্যাকলারেনের (১৮৪২) হিমযুগীয় সমাস্থিতিক তত্ত্ব বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপকমাত্রায় গ্রহণযোগ্য ছিল। অবশ্য এই পর্যন্ত বঙ্গ অববাহিকার হলোসিন (আজ থেকে এক লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত) সমুদ্রপৃষ্ঠের ইতিহাস পুনর্গঠনে সামান্যই কাজ হয়েছে। এস.পি চ্যাটার্জী (১৯৬১) ভারতীয় উপকূলে সাতটি সামুদ্রিক সোপানের উপস্থিতিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের নমুনা হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর মতে উত্তর হিমযুগীয় সমুদ্র স্ফীতির প্রমাণ ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যকার সংযোগ শৈলশিরা ‘অ্যাডামস ব্রিজ’ যা বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের ৪ মিটার গভীরে নিমজ্জিত। জি.ভি রাজামানিকাম ও ভি.জে লাভসন (১৯৯০) বঙ্গোপসাগরে উত্তর হিমযুগীয় সমুদ্র স্ফীতির প্রমাণস্বরূপ অনেকগুলি উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন। এম উমিতসু (১৯৮৭) বঙ্গ নিম্নভূমির জন্য একটানা আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতি রেখার প্রস্তাবনা করেছেন। এই রেখায় আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ চলমানতার কিছু যুক্তিপূর্ণ তেজস্ক্রিয় কার্বন বয়সের তথ্য আছে। একই বছর এম ব্যানার্জী ও পি.কে সেন বঙ্গ অববাহিকার আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখা অঙ্কন করেন। এম.এইচ মনসুর ও এ.এস.এম.এম কামাল (১৯৯০) কোন নতুন রেখার প্রস্তাবনা না করে আর.ডবিও ফেয়ারব্রিজের (১৯৬১) পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখা বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেন এবং বাংলাদেশ উপকূলে প্রায় ৬,০০০ বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতির বিবরণ দেন। অন্যান্য গবেষকরা যেমন পিটার রেভেনসক্রফট (১৯৯৫) এবং এম.এস ইসলাম (১৯৯৬) বাংলাদেশের জন্য হলোসিন আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখার (Holocene Relative Sea level change) প্রস্তাবনা করেন। | |||
''সমুদ্রপৃষ্ঠে পরিবর্তন'' বিশ্বব্যাপী গড় সমুদ্রসীমা ভিন্ন ভিন্ন কাল ও স্থানের পরিমাপে কয়েকটি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হচ্ছে। হিমযুগীয় সমাস্থিতিক প্রতিক্ষেপ (glacio-isostatic rebound), সমুদ্রবিদ্যা সংক্রান্ত, বায়ুমন্ডলীয় ও ভূ-গাঠনিক প্রভাবসমূহ এই পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের অস্থিত (eustatic) পরিবর্তন সমুদ্র জলের পরিমাণ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, স্থানিক উত্থান ও অবনমনের কারণে ভিন্ন হতে পারে। | |||
অবক্ষেপের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, নদী-বদ্বীপীয় এলাকার কাছাকাছি কার্যকর হলেও, সারা বিশ্বের নিরিখে তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। স্বল্পকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের (কয়েক বছরব্যাপী) সঙ্গে এল নিনো বা দক্ষিণাঞ্চলীয় দোলনের (southern oscillations) সম্পর্ক রয়েছে। কিছু উপকূল বরাবর স্বল্পমেয়াদি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনে মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও নদী জলনিকাশ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে দৃশ্যমান ১০০ সেমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন সৃষ্টিতে বৃষ্টিপাত ও জলনিকাশ (runoff) উলেখযোগ্য অবদান রাখে। বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন লক্ষণীয় এবং স্ফীততায় পৃথিবীর অনেকগুলির মধ্যে একটি। সাগরটির চোঙার মতো আকৃতির জন্য সর্বোচ্চ মৌসুমি পরিবর্তন দেখা যায় এটির উত্তর-পূর্ব উপকূলে। চট্টগ্রাম উপকূলের বার্ষিক পরিবর্তন হলো ১.