গণহত্যা, ১৯৭১: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৪ নং লাইন: | ৪ নং লাইন: | ||
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন (৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় কয়েক শত লোক। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং পাকিস্তান সরকার প্রদেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। | প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন (৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় কয়েক শত লোক। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং পাকিস্তান সরকার প্রদেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। | ||
[[Image:Genocide1971war.jpg|thumb|right|গণহত্যার শিকার, রায়েরবাজার [''ছবি: আমানুল হক'']]] | |||
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁয়ের আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দি হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। | ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁয়ের আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দি হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। | ||
পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর বিধ্বস্ত করে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা চালায়। এতে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় হিন্দু অধ্যুষিত শাখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকান্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি নরনারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। | পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর বিধ্বস্ত করে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা চালায়। এতে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় হিন্দু অধ্যুষিত শাখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকান্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি নরনারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। | ||
অপারেশন সার্চলাইট নামে অভিহিত গণহত্যার এ প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করে এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পরবর্তী সময়ে তারা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশব্যাপী সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা শুরু করে। এর প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরসমূহ গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য আকাশপথে বিমান, নৌপথে নৌযান নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহরে হামলা চালায়। তারা শত শত গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়, হত্যা করে নিরপরাধ গ্রামবাসীকে, ধর্ষণ করে যুবতী-কিশোরীদের, লুণ্ঠন করে মূল্যবান সম্পদ। ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় মানুষ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। | |||
[[Image:GenocideShiyalbari.jpg|thumb|left|শিয়ালবাড়িতে শহীদদের গণকবর [''ছবি: আমানুল হক'']]] | |||
প্রেস সেন্সর ও সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল না। সে কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য-দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং এর অপরাপর সদস্য-দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় [[রাজাকার|রাজাকার]], [[আল-বদর|আল]][[আল-বদর|-বদর]] এবং [[আল-শামস|আল]][[আল-শামস|-শামস]] বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেক লোককে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে নিয়ে যায় এবং এঁদের খুব কমই জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁদের গণহত্যা ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, ব্যায়নেট দ্বারা খুঁচিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে শেষ পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী ও তাদের সমর্থকদের ধূলিস্যাৎ করে দেয়াই ছিল গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। | প্রেস সেন্সর ও সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল না। সে কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য-দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং এর অপরাপর সদস্য-দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় [[রাজাকার|রাজাকার]], [[আল-বদর|আল]][[আল-বদর|-বদর]] এবং [[আল-শামস|আল]][[আল-শামস|-শামস]] বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেক লোককে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে নিয়ে যায় এবং এঁদের খুব কমই জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁদের গণহত্যা ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, ব্যায়নেট দ্বারা খুঁচিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে শেষ পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী ও তাদের সমর্থকদের ধূলিস্যাৎ করে দেয়াই ছিল গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। | ||
০৬:০৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
গণহত্যা, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাযজ্ঞে কতজন বাঙালি নিহত হন তা নির্ধারণে কোনো জরিপ পরিচালিত হয় নি; তবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরের এক হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ধরা হয়। পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের অন্যতম।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন (৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় কয়েক শত লোক। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং পাকিস্তান সরকার প্রদেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁয়ের আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দি হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর বিধ্বস্ত করে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা চালায়। এতে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় হিন্দু অধ্যুষিত শাখারিপট্টি ও তাঁতিবাজারের অসংখ্য ঘরবাড়িতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকান্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি নরনারী ও শিশু প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
অপারেশন সার্চলাইট নামে অভিহিত গণহত্যার এ প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করে এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পরবর্তী সময়ে তারা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশব্যাপী সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা শুরু করে। এর প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরসমূহ গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য আকাশপথে বিমান, নৌপথে নৌযান নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহরে হামলা চালায়। তারা শত শত গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়, হত্যা করে নিরপরাধ গ্রামবাসীকে, ধর্ষণ করে যুবতী-কিশোরীদের, লুণ্ঠন করে মূল্যবান সম্পদ। ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় মানুষ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
প্রেস সেন্সর ও সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল না। সে কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য-দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং এর অপরাপর সদস্য-দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত ক্রমান্বয়ে জাগ্রত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তান সরকার তার দখলদার বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী গড়ে তোলে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেক লোককে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে ধরে নিয়ে যায় এবং এঁদের খুব কমই জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁদের গণহত্যা ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়, ব্যায়নেট দ্বারা খুঁচিয়ে তাদের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে শেষ পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী ও তাদের সমর্থকদের ধূলিস্যাৎ করে দেয়াই ছিল গণহত্যার প্রধান লক্ষ্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে।
জাতিসংঘের গণহত্যা বিষয়ক কনভেনশন এবং মানবাধিকার বিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণা অনুযায়ী গণহত্যার যেভাবে বিচার হওয়া উচিত ছিল ১৯৭১-এর এ নৃশংস গণহত্যার হোতাদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আজও গৃহীত হয় নি। [ফজলুল কাদের কাদেরী]
আরও দেখুন বুদ্ধিজীবী হত্যা; মুক্তিযুদ্ধ।