মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
৪ নং লাইন: ৪ নং লাইন:
তবে প্রথম সুবাহদার [[মুর্শিদকুলী খান|মুর্শিদকুলী খান ]]এর (১৭০০-১৭২৭) আমলে মুর্শিদাবাদে কোন চিত্রশালা স্থাপিত হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। তিনি একজন ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং সবধরনের বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর সময়কার কয়েকটি চিত্র- যেমন, ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদকুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’ (আনু. ১৭২০), ‘মুহররম মিছিল’, ‘খাজা খিজিরের উৎসবসমূহ’ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের একটি পাতায় সংরক্ষিত আছে। এ চিত্রগুলির অংকন পদ্ধতি মুগল শিল্পকলার পরবর্তী ও আঞ্চলিক রূপ হিসেবে ধরা যায়। পরবর্তী সুবাহদার সুজাউদ্দীনের (১৭২৭-১৭৩৯) শাসনকালের কোন চিত্র-শিল্প এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
তবে প্রথম সুবাহদার [[মুর্শিদকুলী খান|মুর্শিদকুলী খান ]]এর (১৭০০-১৭২৭) আমলে মুর্শিদাবাদে কোন চিত্রশালা স্থাপিত হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। তিনি একজন ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং সবধরনের বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর সময়কার কয়েকটি চিত্র- যেমন, ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদকুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’ (আনু. ১৭২০), ‘মুহররম মিছিল’, ‘খাজা খিজিরের উৎসবসমূহ’ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের একটি পাতায় সংরক্ষিত আছে। এ চিত্রগুলির অংকন পদ্ধতি মুগল শিল্পকলার পরবর্তী ও আঞ্চলিক রূপ হিসেবে ধরা যায়। পরবর্তী সুবাহদার সুজাউদ্দীনের (১৭২৭-১৭৩৯) শাসনকালের কোন চিত্র-শিল্প এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।


[[Image:MurshidabadPainting1.jpg|thumb|right|দরবার অনুষ্ঠান (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা]]
প্রকৃত মুর্শিদাবাদ শৈলীতে অংকিত চিত্রকর্ম পরবর্তী শাসনকর্তা নবাব আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬) সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের মতে আলীবর্দী খান শিল্প ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারের কয়েকটি চিত্রকর্ম যেমন, ‘হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু. ১৭৫০-১৭৫৫),‘বাগান চত্বরে ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাথে আলাপরত নওয়াব আলীবর্দী খান’ বর্তমানে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এগুলি প্রাথমিক মুর্শিদাবাদ শিল্পকলার স্বাক্ষর বহন করছে এবং এ বৃদ্ধ শাসক দরবার ও শিকার-দৃশ্য পছন্দ করতেন। তাঁর দরবার ও শিকার দৃশ্যে বিষণ্ণতা, উজ্জ্বল সাদা ও ধূসর রং-এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
প্রকৃত মুর্শিদাবাদ শৈলীতে অংকিত চিত্রকর্ম পরবর্তী শাসনকর্তা নবাব আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬) সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের মতে আলীবর্দী খান শিল্প ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারের কয়েকটি চিত্রকর্ম যেমন, ‘হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু. ১৭৫০-১৭৫৫),‘বাগান চত্বরে ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাথে আলাপরত নওয়াব আলীবর্দী খান’ বর্তমানে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এগুলি প্রাথমিক মুর্শিদাবাদ শিল্পকলার স্বাক্ষর বহন করছে এবং এ বৃদ্ধ শাসক দরবার ও শিকার-দৃশ্য পছন্দ করতেন। তাঁর দরবার ও শিকার দৃশ্যে বিষণ্ণতা, উজ্জ্বল সাদা ও ধূসর রং-এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।


আলীবর্দী খানের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। তাঁর উদার মনোভাবের কারণে মুর্শিদাবাদ দরবারের চিত্রকলা আরও সমৃদ্ধ হয় ও বিস্তার লাভ করে। আনুষ্ঠানিক দরবার দৃশ্য ও কথোপকথন দৃশ্য ব্যতীত তাঁর চিত্রকরদের নিভৃত অন্দরমহল ও রাগমালা দৃশ্য অংকনে উৎসাহিত করা হয়।  
আলীবর্দী খানের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। তাঁর উদার মনোভাবের কারণে মুর্শিদাবাদ দরবারের চিত্রকলা আরও সমৃদ্ধ হয় ও বিস্তার লাভ করে। আনুষ্ঠানিক দরবার দৃশ্য ও কথোপকথন দৃশ্য ব্যতীত তাঁর চিত্রকরদের নিভৃত অন্দরমহল ও রাগমালা দৃশ্য অংকনে উৎসাহিত করা হয়।  
[[Image:MurshidabadPainting1.jpg|thumb|right|দরবার অনুষ্ঠান (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা]]