১৮ মিটার। | অবক্ষেপের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, নদী-বদ্বীপীয় এলাকার কাছাকাছি কার্যকর হলেও, সারা বিশ্বের নিরিখে তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। স্বল্পকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের (কয়েক বছরব্যাপী) সঙ্গে এল নিনো বা দক্ষিণাঞ্চলীয় দোলনের (southern oscillations) সম্পর্ক রয়েছে। কিছু উপকূল বরাবর স্বল্পমেয়াদি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনে মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও নদী জলনিকাশ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে দৃশ্যমান ১০০ সেমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন সৃষ্টিতে বৃষ্টিপাত ও জলনিকাশ (runoff) উলেখযোগ্য অবদান রাখে। বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন লক্ষণীয় এবং স্ফীততায় পৃথিবীর অনেকগুলির মধ্যে একটি। সাগরটির চোঙার মতো আকৃতির জন্য সর্বোচ্চ মৌসুমি পরিবর্তন দেখা যায় এটির উত্তর-পূর্ব উপকূলে। চট্টগ্রাম উপকূলের বার্ষিক পরিবর্তন হলো ১.১৮ মিটার। | ||
১০ নং লাইন: | ১০ নং লাইন: | ||
বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের বিচলন আঞ্চলিক এবং স্থানীয় উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বঙ্গোপসাগরে গত নয় হাজার ক্যালেন্ডার বছরে পাঁচটি সামুদ্রিক স্ফীতি এবং প্রতিটির সঙ্গে একটি করে সাগরের পশ্চাদ্গতি নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গত ৬৩১৫ হাজার বছর থেকে ৫৯১৫ হাজার বছরের মধ্যে একটি সর্বোচ্চ আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতির মাত্রা হলো বছরে ৩.৬৫ মিমি; হলোসিন সময়ে বঙ্গ অববাহিকায় গড় মাত্রা ছিল বছরে ১.০৭ মিমি। | বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের বিচলন আঞ্চলিক এবং স্থানীয় উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বঙ্গোপসাগরে গত নয় হাজার ক্যালেন্ডার বছরে পাঁচটি সামুদ্রিক স্ফীতি এবং প্রতিটির সঙ্গে একটি করে সাগরের পশ্চাদ্গতি নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গত ৬৩১৫ হাজার বছর থেকে ৫৯১৫ হাজার বছরের মধ্যে একটি সর্বোচ্চ আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতির মাত্রা হলো বছরে ৩.৬৫ মিমি; হলোসিন সময়ে বঙ্গ অববাহিকায় গড় মাত্রা ছিল বছরে ১.০৭ মিমি। | ||
''সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের প্রতিক্রিয়া'' ২০৫০ সালের শেষের দিকে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের সম্ভাব্য স্ফীতি সমুদ্রের পানি দ্বারা সৃষ্ট বড় ধরনের উপকূলীয় পাবনের ইঙ্গিতবাহী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের ১.৪৪ মিটার উত্থানের অর্থ ১৬% স্থলভাগে পাবন, জনসংখ্যার ১৩%- এর স্থানচ্যুতি এবং জিডিপির ১০% ক্ষতি। বঙ্গীয় বদ্বীপের অবনমনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের প্রতিক্রিয়া হবে আরও সঙ্কটপূর্ণ। | |||
''বন্যা ও ভাঙন অবক্ষেপণ'' বাংলাদেশে প্রতি বছর মাঝারি থেকে ব্যাপক বন্যা সংঘটিত হয়। ঘন ঘন ঝড়ঝঞ্ঝা ও ব্যাপক উপকূলীয় বন্যার সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগরে ভরা কটাল বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। দেখা গেছে যে, মাত্র ১.৪ মিটার সমুদ্র স্ফীতির কারণে মেঘনার মোহনার কাছে পানির উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার বৃদ্ধি পায়। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ০.২ মিটার উত্থানের কারণে মোহনার কাছে পানির উচ্চতা ৪.৫ থেকে ৫ মিটার বৃদ্ধি পায়। উপকূল অঞ্চলের অধিকাংশই গড় সমুদ্র সীমার (mean sea level MSL) ১.