তারিখ-ই-শাহ সুজাই: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:Banglapedia]] | [[Category:Banglapedia]] | ||
'''তারিখ-ই-শাহ সুজাই''' একখানা ইতিহাস গ্রন্থ। ১০৭০ হিজরি/১৬৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে মালদহে মুহম্মদ মাসুম কর্তৃক রচিত। মুহম্মদ মাসুম ছিলেন সালিহের পৌত্র এবং হাসানের পুত্র। তিনি জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন শাহ সুজার সঙ্গী এবং তাঁর অধীনে তিনি প্রায় পঁচিশ | '''তারিখ-ই-শাহ সুজাই''' একখানা ইতিহাস গ্রন্থ। ১০৭০ হিজরি/১৬৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে মালদহে মুহম্মদ মাসুম কর্তৃক রচিত। মুহম্মদ মাসুম ছিলেন সালিহের পৌত্র এবং হাসানের পুত্র। তিনি জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন শাহ সুজার সঙ্গী এবং তাঁর অধীনে তিনি প্রায় পঁচিশ চাকরি করেছিলেন। মীরজুমলার হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে [[শাহ সুজা|শাহ সুজা]] তান্ডা ত্যাগ করে আরাকানের পথে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে মাসুম মালদহে চলে যান এবং তারিখ-ই-শাহ সুজাই রচনায় সময়টা কাজে লাগান। | ||
তারিখ | তারিখ-ই-শাহ সুজাই শিরোনামটি বইয়ে পাওয়া যায় না। এ পর্যন্ত পাওয়া তিনটি পান্ডুলিপির মধ্যে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পান্ডুলিপিটি এর সুবিন্যস্ত তালিকার সংকলক এথে কর্তৃক তারিখ-ই-শাহ সুজাই রূপে অভিহিত হয়েছে। ইটন কলেজে একটি এবং বাঁকিপুরের ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরির অপরটি, এ দুটি পান্ডুলিপিতে কোনো শিরোনাম দেওয়া হয় নি। হেনরী ইলিয়টের প্রবন্ধে ফুতুহাত-ই-আলমগীর নামে একটি পান্ডুলিপির মুখবন্ধের ও সূচিপত্রের ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। তথাকথিত ফুতুহাত-ই-আলমগীরীর মুখবন্ধ এবং সূচিপত্র তারিখ-ই-শাহ সুজাই রূপে অভিহিত পান্ডুলিপির মুখবন্ধ ও সূচিপত্রের হুবহু অনুরূপ। | ||
সূচিপত্র থেকে দেখা যায় যে, গ্রন্থকার উত্তরাধিকার যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এ যুদ্ধে [[শাহজাহান|শাহজাহান]] | সূচিপত্র থেকে দেখা যায় যে, গ্রন্থকার উত্তরাধিকার যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এ যুদ্ধে [[শাহজাহান|শাহজাহান]]-এর চার পুত্রই অংশ নিয়েছিলেন। গ্রন্থকার এ অংশে কিছুটা বেশি জায়গা নিলেও এ যুদ্ধে শাহ সুজার অংশ গ্রহণ এ গ্রন্থের একটি অংশমাত্র। গ্রন্থকার ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ উত্তরাধিকার যুদ্ধের বহু আগে সংঘটিত [[আওরঙ্গজেব|আওরঙ্গজেব]] ও মুরাদের (সম্রাটের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র) বলখ অভিযানের বিবরণও দিয়েছেন। দারাশিকো (সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র) এবং আওরঙ্গজেবের মধ্যে সস্পর্কচ্ছেদ দেখানোর জন্যই গ্রন্থকার বলখ যুদ্ধের বিবরণ যোগ করেছিলেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ভূমিকা এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাফল্য এ গ্রন্থে প্রাধান্য লাভ করায় ফুতুহাত-ই-আলমগীরী শিরোনামটি যথোচিত শোনায়। | ||
সম্ভবত মীর মাসুম তাঁর বইয়ের কোনো নাম নির্দিষ্ট করেন নি এবং এর কারণ অনুমান করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন শাহ সুজার অনুগত কর্মচারী এবং তাঁর অধীনে তিনি ২৪/২৫ বছর চাকরি করেছিলেন। কাজেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকের নামেই তিনি তাঁর বইটি উৎসর্গ করবেন এমনটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষক পরাজিত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলে তাঁকে বইটি উৎসর্গ করার কোনো যুক্তি থাকে না। গ্রন্থ রচনাকালে গ্রন্থকার আওরঙ্গজেবের রাজ্যে অবস্থান করছিলেন। গ্রন্থকার কোনো শিরোনাম না দেওয়ায় আধুনিক পন্ডিতগণ গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত অনুসারে এর কয়েকটি শিরোনাম প্রস্তাব করেন। গ্রন্থকার সুজার অধীন কর্মকর্তা হওয়ায় একে তারিখ | সম্ভবত মীর মাসুম তাঁর বইয়ের কোনো নাম নির্দিষ্ট করেন নি এবং এর কারণ অনুমান করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন শাহ সুজার অনুগত কর্মচারী এবং তাঁর অধীনে তিনি ২৪/২৫ বছর চাকরি করেছিলেন। কাজেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকের নামেই তিনি তাঁর বইটি উৎসর্গ করবেন এমনটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষক পরাজিত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলে তাঁকে বইটি উৎসর্গ করার কোনো যুক্তি থাকে না। গ্রন্থ রচনাকালে গ্রন্থকার আওরঙ্গজেবের রাজ্যে অবস্থান করছিলেন। গ্রন্থকার কোনো শিরোনাম না দেওয়ায় আধুনিক পন্ডিতগণ গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত অনুসারে এর কয়েকটি শিরোনাম প্রস্তাব করেন। গ্রন্থকার সুজার অধীন কর্মকর্তা হওয়ায় একে তারিখ-ই-শাহ সুজাই শিরোনামটি প্রস্তাব করেন এবং আলমগীর (আওরঙ্গজেব) উত্তরাধিকার যুদ্ধে সফল হওয়ায় ইলিয়ট গ্রন্থটির শিরোনাম হিসেবে ফুতুহাত-ই-আলমগীরী প্রস্তাব করেন। | ||
এক জায়গায় মুহম্মদ মাসুম বলেছেন যে, তাঁর বাল্যকাল থেকেই তিনি শাহজাহানের পুত্রদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, তিনি ২৪/২৫ বছর শাহ সুজার অধীনে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন যার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বাংলার [[সুবাহদার|সুবাহদার]] হিসেবে ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে (সুজার সুবাহদারি শুরু হওয়ার বছর) শাহ সুজার যোগদানের আগে থেকে তিনি শাহজাদার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের অসুস্থতা এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি বাংলা সম্পর্কে কিছু বলেন নি। | এক জায়গায় মুহম্মদ মাসুম বলেছেন যে, তাঁর বাল্যকাল থেকেই তিনি শাহজাহানের পুত্রদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, তিনি ২৪/২৫ বছর শাহ সুজার অধীনে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন যার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বাংলার [[সুবাহদার|সুবাহদার]] হিসেবে ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে (সুজার সুবাহদারি শুরু হওয়ার বছর) শাহ সুজার যোগদানের আগে থেকে তিনি শাহজাদার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের অসুস্থতা এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি বাংলা সম্পর্কে কিছু বলেন নি। | ||
১২ নং লাইন: | ১২ নং লাইন: | ||
উত্তরাধিকার যুদ্ধ নিয়ে তাঁর আলোচনা শুরু করে তিনি প্রথমে শাহজাহানের অসুস্থতা এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে দারাশিকোর চেষ্টার উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি অন্য তিন শাহজাদার রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। বাহাদুরপুরে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা রাজমহলের দিকে ফিরে যান। গ্রন্থকার এর পর রাজধানী অভিমুখে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের অগ্রসর হওয়া, পরবর্তী দুটি যুদ্ধ, আওরঙ্গজেবের সাফল্য ও তাঁর সিংহাসনারোহণের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি মুরাদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ এবং বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যার বিষয়েও লিখেছেন। আগ্রা দুর্গে সম্রাট শাহজাহানের