সিরাজউদ্দৌলার স্বল্পকালীন শাসন-আমলে শিল্পকলার চর্চায় এক নতুন উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। দরবারের শিল্পিরা অনেক রাগ-রাগিণীর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। এসব রাগ-রাগিণীর দৃশ্যের মধ্যে হিন্দোল, গুজরী, ককুভা, মধু-মাধবী, বাঙ্গালী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ের চিত্রসমূহের মধ্যে রোমান্টিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা দরবার চত্বর অথবা নদী ভ্রমণে নর-নারীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
সিরাজউদ্দৌলার স্বল্পকালীন শাসন-আমলে শিল্পকলার চর্চায় এক নতুন উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। দরবারের শিল্পিরা অনেক রাগ-রাগিণীর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। এসব রাগ-রাগিণীর দৃশ্যের মধ্যে হিন্দোল, গুজরী, ককুভা, মধু-মাধবী, বাঙ্গালী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ের চিত্রসমূহের মধ্যে রোমান্টিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা দরবার চত্বর অথবা নদী ভ্রমণে নর-নারীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১৭ নং লাইন: ১৫ নং লাইন:
পরবর্তী শাসনকর্তা মীরজাফরের আমলে (১৭৫৭-১৭৬০) মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা অংকন রীতিতে তেমন কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায় না, বরং এ সময় সিরাজউদ্দৌলার আমলের চিত্রকলার সজীবতা ও সৌন্দর্য হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্ণৌর প্রসিদ্ধ চিত্রকর পুরাননাথ ওরফে হুনহর মুর্শিদাবাদ চিত্রশালায় যোগ দেন। একটি সুন্দর চিত্রকলাতে পুরাননাথ এক বিশাল মাঠে নওয়াব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মিরনের সৈন্যবাহিনী পরিদর্শনের চিত্র অঙ্কন করেন। এটি বর্তমানে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (Victoria & Albert Museum) সংরক্ষিত আছে। অপরাপর মিনিয়েচার চিত্রসমূহে স্বাভাবিক উপবেশনে নওয়াবের একক চিত্র, আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্র ইত্যাদি দেখা যায়। বিষয়বস্ত্ত ও বিষণ্ণ পরিপার্শ্বিক অবস্থার মনোনয়ন এবং হালকা রং বিন্যাসের ক্ষেত্রে সদৃশতার বিচারে এ চিত্রকলাসমূহ আলীবর্দী খানের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।
পরবর্তী শাসনকর্তা মীরজাফরের আমলে (১৭৫৭-১৭৬০) মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা অংকন রীতিতে তেমন কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায় না, বরং এ সময় সিরাজউদ্দৌলার আমলের চিত্রকলার সজীবতা ও সৌন্দর্য হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্ণৌর প্রসিদ্ধ চিত্রকর পুরাননাথ ওরফে হুনহর মুর্শিদাবাদ চিত্রশালায় যোগ দেন। একটি সুন্দর চিত্রকলাতে পুরাননাথ এক বিশাল মাঠে নওয়াব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মিরনের সৈন্যবাহিনী পরিদর্শনের চিত্র অঙ্কন করেন। এটি বর্তমানে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (Victoria & Albert Museum) সংরক্ষিত আছে। অপরাপর মিনিয়েচার চিত্রসমূহে স্বাভাবিক উপবেশনে নওয়াবের একক চিত্র, আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্র ইত্যাদি দেখা যায়। বিষয়বস্ত্ত ও বিষণ্ণ পরিপার্শ্বিক অবস্থার মনোনয়ন এবং হালকা রং বিন্যাসের ক্ষেত্রে সদৃশতার বিচারে এ চিত্রকলাসমূহ আলীবর্দী খানের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।


[[Image:MurshidabadPainting2.jpg|thumb|right|’হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা]]
[[Image:MurshidabadPainting2.jpg|thumb|left|’হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা]]


