শীল, কানাইলাল: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''শীল, কানাইলাল''' (১৮৯৫-১৯৭৪) দোতারাবাদক, লোকগীতি রচয়িতা ও সংগ্রাহক এবং সুরকার। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার কইরাল গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আনন্দচন্দ্র শীল ও মাতার নাম সৌদামনী শীল। পিতা আনন্দচন্দ্র শীল ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রেমী ব্যক্তি। কানাইলালের সঙ্গীতপ্রীতি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। | '''শীল, কানাইলাল''' (১৮৯৫-১৯৭৪) দোতারাবাদক, লোকগীতি রচয়িতা ও সংগ্রাহক এবং সুরকার। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার কইরাল গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আনন্দচন্দ্র শীল ও মাতার নাম সৌদামনী শীল। পিতা আনন্দচন্দ্র শীল ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রেমী ব্যক্তি। কানাইলালের সঙ্গীতপ্রীতি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। | ||
[[Image:ShilKanailal.jpg|thumb|right|কানাইলাল শীল]] | |||
শৈশবে পিতৃহীন কানাইলাল মাত্র আট বছর বয়সে বসন্তকুমার শীলের নিকট বেহালাবাদন শুরু করেন। পরে মতিলাল ধূপী নামের বিশিষ্ট বেহালাবাদকের নিকট তিনি বেহালায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে যাত্রাদল, [[গাজীর গান|গাজীর গান]], [[কবিগান|কবিগান]] ও কীর্তনদলে যোগ দিয়ে তিনি বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে বেড়ান। এক পর্যায়ে বিক্রমপুরের বইমহটির দরবেশ দাগু শাহ্র মাযারে জনৈক দোতারাবাদকের বাদন শুনে তিনি মুগ্ধ হন এবং বাড়ি ফিরে প্রখ্যাত দোতারাবাদক তারাচাঁদ সরকারের নিকট [[দোতারা|দোতারা]] শেখেন। গুরুর শিক্ষা এবং স্বীয় অধ্যবসায়ের ফলে কানাইলাল দোতারায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। | শৈশবে পিতৃহীন কানাইলাল মাত্র আট বছর বয়সে বসন্তকুমার শীলের নিকট বেহালাবাদন শুরু করেন। পরে মতিলাল ধূপী নামের বিশিষ্ট বেহালাবাদকের নিকট তিনি বেহালায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে যাত্রাদল, [[গাজীর গান|গাজীর গান]], [[কবিগান|কবিগান]] ও কীর্তনদলে যোগ দিয়ে তিনি বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে বেড়ান। এক পর্যায়ে বিক্রমপুরের বইমহটির দরবেশ দাগু শাহ্র মাযারে জনৈক দোতারাবাদকের বাদন শুনে তিনি মুগ্ধ হন এবং বাড়ি ফিরে প্রখ্যাত দোতারাবাদক তারাচাঁদ সরকারের নিকট [[দোতারা|দোতারা]] শেখেন। গুরুর শিক্ষা এবং স্বীয় অধ্যবসায়ের ফলে কানাইলাল দোতারায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। | ||
পরে তিনি কৃষ্ণলীলাদলের সঙ্গে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে এক যাত্রানুষ্ঠানে গেলে সেখানে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। [[জসীমউদ্দীন|জসীমউদ্দীন]] তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯৩০ সালে তাঁকে [[কলকাতা|কলকাতা]] নিয়ে যান। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় পলিগীতিগায়ক আববাসউদ্দীনের সঙ্গে, যাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি লোকগীতি রচনা ও সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ হন। আববাসউদ্দীনের সহায়তায় তিনি [[গ্রামোফোন|গ্রামোফোন]] কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নজরুলের গানের সঙ্গে তিনি দোতারায় সহযোগিতা করেন। নজরুল তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হন। পরে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে নিয়মিত দোতারাশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। | পরে তিনি কৃষ্ণলীলাদলের সঙ্গে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে এক যাত্রানুষ্ঠানে গেলে সেখানে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। [[জসীমউদ্দীন|জসীমউদ্দীন]] তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯৩০ সালে তাঁকে [[কলকাতা|কলকাতা]] নিয়ে যান। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় পলিগীতিগায়ক আববাসউদ্দীনের সঙ্গে, যাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি লোকগীতি রচনা ও সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ হন। আববাসউদ্দীনের সহায়তায় তিনি [[গ্রামোফোন|গ্রামোফোন]] কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নজরুলের গানের সঙ্গে তিনি দোতারায় সহযোগিতা করেন। নজরুল তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হন। পরে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে নিয়মিত দোতারাশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সেতারশিল্পী ওস্তাদ এনায়েত খাঁর সঙ্গে কানাইলালের পরিচয় হয়। [[খাঁ, ওস্তাদ এনায়েত|এনায়েত খাঁ]] তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হয়ে কিছুদিন তাঁকে দোতারায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দেন। তিনি বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরবাহারশিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম এবং গুরু ‘ধর্মপিতা’ হিসেবে গ্রহণ করেন। | ||
গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সেতারশিল্পী ওস্তাদ এনায়েত খাঁর সঙ্গে কানাইলালের পরিচয় হয়। [[খাঁ, ওস্তাদ এনায়েত|এনায়েত খাঁ]] তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হয়ে কিছুদিন তাঁকে দোতারায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দেন। তিনি বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরবাহারশিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম এবং গুরু ‘ধর্মপিতা’ হিসেবে গ্রহণ করেন। | |||