৫ মিটার উপরে এবং গঙ্গা ও মেঘনা নদীর সঙ্গমের নিকটবর্তী অঞ্চল MSL-এর ৩ মিটার উপরে বিধায় নিমজ্জিত অঞ্চলের গভীরতা ও আয়তন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অবশ্য গঙ্গা ও আপার মেঘনার পানির উচ্চতা প্রবাহের পানিগতিবিদ্যা (hydrodynamics) পরিবর্তন হেতু বিপরীত প্রবাহের (backwater) প্রভাবের কারণেও উলেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফলে বন্যার তীব্রতা ও ব্যাপকতা নদীর উজান অঞ্চলেও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি তটরেখাকেও স্থলভাগ অভিমুখে ঠেলে আনবে, যার পরিণতি কৃষিজমির হ্রাস যা কেবল চাষাবাদেরই পরিবর্তন ঘটাবে না, বরং শস্য উৎপাদন হ্রাস ও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত করবে। অতিরিক্ত বন্যা বর্তমান সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায়ও সমস্যার সৃষ্টি করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও এর সঙ্গে যুক্ত বিপরীত প্রবাহ প্রভাবের কারণে ভাঙন-উপলেপ (erosion-sedimentation) প্রণালী পরিবর্তিত হবে। বিপরীত প্রবাহ প্রভাবের কারণে নদীসমূহের ক্ষরণ (discharge) ক্ষমতা হ্রাস পাবে, যার ফলে অবক্ষেপণ উজানে পরিবর্তিত হতে পারে। নদীর নতিমাত্রা এ কারণে কমে আসবে, যার ফলে নদীর পরিবহণ ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এর ফলে নদী তলদেশের অবক্ষেপণ আরও উজানে সরে যাবে। ফলে ঘন ঘন বন্যার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। | |||
''জোয়ার, তরঙ্গ ও উপকূলীয় ভাঙন'' বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের কারণেও চলতি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের উৎস হচ্ছে ভারত মহাসাগর। বাংলাদেশ উপকূল বরাবর জোয়ারের বিস্তৃতি ৩ থেকে ৬ মিটারের মধ্যে। ফলে প্রচন্ড জোয়ারের তরঙ্গ বিক্ষেপ বাংলাদেশে তটরেখা ভাঙনের একটি কারণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি তটরেখাকে আরও অভ্যন্তরে স্থলভাগে ঠেলে দেবে, যা জোয়ারের বিস্তৃতিকে বৃদ্ধি করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি জোয়ার প্রবাহের তলের ঘর্ষণকে কমিয়ে আনবে, যে কারণে জোয়ারের বিস্তৃতি বাড়বে। এর ফলে সমুদ্র স্ফীতির কারণে জোয়ারের পালা ও জোয়ার তরঙ্গের কম্পনতা বাংলাদেশে উপকূলীয় ভাঙন বৃদ্ধি ও উপকূলীয় ভূরূপ-গতিবিদ্যা (Morphodynamics) পরিবর্তন করতে পারে। | |||
সম্প্রতি চট্টগ্রামের উপকূলীয় বলয়ের কিছু অংশে ভাঙন বিপদজনকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান হারে ভাঙন অব্যাহত থাকলে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, নৌবাহিনীর স্থাপনা ও একটি বৃহৎ শিল্পনগরীসহ বিশাল অঞ্চল বিপদাপন্ন হতে পারে। উচ্চতর সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে তাল রেখে বন্দর সুবিধাদি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে। | সম্প্রতি চট্টগ্রামের উপকূলীয় বলয়ের কিছু অংশে ভাঙন বিপদজনকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান হারে ভাঙন অব্যাহত থাকলে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, নৌবাহিনীর স্থাপনা ও একটি বৃহৎ শিল্পনগরীসহ বিশাল অঞ্চল বিপদাপন্ন হতে পারে। উচ্চতর সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে তাল রেখে বন্দর সুবিধাদি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে। | ||
''কৃষিতে প্রভাব'' সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, নদীক্ষরণ বৃদ্ধি ও জলবায়ুগত অন্যান্য পরিবর্তন কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। কিছু এলাকায় বর্ষা মৌসুমে আগাম বন্যার কারণে এমনকি গভীর পানিতে উৎপাদনশীল ধানের আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে আউশ ধান ও পাট চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং কৃষকরা বড় ধরনের বন্যা সহনশীল কম উৎপাদনক্ষম আমন জাতের ধান উৎপাদনে বাধ্য হবে। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও নিষ্কাশনের ধীর গতির কারণে শীতকালীন শস্য বপনের জন্য ভিজা জমি শুকাতে দেরি হয়ে যাবে। ফলে আবাদি জমির পরিমাণ সংকোচন ও উৎপাদন হ্রাসের কারণে কৃষির ধরন এবং প্রণালীও বদলে যাবে। পরিবর্তিত জলবায়ু ও স্ফীত সমুদ্রপৃষ্ঠের মোকাবেলায় তখন বর্তমান চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। | |||
''লবণাক্ত পানির'' অনুপ্রবেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লবণাক্ত পানির চোঁয়ানো ও অনুপ্রবেশে প্রভাব রাখবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। যেসব অঞ্চলে নিম্নভূমি সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয় (যেমন: [[বিল ডাকাতিয়া|বিল ডাকাতিয়া]]) সেসব স্থানে লবণাক্ততার ক্ষরণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ জলের উত্তর-দক্ষিণ নতিক্রমও সমুদ্র স্ফীতির কারণে বাধাপ্রাপ্ত হবে। | |||