নওয়াব মীরজাফরের সময়ে লক্ষ্ণৌর যেসব চিত্রকর রাজকীয় চিত্রশালায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা শাসনকর্তা [[মীরকাসিম|মীরকাশিম]] এর (১৭৬০-৬৩) চিত্রশালায়ও কাজ করেন। এ চিত্রকরদের মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রকর দীপচাঁদ-এর দক্ষ হাতে অংকিত হয় মীরকাশিমের অন্যতম সভাসদ গুরগান-এর প্রসিদ্ধ প্রতিকৃতি, যা বর্তমানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ সময়ে অংকিত নওয়াবদের আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্রসমূহ পূর্ববর্তী শাসন আমলের চিত্রকর্মের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মীরকাশিমের সময়ে লক্ষ্ণৌর চিত্রকরদের আগমন ও প্রাধান্যের কারণে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলার রীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয় এবং মুগল চিত্রকলার প্রচলিত রীতির পরিবর্তে লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার নতুন রীতি স্থান লাভ করে।
নওয়াব মীরজাফরের সময়ে লক্ষ্ণৌর যেসব চিত্রকর রাজকীয় চিত্রশালায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা শাসনকর্তা [[মীরকাসিম|মীরকাশিম]] এর (১৭৬০-৬৩) চিত্রশালায়ও কাজ করেন। এ চিত্রকরদের মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রকর দীপচাঁদ-এর দক্ষ হাতে অংকিত হয় মীরকাশিমের অন্যতম সভাসদ গুরগান-এর প্রসিদ্ধ প্রতিকৃতি, যা বর্তমানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ সময়ে অংকিত নওয়াবদের আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্রসমূহ পূর্ববর্তী শাসন আমলের চিত্রকর্মের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মীরকাশিমের সময়ে লক্ষ্ণৌর চিত্রকরদের আগমন ও প্রাধান্যের কারণে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলার রীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয় এবং মুগল চিত্রকলার প্রচলিত রীতির পরিবর্তে লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার নতুন রীতি স্থান লাভ করে।