বন্দিজীবন এবং নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক দারার মৃত্যুদন্ডাদেশের বিবরণও তিনি দিয়েছেন। এরপর মাসুম আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সুজার যুদ্ধ, খাজওয়ার যুদ্ধে সুজা কিভাবে পরাজিত হয়েছিলেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে খাজওয়া থেকে তান্ডা পর্যন্ত প্রতিটি স্থানে পশ্চাদপসরণকারী রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সুজা কিভাবে যুদ্ধ করেছিলেন তার এক দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। সুজা তান্ডা ত্যাগ করলে মাসুম তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে মালদহে বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থটি রচনা করেন। | উত্তরাধিকার যুদ্ধ নিয়ে তাঁর আলোচনা শুরু করে তিনি প্রথমে শাহজাহানের অসুস্থতা এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে দারাশিকোর চেষ্টার উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি অন্য তিন শাহজাদার রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। বাহাদুরপুরে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা রাজমহলের দিকে ফিরে যান। গ্রন্থকার এর পর রাজধানী অভিমুখে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের অগ্রসর হওয়া, পরবর্তী দুটি যুদ্ধ, আওরঙ্গজেবের সাফল্য ও তাঁর সিংহাসনারোহণের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি মুরাদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ এবং বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যার বিষয়েও লিখেছেন। আগ্রা দুর্গে সম্রাট শাহজাহানের বন্দিজীবন এবং নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক দারার মৃত্যুদন্ডাদেশের বিবরণও তিনি দিয়েছেন। এরপর মাসুম আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সুজার যুদ্ধ, খাজওয়ার যুদ্ধে সুজা কিভাবে পরাজিত হয়েছিলেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে খাজওয়া থেকে তান্ডা পর্যন্ত প্রতিটি স্থানে পশ্চাদপসরণকারী রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সুজা কিভাবে যুদ্ধ করেছিলেন তার এক দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। সুজা তান্ডা ত্যাগ করলে মাসুম তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে মালদহে বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থটি রচনা করেন। | ||
তারিখ | তারিখ-ই-শাহ সুজাই সযত্নে পড়লে এ ধারণা পাওয়া যায় যে, মাসুম তাঁর গ্রন্থ রচনায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন। নিজে শাহ সুজার একজন কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সুজার প্রতিদ্বন্দ্বী শাহজাদাদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি কোথাও তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান নি। শাহাজাদাদের নাম লিখতে গিয়ে তিনি তাঁদের নামের আগে ‘সুলতান’ শব্দটি বা অন্যান্য গৌরবসূচক উপাধি যোগ করেছেন। এমনকি শাহজাদাদের পুত্রদেরও (অর্থাৎ শাহজাহানের পৌত্রগণ) তিনি একইরকম সশ্রদ্ধভাবে উল্লেখ করেছেন। বইটির কোনোখানেই তাঁর প্রভু ও পৃষ্ঠপোষক শাহ সুজার পক্ষসমর্থন করে কিছু লেখা হয় নি। গ্রন্থকার মোহাম্মদ মাসুমের মনোভাব বইটির প্রামাণিকতার সপক্ষে সাক্ষ্য দান করে। [আবদুল করিম] | ||