''স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বর্জ্য নিষ্ক্রমণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা'' সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের নিমিত্তে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা অবিলম্বে অচল হয়ে পড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার কারণে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে। আবার বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের স্তূপে বন্যার পানি ঢুকলে পরিবেশগত সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। | |||
''জলাভূমি'' সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের কারণে জলাভূমির জন্য দুটি জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে, এগুলো হচ্ছে নিমজ্জন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি। নিমজ্জন তখনই ঘটে যখন জলাভূমি পৃষ্ঠের উলম্ব উপলেপ পানির সীমা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল রাখতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে জলাভূমিতে অবক্ষেপ উপকরণ সঞ্চিত হওয়া খুবই প্রয়োজন। যদি জলাভূমিতে সমুদ্র স্ফীতির সমান হারে উলম্ব উপলেপ সংঘটিত না হয়, সেই জলাভূমি চাপের মুখে একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে। | |||
জলোচ্ছ্বাসের | জলোচ্ছ্বাসের পাল্লা বৃদ্ধির কারণে জোয়ারের পানির স্থলভাগে গভীরতর অনুপ্রবেশ জোয়ারগঠিত কান্দা (levee) গঠন করবে এবং গরান বনাঞ্চল (mangrove) সম্প্রসারিত করবে। অবশ্য, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে অভ্যন্তর স্থলভাগ কৃষি বা জনবসতি দ্বারা অধিকৃত এবং বাঁধ দিয়ে সংরক্ষিত সেখানে ভাঙনের কারণে গরান বনাঞ্চল সংকীর্ণতর হতে থাকবে, এমনকি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী] | ||
[[en:Sea Level Change]] | [[en:Sea Level Change]] |
০৫:৫৯, ১৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন (Sea Level Change) সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় সীমার পরিবর্তন। এটিকে পৃথিবীপৃষ্ঠের উচ্চতা ও গভীরতা মাপার জন্য নির্দেশক রেখা হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীব্যাপী উষ্ণতার ফলশ্রুতিতে জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি ইত্যাদি বিষয় বর্তমান যুগে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থলভাগের নিম্ন উচ্চতা, নদীসমূহের স্বল্প নতিক্রম এবং সমুদ্রের কোলে অবস্থিতির কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র স্ফীতির প্রতিকূল প্রভাবে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বন্যা, জলনিকাশ ব্যবস্থা, কৃষি, জোয়ারভাটা ও জলাভূমির ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায় না।
ইতিহাস তামিল, সংস্কৃত এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে (উপনিষদ) বহুকাল আগে থেকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন সম্পর্কে জানা গিয়েছিল। চীনে বহু প্রাচীনকাল থেকে যেমন অষ্টম ও নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে স্থলভাগের পরিবর্তন সমুদ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন স্থলভাগের সাপেক্ষে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। ১৭৮৫ সালে ফ্রিজি (আর.জে.এন ভিভয়, ১৯৮৭-তে) তাঁর থিওরী অব আর্থ রোটেশন-এ ফেনোস্ক্যান্ডিয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের নেমে যাওয়া এবং ভূমধ্যসাগরে এটির স্ফীতি বর্ণনা করেন। স্থলভাগ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর আরও মাঠ পর্যায়ের তথ্য-প্রমাণাদি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ পাওয়া গিয়েছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাল প্রাচীরের ঊর্ধ্বমুখী ক্রমবৃদ্ধিকে সি.