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কানাইলাল ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৪৯ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে ‘নিজস্ব শিল্পী’ হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অখ্যাত-অনাদৃত দোতারাকে স্বীয় প্রতিভাবলে বিখ্যাত করে তোলা বাংলা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কানাইলালের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। দোতারায় তিনি সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারতেন, যার ফলে এ লোকবাদ্যযন্ত্র বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। | ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কানাইলাল ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৪৯ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে ‘নিজস্ব শিল্পী’ হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অখ্যাত-অনাদৃত দোতারাকে স্বীয় প্রতিভাবলে বিখ্যাত করে তোলা বাংলা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কানাইলালের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। দোতারায় তিনি সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারতেন, যার ফলে এ লোকবাদ্যযন্ত্র বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। |
০৯:৪০, ১৬ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
শীল, কানাইলাল (১৮৯৫-১৯৭৪) দোতারাবাদক, লোকগীতি রচয়িতা ও সংগ্রাহক এবং সুরকার। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার কইরাল গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আনন্দচন্দ্র শীল ও মাতার নাম সৌদামনী শীল। পিতা আনন্দচন্দ্র শীল ছিলেন একজন সঙ্গীতপ্রেমী ব্যক্তি। কানাইলালের সঙ্গীতপ্রীতি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত।
শৈশবে পিতৃহীন কানাইলাল মাত্র আট বছর বয়সে বসন্তকুমার শীলের নিকট বেহালাবাদন শুরু করেন। পরে মতিলাল ধূপী নামের বিশিষ্ট বেহালাবাদকের নিকট তিনি বেহালায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে যাত্রাদল, গাজীর গান, কবিগান ও কীর্তনদলে যোগ দিয়ে তিনি বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে বেড়ান। এক পর্যায়ে বিক্রমপুরের বইমহটির দরবেশ দাগু শাহ্র মাযারে জনৈক দোতারাবাদকের বাদন শুনে তিনি মুগ্ধ হন এবং বাড়ি ফিরে প্রখ্যাত দোতারাবাদক তারাচাঁদ সরকারের নিকট দোতারা শেখেন। গুরুর শিক্ষা এবং স্বীয় অধ্যবসায়ের ফলে কানাইলাল দোতারায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।
পরে তিনি কৃষ্ণলীলাদলের সঙ্গে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে এক যাত্রানুষ্ঠানে গেলে সেখানে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। জসীমউদ্দীন তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯৩০ সালে তাঁকে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় পলিগীতিগায়ক আববাসউদ্দীনের সঙ্গে, যাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি লোকগীতি রচনা ও সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ হন। আববাসউদ্দীনের সহায়তায় তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নজরুলের গানের সঙ্গে তিনি দোতারায় সহযোগিতা করেন। নজরুল তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হন। পরে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে নিয়মিত দোতারাশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সেতারশিল্পী ওস্তাদ এনায়েত খাঁর সঙ্গে কানাইলালের পরিচয় হয়। এনায়েত খাঁ তাঁর দোতারাবাদনে মুগ্ধ হয়ে কিছুদিন তাঁকে দোতারায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দেন। তিনি বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরবাহারশিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম এবং গুরু ‘ধর্মপিতা’ হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কানাইলাল ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯৪৯ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে ‘নিজস্ব শিল্পী’ হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অখ্যাত-অনাদৃত দোতারাকে স্বীয় প্রতিভাবলে বিখ্যাত করে তোলা বাংলা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কানাইলালের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। দোতারায় তিনি সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারতেন, যার ফলে এ লোকবাদ্যযন্ত্র বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কানাইলাল বহু লোকগীতি সংগ্রহ ও রচনা করেছেন এবং অনেক গানের সুরও করেছেন। তাঁর গান শচীন দেববর্মণ, আববাসউদ্দীন প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছে। পরবর্তীকালে আবদুল আলীম, আবদুল লতিফ, বেদারউদ্দিন আহমদ, ফেরদৌসী রহমান, নীনা হামিদ, ফওজিয়া খানসহ বহু কণ্ঠশিল্পী তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। কানাইলাল দোতারা নির্মাণেও দক্ষ ছিলেন। তিনি তাঁর দোতারা এবং সঙ্গীত দিয়ে বাংলার লোকসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ ও গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। দোতারাকে তিনি মনেপ্রাণে ভালবাসতেন বলেই তিন পুত্রকেও দোতারা শিখিয়েছিলেন এবং তাঁরাও দোতারাবাদনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর রচিত ওসুরারোপিত বহু গান রেকর্ড করা হয়। সঙ্গীতক্ষেত্রে কানাইলালের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৮৭ সালে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই তিনি ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [মোবারক হোসেন খান]