'''গ্রন্থপঞ্জি''' Muhammad Masum, ''Tarikh-i-Shah Shujai, ''(ed) by Dr Mrs Adeda Hafiz, unpublished PhD thesis, Dhaka University, 1967; ''Muhammad Masum’s Tarikh-i-Shah Shujai'' in the ‘Chittagong University Studies’, VIII, June, 1992; A Karim,'' History of Bengal, Mughal Period'', II, Rajshahi, 1995. | '''গ্রন্থপঞ্জি''' Muhammad Masum, ''Tarikh-i-Shah Shujai, ''(ed) by Dr Mrs Adeda Hafiz, unpublished PhD thesis, Dhaka University, 1967; ''Muhammad Masum’s Tarikh-i-Shah Shujai'' in the ‘Chittagong University Studies’, VIII, June, 1992; A Karim, ''History of Bengal, Mughal Period'', II, Rajshahi, 1995. | ||
[[en:Tarikh-i-Shah Shujai]] | [[en:Tarikh-i-Shah Shujai]] |
১০:৪৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
তারিখ-ই-শাহ সুজাই একখানা ইতিহাস গ্রন্থ। ১০৭০ হিজরি/১৬৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে মালদহে মুহম্মদ মাসুম কর্তৃক রচিত। মুহম্মদ মাসুম ছিলেন সালিহের পৌত্র এবং হাসানের পুত্র। তিনি জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন শাহ সুজার সঙ্গী এবং তাঁর অধীনে তিনি প্রায় পঁচিশ চাকরি করেছিলেন। মীরজুমলার হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা তান্ডা ত্যাগ করে আরাকানের পথে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে মাসুম মালদহে চলে যান এবং তারিখ-ই-শাহ সুজাই রচনায় সময়টা কাজে লাগান।
তারিখ-ই-শাহ সুজাই শিরোনামটি বইয়ে পাওয়া যায় না। এ পর্যন্ত পাওয়া তিনটি পান্ডুলিপির মধ্যে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পান্ডুলিপিটি এর সুবিন্যস্ত তালিকার সংকলক এথে কর্তৃক তারিখ-ই-শাহ সুজাই রূপে অভিহিত হয়েছে। ইটন কলেজে একটি এবং বাঁকিপুরের ওরিয়েন্টাল পাবলিক লাইব্রেরির অপরটি, এ দুটি পান্ডুলিপিতে কোনো শিরোনাম দেওয়া হয় নি। হেনরী ইলিয়টের প্রবন্ধে ফুতুহাত-ই-আলমগীর নামে একটি পান্ডুলিপির মুখবন্ধের ও সূচিপত্রের ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। তথাকথিত ফুতুহাত-ই-আলমগীরীর মুখবন্ধ এবং সূচিপত্র তারিখ-ই-শাহ সুজাই রূপে অভিহিত পান্ডুলিপির মুখবন্ধ ও সূচিপত্রের হুবহু অনুরূপ।
সূচিপত্র থেকে দেখা যায় যে, গ্রন্থকার উত্তরাধিকার যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। এ যুদ্ধে শাহজাহান-এর চার পুত্রই অংশ নিয়েছিলেন। গ্রন্থকার এ অংশে কিছুটা বেশি জায়গা নিলেও এ যুদ্ধে শাহ সুজার অংশ গ্রহণ এ গ্রন্থের একটি অংশমাত্র। গ্রন্থকার ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ উত্তরাধিকার যুদ্ধের বহু আগে সংঘটিত আওরঙ্গজেব ও মুরাদের (সম্রাটের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র) বলখ অভিযানের বিবরণও দিয়েছেন। দারাশিকো (সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র) এবং আওরঙ্গজেবের মধ্যে সস্পর্কচ্ছেদ দেখানোর জন্যই গ্রন্থকার বলখ যুদ্ধের বিবরণ যোগ করেছিলেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ভূমিকা এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাফল্য এ গ্রন্থে প্রাধান্য লাভ করায় ফুতুহাত-ই-আলমগীরী শিরোনামটি যথোচিত শোনায়।
সম্ভবত মীর মাসুম তাঁর বইয়ের কোনো নাম নির্দিষ্ট করেন নি এবং এর কারণ অনুমান করা যেতে পারে। তিনি ছিলেন শাহ সুজার অনুগত কর্মচারী এবং তাঁর অধীনে তিনি ২৪/২৫ বছর চাকরি করেছিলেন। কাজেই তাঁর পৃষ্ঠপোষকের নামেই তিনি তাঁর বইটি উৎসর্গ করবেন এমনটাই আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষক পরাজিত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গেলে তাঁকে বইটি উৎসর্গ করার কোনো যুক্তি থাকে না। গ্রন্থ রচনাকালে গ্রন্থকার আওরঙ্গজেবের রাজ্যে অবস্থান করছিলেন। গ্রন্থকার কোনো শিরোনাম না দেওয়ায় আধুনিক পন্ডিতগণ গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত অনুসারে এর কয়েকটি শিরোনাম প্রস্তাব করেন। গ্রন্থকার সুজার অধীন কর্মকর্তা হওয়ায় একে তারিখ-ই-শাহ সুজাই শিরোনামটি প্রস্তাব করেন এবং আলমগীর (আওরঙ্গজেব) উত্তরাধিকার যুদ্ধে সফল হওয়ায় ইলিয়ট গ্রন্থটির শিরোনাম হিসেবে ফুতুহাত-ই-আলমগীরী প্রস্তাব করেন।