আবেগাপ্লুত নওয়াব ও সভাসদদের প্রতিকৃতি, চিত্রে ধূসর ও ঈষৎ পিঙ্গল বর্ণের পটভূমি, পটভূমিতে ফুলের সমারোহ এ সবই লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের পরাজয় ও ক্ষমতাচ্যুতি এবং বৃদ্ধ ও পুতুলবৎ নওয়াব মীরজাফরের দ্বিতীয়বার মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য যে উপযোগী পরিবেশের প্রয়োজন তা বাধাগ্রস্ত হয়। মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা পৃষ্ঠপোষকতার ভার তখন মুর্শিদাবাদের ধনাঢ্য জমিদার, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, হিন্দু ও জৈন-ব্যবসায়ী এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বসবাসকারী ইংরেজ কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত হয়। এরা বিপর্যস্ত চিত্রকরদের হিন্দু-মুসলমানের পান্ডুলিপি ও মুরক্কাসমূহকে (ছবির অ্যালবাম) চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার কাজে নিযুক্ত করেন। এ মুরক্কাগুলির মধ্যে মুগল শাসক, [[নওয়াব|নওয়াব]], সভাসদ, রাগমালার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি প্রভৃতি ছিল। পান্ডুলিপি ও অ্যালবামের মধ্যে ‘দস্ত্তর-ই-হিমায়াত’, ‘রজমনামা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘নবব দমন’, ‘রাগমালা’ এবং ‘নায়ক-নায়িকাভেদ’ পৃষ্ঠপোষকদের আনুকূল্য পায়। হিন্দু দেবতা ও ধর্মীয় বিষয়সমূহ চিত্রাঙ্কণে চিত্রশিল্পিরা বাংলার হিন্দু ধর্মমতের স্থানীয় রূপ- যেমন বৈষ্ণব সংক্রান্ত বিষয় ও তান্ত্রিক রীতিসমূহ চিত্রায়িত করেছেন। ক্ষুদ্রাকৃতির ঐ সকল চিত্র অঙ্কনে চিত্রশিল্পিরা বিশ্বস্ততার সাথে বাংলার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ছবি অতিসাধারণভাবে অঙ্কন করেছেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ  দুর্ভিক্ষ পতনোন্মুখ মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতির শেষ চিহ্নের ওপর আঘাত হানে। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত চিত্রকরেরা ব্রিটিশ প্রভুদের চিত্র-কর্মশালায় আশ্রয় গ্রহণ করে সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পকলার ভাব-ধারায় প্রভাবিত কোম্পানি শিল্পকলা রীতি গ্রহণ করে। [নাজমা খান মজলিস]
আবেগাপ্লুত নওয়াব ও সভাসদদের প্রতিকৃতি, চিত্রে ধূসর ও ঈষৎ পিঙ্গল বর্ণের পটভূমি, পটভূমিতে ফুলের সমারোহ এ সবই লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের পরাজয় ও ক্ষমতাচ্যুতি এবং বৃদ্ধ ও পুতুলবৎ নওয়াব মীরজাফরের দ্বিতীয়বার মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য যে উপযোগী পরিবেশের প্রয়োজন তা বাধাগ্রস্ত হয়। মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা পৃষ্ঠপোষকতার ভার তখন মুর্শিদাবাদের ধনাঢ্য জমিদার, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, হিন্দু ও জৈন-ব্যবসায়ী এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বসবাসকারী ইংরেজ কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত হয়। এরা বিপর্যস্ত চিত্রকরদের হিন্দু-মুসলমানের পান্ডুলিপি ও মুরক্কাসমূহকে (ছবির অ্যালবাম) চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার কাজে নিযুক্ত করেন। এ মুরক্কাগুলির মধ্যে মুগল শাসক, [[নওয়াব|নওয়াব]], সভাসদ, রাগমালার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি প্রভৃতি ছিল। পান্ডুলিপি ও অ্যালবামের মধ্যে ‘দস্ত্তর-ই-হিমায়াত’, ‘রজমনামা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘নবব দমন’, ‘রাগমালা’ এবং ‘নায়ক-নায়িকাভেদ’ পৃষ্ঠপোষকদের আনুকূল্য পায়। হিন্দু দেবতা ও ধর্মীয় বিষয়সমূহ চিত্রাঙ্কণে চিত্রশিল্পিরা বাংলার হিন্দু ধর্মমতের স্থানীয় রূপ- যেমন বৈষ্ণব সংক্রান্ত বিষয় ও তান্ত্রিক রীতিসমূহ চিত্রায়িত করেছেন। ক্ষুদ্রাকৃতির ঐ সকল চিত্র অঙ্কনে চিত্রশিল্পিরা বিশ্বস্ততার সাথে বাংলার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ছবি অতিসাধারণভাবে অঙ্কন করেছেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ  দুর্ভিক্ষ পতনোন্মুখ মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতির শেষ চিহ্নের ওপর আঘাত হানে। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত চিত্রকরেরা ব্রিটিশ প্রভুদের চিত্র-কর্মশালায় আশ্রয় গ্রহণ করে সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পকলার ভাব-ধারায় প্রভাবিত কোম্পানি শিল্পকলা রীতি গ্রহণ করে। [নাজমা খান মজলিস]

০৪:১৬, ৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা  মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যগত মুগল ধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক নতুন ধারা। মুর্শিদাবাদ আঠারো শতকের প্রথম চতুর্থাংশে বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল। প্রদেশটি ছিল পাল ও হোসেন শাহী আমলে শিল্প ও সংস্কৃতির একটি বড় কেন্দ্র। মুগলগণও এ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পতনোন্মুখ মুগল সাম্রাজ্যের দরবারী শিল্পিগণ যখন তাঁদের জীবিকার সন্ধানে মুর্শিদাবাদের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন এ প্রদেশের শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আঠারো শতকে ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্থায়ী সরকারের কারণে মুর্শিদাবাদে সমৃদ্ধির এক নতুন যুগের সূত্রপাত হয়।

তবে প্রথম সুবাহদার মুর্শিদকুলী খান এর (১৭০০-১৭২৭) আমলে মুর্শিদাবাদে কোন চিত্রশালা স্থাপিত হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। তিনি একজন ধার্মিক শাসক ছিলেন এবং সবধরনের বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর সময়কার কয়েকটি চিত্র- যেমন, ভাগীরথী নদীর তীরে মুর্শিদকুলী খানের দরবার অনুষ্ঠান’ (আনু. ১৭২০), ‘মুহররম মিছিল’, ‘খাজা খিজিরের উৎসবসমূহ’ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ক্লাইভ অ্যালবামের একটি পাতায় সংরক্ষিত আছে। এ চিত্রগুলির অংকন পদ্ধতি মুগল শিল্পকলার পরবর্তী ও আঞ্চলিক রূপ হিসেবে ধরা যায়। পরবর্তী সুবাহদার সুজাউদ্দীনের (১৭২৭-১৭৩৯) শাসনকালের কোন চিত্র-শিল্প এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