আর ডারউইন (১৮৪২) সমুদ্রতলের নেমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে উলেখ করেছেন। আর.এ ড্যালি (১৯২০) কর্তৃক দৃষ্টান্ত সহযোগে ব্যাখ্যাকৃত সি ম্যাকলারেনের (১৮৪২) হিমযুগীয় সমাস্থিতিক তত্ত্ব বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপকমাত্রায় গ্রহণযোগ্য ছিল। অবশ্য এই পর্যন্ত বঙ্গ অববাহিকার হলোসিন (আজ থেকে এক লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত) সমুদ্রপৃষ্ঠের ইতিহাস পুনর্গঠনে সামান্যই কাজ হয়েছে। এস.পি চ্যাটার্জী (১৯৬১) ভারতীয় উপকূলে সাতটি সামুদ্রিক সোপানের উপস্থিতিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের নমুনা হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর মতে উত্তর হিমযুগীয় সমুদ্র স্ফীতির প্রমাণ ভারত ও শ্রীলংকার মধ্যকার সংযোগ শৈলশিরা ‘অ্যাডামস ব্রিজ’ যা বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের ৪ মিটার গভীরে নিমজ্জিত। জি.ভি রাজামানিকাম ও ভি.জে লাভসন (১৯৯০) বঙ্গোপসাগরে উত্তর হিমযুগীয় সমুদ্র স্ফীতির প্রমাণস্বরূপ অনেকগুলি উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন। এম উমিতসু (১৯৮৭) বঙ্গ নিম্নভূমির জন্য একটানা আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতি রেখার প্রস্তাবনা করেছেন। এই রেখায় আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ চলমানতার কিছু যুক্তিপূর্ণ তেজস্ক্রিয় কার্বন বয়সের তথ্য আছে। একই বছর এম ব্যানার্জী ও পি.কে সেন বঙ্গ অববাহিকার আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখা অঙ্কন করেন। এম.এইচ মনসুর ও এ.এস.এম.এম কামাল (১৯৯০) কোন নতুন রেখার প্রস্তাবনা না করে আর.ডবিও ফেয়ারব্রিজের (১৯৬১) পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখা বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেন এবং বাংলাদেশ উপকূলে প্রায় ৬,০০০ বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীতির বিবরণ দেন। অন্যান্য গবেষকরা যেমন পিটার রেভেনসক্রফট (১৯৯৫) এবং এম.এস ইসলাম (১৯৯৬) বাংলাদেশের জন্য হলোসিন আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠ রেখার (Holocene Relative Sea level change) প্রস্তাবনা করেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠে পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী গড় সমুদ্রসীমা ভিন্ন ভিন্ন কাল ও স্থানের পরিমাপে কয়েকটি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হচ্ছে। হিমযুগীয় সমাস্থিতিক প্রতিক্ষেপ (glacio-isostatic rebound), সমুদ্রবিদ্যা সংক্রান্ত, বায়ুমন্ডলীয় ও ভূ-গাঠনিক প্রভাবসমূহ এই পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের অস্থিত (eustatic) পরিবর্তন সমুদ্র জলের পরিমাণ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, স্থানিক উত্থান ও অবনমনের কারণে ভিন্ন হতে পারে।
অবক্ষেপের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, নদী-বদ্বীপীয় এলাকার কাছাকাছি কার্যকর হলেও, সারা বিশ্বের নিরিখে তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। স্বল্পকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের (কয়েক বছরব্যাপী) সঙ্গে এল নিনো বা দক্ষিণাঞ্চলীয় দোলনের (southern oscillations) সম্পর্ক রয়েছে। কিছু উপকূল বরাবর স্বল্পমেয়াদি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনে মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও নদী জলনিকাশ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে দৃশ্যমান ১০০ সেমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন সৃষ্টিতে বৃষ্টিপাত ও জলনিকাশ (runoff) উলেখযোগ্য অবদান রাখে। বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন লক্ষণীয় এবং স্ফীততায় পৃথিবীর অনেকগুলির মধ্যে একটি। সাগরটির চোঙার মতো আকৃতির জন্য সর্বোচ্চ মৌসুমি পরিবর্তন দেখা যায় এটির উত্তর-পূর্ব উপকূলে। চট্টগ্রাম উপকূলের বার্ষিক পরিবর্তন হলো ১.১৮ মিটার।
বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের বিচলন আঞ্চলিক এবং স্থানীয় উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বঙ্গোপসাগরে গত নয় হাজার ক্যালেন্ডার বছরে পাঁচটি সামুদ্রিক স্ফীতি এবং প্রতিটির সঙ্গে একটি করে সাগরের পশ্চাদ্গতি নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গত ৬৩১৫ হাজার বছর থেকে ৫৯১৫ হাজার বছরের মধ্যে একটি সর্বোচ্চ আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতির মাত্রা হলো বছরে ৩.৬৫ মিমি; হলোসিন সময়ে বঙ্গ অববাহিকায় গড় মাত্রা ছিল বছরে ১.০৭ মিমি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের প্রতিক্রিয়া ২০৫০ সালের শেষের দিকে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের সম্ভাব্য স্ফীতি সমুদ্রের পানি দ্বারা সৃষ্ট বড় ধরনের উপকূলীয় পাবনের ইঙ্গিতবাহী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের ১.৪৪ মিটার উত্থানের অর্থ ১৬% স্থলভাগে পাবন, জনসংখ্যার ১৩%- এর স্থানচ্যুতি এবং জিডিপির ১০% ক্ষতি। বঙ্গীয় বদ্বীপের অবনমনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের প্রতিক্রিয়া হবে আরও সঙ্কটপূর্ণ।
বন্যা ও ভাঙন অবক্ষেপণ বাংলাদেশে প্রতি বছর মাঝারি থেকে ব্যাপক বন্যা সংঘটিত হয়। ঘন ঘন ঝড়ঝঞ্ঝা ও ব্যাপক উপকূলীয় বন্যার সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগরে ভরা কটাল বন্যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। দেখা গেছে যে, মাত্র ১.৪ মিটার সমুদ্র স্ফীতির কারণে মেঘনার মোহনার কাছে পানির উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার বৃদ্ধি পায়। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ০.২ মিটার উত্থানের কারণে মোহনার কাছে পানির উচ্চতা ৪.৫ থেকে ৫ মিটার বৃদ্ধি পায়। উপকূল অঞ্চলের অধিকাংশই গড় সমুদ্র সীমার (mean sea level MSL) ১.৫ মিটার উপরে এবং গঙ্গা ও মেঘনা নদীর সঙ্গমের নিকটবর্তী অঞ্চল MSL-এর ৩ মিটার উপরে বিধায় নিমজ্জিত অঞ্চলের গভীরতা ও আয়তন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অবশ্য গঙ্গা ও আপার মেঘনার পানির উচ্চতা প্রবাহের পানিগতিবিদ্যা (hydrodynamics) পরিবর্তন হেতু বিপরীত প্রবাহের (backwater) প্রভাবের কারণেও উলেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফলে বন্যার তীব্রতা ও ব্যাপকতা নদীর উজান অঞ্চলেও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে সমুদ্রের উচ্চতাবৃদ্ধি তটরেখাকেও স্থলভাগ অভিমুখে ঠেলে আনবে, যার পরিণতি কৃষিজমির হ্রাস যা কেবল চাষাবাদেরই পরিবর্তন ঘটাবে না, বরং শস্য উৎপাদন হ্রাস ও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত করবে। অতিরিক্ত বন্যা বর্তমান সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায়ও সমস্যার সৃষ্টি করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও এর সঙ্গে যুক্ত বিপরীত প্রবাহ প্রভাবের কারণে ভাঙন-উপলেপ (erosion-sedimentation) প্রণালী পরিবর্তিত হবে। বিপরীত প্রবাহ প্রভাবের কারণে নদীসমূহের ক্ষরণ (discharge) ক্ষমতা হ্রাস পাবে, যার ফলে অবক্ষেপণ উজানে পরিবর্তিত হতে পারে। নদীর নতিমাত্রা এ কারণে কমে আসবে, যার ফলে নদীর পরিবহণ ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এর ফলে নদী তলদেশের অবক্ষেপণ আরও উজানে সরে যাবে। ফলে ঘন ঘন বন্যার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে।