এক জায়গায় মুহম্মদ মাসুম বলেছেন যে, তাঁর বাল্যকাল থেকেই তিনি শাহজাহানের পুত্রদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, তিনি ২৪/২৫ বছর শাহ সুজার অধীনে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন যার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বাংলার সুবাহদার হিসেবে ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে (সুজার সুবাহদারি শুরু হওয়ার বছর) শাহ সুজার যোগদানের আগে থেকে তিনি শাহজাদার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের অসুস্থতা এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি বাংলা সম্পর্কে কিছু বলেন নি।
উত্তরাধিকার যুদ্ধ নিয়ে তাঁর আলোচনা শুরু করে তিনি প্রথমে শাহজাহানের অসুস্থতা এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে দারাশিকোর চেষ্টার উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি অন্য তিন শাহজাদার রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। বাহাদুরপুরে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা রাজমহলের দিকে ফিরে যান। গ্রন্থকার এর পর রাজধানী অভিমুখে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের অগ্রসর হওয়া, পরবর্তী দুটি যুদ্ধ, আওরঙ্গজেবের সাফল্য ও তাঁর সিংহাসনারোহণের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি মুরাদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ এবং বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যার বিষয়েও লিখেছেন। আগ্রা দুর্গে সম্রাট শাহজাহানের বন্দিজীবন এবং নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক দারার মৃত্যুদন্ডাদেশের বিবরণও তিনি দিয়েছেন। এরপর মাসুম আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সুজার যুদ্ধ, খাজওয়ার যুদ্ধে সুজা কিভাবে পরাজিত হয়েছিলেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে খাজওয়া থেকে তান্ডা পর্যন্ত প্রতিটি স্থানে পশ্চাদপসরণকারী রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সুজা কিভাবে যুদ্ধ করেছিলেন তার এক দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। সুজা তান্ডা ত্যাগ করলে মাসুম তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করে মালদহে বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থটি রচনা করেন।
তারিখ-ই-শাহ সুজাই সযত্নে পড়লে এ ধারণা পাওয়া যায় যে, মাসুম তাঁর গ্রন্থ রচনায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন। নিজে শাহ সুজার একজন কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সুজার প্রতিদ্বন্দ্বী শাহজাদাদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি কোথাও তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান নি। শাহাজাদাদের নাম লিখতে গিয়ে তিনি তাঁদের নামের আগে ‘সুলতান’ শব্দটি বা অন্যান্য গৌরবসূচক উপাধি যোগ করেছেন। এমনকি শাহজাদাদের পুত্রদেরও (অর্থাৎ শাহজাহানের পৌত্রগণ) তিনি একইরকম সশ্রদ্ধভাবে উল্লেখ করেছেন। বইটির কোনোখানেই তাঁর প্রভু ও পৃষ্ঠপোষক শাহ সুজার পক্ষসমর্থন করে কিছু লেখা হয় নি। গ্রন্থকার মোহাম্মদ মাসুমের মনোভাব বইটির প্রামাণিকতার সপক্ষে সাক্ষ্য দান করে। [আবদুল করিম]
গ্রন্থপঞ্জি Muhammad Masum, Tarikh-i-Shah Shujai, (ed) by Dr Mrs Adeda Hafiz, unpublished PhD thesis, Dhaka University, 1967; Muhammad Masum’s Tarikh-i-Shah Shujai in the ‘Chittagong University Studies’, VIII, June, 1992; A Karim, History of Bengal, Mughal Period, II, Rajshahi, 1995.