দরবার অনুষ্ঠান (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা

প্রকৃত মুর্শিদাবাদ শৈলীতে অংকিত চিত্রকর্ম পরবর্তী শাসনকর্তা নবাব আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬) সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের মতে আলীবর্দী খান শিল্প ও সংস্কৃতির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারের কয়েকটি চিত্রকর্ম যেমন, ‘হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু. ১৭৫০-১৭৫৫),‘বাগান চত্বরে ভ্রাতুষ্পুত্রদের সাথে আলাপরত নওয়াব আলীবর্দী খান’ বর্তমানে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এগুলি প্রাথমিক মুর্শিদাবাদ শিল্পকলার স্বাক্ষর বহন করছে এবং এ বৃদ্ধ শাসক দরবার ও শিকার-দৃশ্য পছন্দ করতেন। তাঁর দরবার ও শিকার দৃশ্যে বিষণ্ণতা, উজ্জ্বল সাদা ও ধূসর রং-এর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।

আলীবর্দী খানের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। তাঁর উদার মনোভাবের কারণে মুর্শিদাবাদ দরবারের চিত্রকলা আরও সমৃদ্ধ হয় ও বিস্তার লাভ করে। আনুষ্ঠানিক দরবার দৃশ্য ও কথোপকথন দৃশ্য ব্যতীত তাঁর চিত্রকরদের নিভৃত অন্দরমহল ও রাগমালা দৃশ্য অংকনে উৎসাহিত করা হয়।

সিরাজউদ্দৌলার স্বল্পকালীন শাসন-আমলে শিল্পকলার চর্চায় এক নতুন উদ্যম পরিলক্ষিত হয়। দরবারের শিল্পিরা অনেক রাগ-রাগিণীর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। এসব রাগ-রাগিণীর দৃশ্যের মধ্যে হিন্দোল, গুজরী, ককুভা, মধু-মাধবী, বাঙ্গালী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সময়ের চিত্রসমূহের মধ্যে রোমান্টিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা দরবার চত্বর অথবা নদী ভ্রমণে নর-নারীর অন্তরঙ্গ দৃশ্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

পূর্ববর্তী মুগল-চিত্রকরদের ন্যায় মুর্শিদাবাদের চিত্রকরেরা হাতে তৈরি কাগজে জলরং ব্যবহার করে চিত্রাঙ্কণ করতেন। তারা মুগল শিল্প-রীতি অনুসারে অংকনের কাজ করতেন। দিগন্ত সীমায় অর্ধবৃত্তাকার ঝোপের সারি, শান্ত নদীতীরে সারস পাখির দল, দূরে তরঙ্গায়িত টিলার মাঝে অর্ধবৃত্তাকার গুল্মরাজি শোভিত বীথি এ সবই মুর্শিদাবাদ শিল্পরীতির পরিচয় বহন করে।

পরবর্তী শাসনকর্তা মীরজাফরের আমলে (১৭৫৭-১৭৬০) মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা অংকন রীতিতে তেমন কোন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায় না, বরং এ সময় সিরাজউদ্দৌলার আমলের চিত্রকলার সজীবতা ও সৌন্দর্য হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে লক্ষ্ণৌর প্রসিদ্ধ চিত্রকর পুরাননাথ ওরফে হুনহর মুর্শিদাবাদ চিত্রশালায় যোগ দেন। একটি সুন্দর চিত্রকলাতে পুরাননাথ এক বিশাল মাঠে নওয়াব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মিরনের সৈন্যবাহিনী পরিদর্শনের চিত্র অঙ্কন করেন। এটি বর্তমানে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (Victoria & Albert Museum) সংরক্ষিত আছে। অপরাপর মিনিয়েচার চিত্রসমূহে স্বাভাবিক উপবেশনে নওয়াবের একক চিত্র, আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্র ইত্যাদি দেখা যায়। বিষয়বস্ত্ত ও বিষণ্ণ পরিপার্শ্বিক অবস্থার মনোনয়ন এবং হালকা রং বিন্যাসের ক্ষেত্রে সদৃশতার বিচারে এ চিত্রকলাসমূহ আলীবর্দী খানের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।