জোয়ার, তরঙ্গ ও উপকূলীয় ভাঙন বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের কারণেও চলতি বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বঙ্গোপসাগরে জোয়ারের উৎস হচ্ছে ভারত মহাসাগর। বাংলাদেশ উপকূল বরাবর জোয়ারের বিস্তৃতি ৩ থেকে ৬ মিটারের মধ্যে। ফলে প্রচন্ড জোয়ারের তরঙ্গ বিক্ষেপ বাংলাদেশে তটরেখা ভাঙনের একটি কারণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি তটরেখাকে আরও অভ্যন্তরে স্থলভাগে ঠেলে দেবে, যা জোয়ারের বিস্তৃতিকে বৃদ্ধি করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি জোয়ার প্রবাহের তলের ঘর্ষণকে কমিয়ে আনবে, যে কারণে জোয়ারের বিস্তৃতি বাড়বে। এর ফলে সমুদ্র স্ফীতির কারণে জোয়ারের পালা ও জোয়ার তরঙ্গের কম্পনতা বাংলাদেশে উপকূলীয় ভাঙন বৃদ্ধি ও উপকূলীয় ভূরূপ-গতিবিদ্যা (Morphodynamics) পরিবর্তন করতে পারে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের উপকূলীয় বলয়ের কিছু অংশে ভাঙন বিপদজনকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান হারে ভাঙন অব্যাহত থাকলে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, নৌবাহিনীর স্থাপনা ও একটি বৃহৎ শিল্পনগরীসহ বিশাল অঞ্চল বিপদাপন্ন হতে পারে। উচ্চতর সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে তাল রেখে বন্দর সুবিধাদি সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে।
কৃষিতে প্রভাব সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, নদীক্ষরণ বৃদ্ধি ও জলবায়ুগত অন্যান্য পরিবর্তন কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। কিছু এলাকায় বর্ষা মৌসুমে আগাম বন্যার কারণে এমনকি গভীর পানিতে উৎপাদনশীল ধানের আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে আউশ ধান ও পাট চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ হ্রাস পাবে এবং কৃষকরা বড় ধরনের বন্যা সহনশীল কম উৎপাদনক্ষম আমন জাতের ধান উৎপাদনে বাধ্য হবে। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও নিষ্কাশনের ধীর গতির কারণে শীতকালীন শস্য বপনের জন্য ভিজা জমি শুকাতে দেরি হয়ে যাবে। ফলে আবাদি জমির পরিমাণ সংকোচন ও উৎপাদন হ্রাসের কারণে কৃষির ধরন এবং প্রণালীও বদলে যাবে। পরিবর্তিত জলবায়ু ও স্ফীত সমুদ্রপৃষ্ঠের মোকাবেলায় তখন বর্তমান চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।
লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লবণাক্ত পানির চোঁয়ানো ও অনুপ্রবেশে প্রভাব রাখবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। যেসব অঞ্চলে নিম্নভূমি সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয় (যেমন: বিল ডাকাতিয়া) সেসব স্থানে লবণাক্ততার ক্ষরণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ জলের উত্তর-দক্ষিণ নতিক্রমও সমুদ্র স্ফীতির কারণে বাধাপ্রাপ্ত হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বর্জ্য নিষ্ক্রমণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের নিমিত্তে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা অবিলম্বে অচল হয়ে পড়বে। উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার কারণে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে। আবার বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যের স্তূপে বন্যার পানি ঢুকলে পরিবেশগত সমস্যার উদ্ভব হতে পারে।
জলাভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থানের কারণে জলাভূমির জন্য দুটি জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে, এগুলো হচ্ছে নিমজ্জন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি। নিমজ্জন তখনই ঘটে যখন জলাভূমি পৃষ্ঠের উলম্ব উপলেপ পানির সীমা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল রাখতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে জলাভূমিতে অবক্ষেপ উপকরণ সঞ্চিত হওয়া খুবই প্রয়োজন। যদি জলাভূমিতে সমুদ্র স্ফীতির সমান হারে উলম্ব উপলেপ সংঘটিত না হয়, সেই জলাভূমি চাপের মুখে একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবে।
জলোচ্ছ্বাসের পাল্লা বৃদ্ধির কারণে জোয়ারের পানির স্থলভাগে গভীরতর অনুপ্রবেশ জোয়ারগঠিত কান্দা (levee) গঠন করবে এবং গরান বনাঞ্চল (mangrove) সম্প্রসারিত করবে। অবশ্য, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে অভ্যন্তর স্থলভাগ কৃষি বা জনবসতি দ্বারা অধিকৃত এবং বাঁধ দিয়ে সংরক্ষিত সেখানে ভাঙনের কারণে গরান বনাঞ্চল সংকীর্ণতর হতে থাকবে, এমনকি অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]