’হরিণ শিকারে মত্ত নওয়াব আলীবর্দী খান’ (আনু, ১৭৫০-৫৫), মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা

নওয়াব মীরজাফরের সময়ে লক্ষ্ণৌর যেসব চিত্রকর রাজকীয় চিত্রশালায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা শাসনকর্তা মীরকাশিম এর (১৭৬০-৬৩) চিত্রশালায়ও কাজ করেন। এ চিত্রকরদের মধ্যে প্রখ্যাত চিত্রকর দীপচাঁদ-এর দক্ষ হাতে অংকিত হয় মীরকাশিমের অন্যতম সভাসদ গুরগান-এর প্রসিদ্ধ প্রতিকৃতি, যা বর্তমানে ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ সময়ে অংকিত নওয়াবদের আনুষ্ঠানিক দরবার চিত্রসমূহ পূর্ববর্তী শাসন আমলের চিত্রকর্মের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। মীরকাশিমের সময়ে লক্ষ্ণৌর চিত্রকরদের আগমন ও প্রাধান্যের কারণে মুর্শিদাবাদ চিত্রকলার রীতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয় এবং মুগল চিত্রকলার প্রচলিত রীতির পরিবর্তে লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার নতুন রীতি স্থান লাভ করে।

আবেগাপ্লুত নওয়াব ও সভাসদদের প্রতিকৃতি, চিত্রে ধূসর ও ঈষৎ পিঙ্গল বর্ণের পটভূমি, পটভূমিতে ফুলের সমারোহ এ সবই লক্ষ্ণৌ চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইংরেজদের হাতে মীরকাশিমের পরাজয় ও ক্ষমতাচ্যুতি এবং বৃদ্ধ ও পুতুলবৎ নওয়াব মীরজাফরের দ্বিতীয়বার মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের জন্য যে উপযোগী পরিবেশের প্রয়োজন তা বাধাগ্রস্ত হয়। মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা পৃষ্ঠপোষকতার ভার তখন মুর্শিদাবাদের ধনাঢ্য জমিদার, সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার, হিন্দু ও জৈন-ব্যবসায়ী এবং মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বসবাসকারী ইংরেজ কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত হয়। এরা বিপর্যস্ত চিত্রকরদের হিন্দু-মুসলমানের পান্ডুলিপি ও মুরক্কাসমূহকে (ছবির অ্যালবাম) চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করার কাজে নিযুক্ত করেন। এ মুরক্কাগুলির মধ্যে মুগল শাসক, নওয়াব, সভাসদ, রাগমালার প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি প্রভৃতি ছিল। পান্ডুলিপি ও অ্যালবামের মধ্যে ‘দস্ত্তর-ই-হিমায়াত’, ‘রজমনামা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘নবব দমন’, ‘রাগমালা’ এবং ‘নায়ক-নায়িকাভেদ’ পৃষ্ঠপোষকদের আনুকূল্য পায়। হিন্দু দেবতা ও ধর্মীয় বিষয়সমূহ চিত্রাঙ্কণে চিত্রশিল্পিরা বাংলার হিন্দু ধর্মমতের স্থানীয় রূপ- যেমন বৈষ্ণব সংক্রান্ত বিষয় ও তান্ত্রিক রীতিসমূহ চিত্রায়িত করেছেন। ক্ষুদ্রাকৃতির ঐ সকল চিত্র অঙ্কনে চিত্রশিল্পিরা বিশ্বস্ততার সাথে বাংলার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ছবি অতিসাধারণভাবে অঙ্কন করেছেন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ  দুর্ভিক্ষ পতনোন্মুখ মুর্শিদাবাদ চিত্রকলা রীতির শেষ চিহ্নের ওপর আঘাত হানে। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত চিত্রকরেরা ব্রিটিশ প্রভুদের চিত্র-কর্মশালায় আশ্রয় গ্রহণ করে সমসাময়িক ইউরোপীয় শিল্পকলার ভাব-ধারায় প্রভাবিত কোম্পানি শিল্পকলা রীতি গ্রহণ করে। [নাজমা খান মজলিস]