তরফদার, মমতাজুর রহমান: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(fix: image tag)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''তরফদার'''''', ''''''মমতাজুর রহমান '''(১৯২৮-১৯৯৭)  একজন জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক। বগুড়া জেলার মেঘগাছা গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী তরফদার তাঁর নিজ জেলাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশুনা সম্পন্ন করেন। ১৯৪৭ সালে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে বগুড়া ছেড়ে তিনি ঢাকা আসেন এবং [[১০২৩১৯|ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]] থেকে ১৯৪৯ সালে বি.এ্র ও ১৯৫১ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ্র পাস করেন। ১৯৬১ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তরফদার মুন্সিগঞ্জ জেলার হরগঙ্গা কলেজে ১৯৫২ সালে প্রভাসক হিসেবে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বিভাগে যোগদানের জন্য হরগঙ্গা কলেজের চাকরি ত্যাগ করেন। ১৯৯৭ সালের ৩১ জুলাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময়ই শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকেছেন। এই দীর্ঘ ও কৃতিত্বপূর্ণ চাকরি জীবনে তিনি ব্রিটেনের নুফিল্ড ফাউন্ডেশন (১৯৭২-১৯৭৪), আমেরিকার ডারহামস্থ ডিউক ইউনিভার্সিটি (১৯৯৬) এবং ঢাকাস্থ [[১০৩৬৮৫|বাংলা একাডেমী]] (১৯৯৭) ও বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (১৯৯৭) ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পদক প্রদান করে।  
[[Image:TarafdarMomtazurRahman.jpg|thumb|400px|মমতাজুর রহমান তরফদার]]
'''তরফদার, মমতাজুর রহমান''' (১৯২৮-১৯৯৭)  একজন জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক। বগুড়া জেলার মেঘগাছা গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী তরফদার তাঁর নিজ জেলাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশুনা সম্পন্ন করেন। ১৯৪৭ সালে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে বগুড়া ছেড়ে তিনি ঢাকা আসেন এবং [[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়|ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]] থেকে ১৯৪৯ সালে বি.ও ১৯৫১ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.পাস করেন। ১৯৬১ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তরফদার মুন্সিগঞ্জ জেলার হরগঙ্গা কলেজে ১৯৫২ সালে প্রভাসক হিসেবে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বিভাগে যোগদানের জন্য হরগঙ্গা কলেজের চাকরি ত্যাগ করেন। ১৯৯৭ সালের ৩১ জুলাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময়ই শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকেছেন। এই দীর্ঘ ও কৃতিত্বপূর্ণ চাকরি জীবনে তিনি ব্রিটেনের নুফিল্ড ফাউন্ডেশন (১৯৭২-১৯৭৪), আমেরিকার ডারহামস্থ ডিউক ইউনিভার্সিটি (১৯৯৬) এবং ঢাকাস্থ [[বাংলা একাডেমী|বাংলা একাডেমী]] (১৯৯৭) ও বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (১৯৯৭) ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পদক প্রদান করে।  


তরফদারের পি-এইচ.ডি অভিসন্দর্ভের জন্য রচিত হোসেনশাহী বেঙ্গল বাঙালি জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বাংলার ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে উপর প্রণীত সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তৎকালীন প্রশাসন, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যে সকল চিন্তা-চেতনা লেখকের বাকি জীবন আবিষ্ট করে, তা এগুলির মধ্যেই ভ্রূণাবস্থায় নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের দায়িত্ব হচ্ছে অতীতের তথ্য সরবরাহ করা, যাতে বর্তমান বোধগম্য হয়। সমকালীন সমাজের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করে তোলে। তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক বাঙালি ব্যক্তিসত্ত্বার স্থান নির্ধারণে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও শেকড় অনুসন্ধানে ব্রত হন। গবেষণার জন্য তিনি হোসেনশাহী যুগকে বেছে নেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় এ যুগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যোগ্যতার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণা উপকরণ ব্যবহারে পারঙ্গম তরফদারের ছিল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে, বিশেষ করে লোকজ ও প্রচলিত নিয়মানুগ নয় এমন পর্যায়ে, গতিশীল সম্পর্ক অনুসন্ধানে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। তিনি বাঙালির বস্ত্তগত সংস্কৃতি অনুধাবনের জন্য সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে গবেষণা করেন।  
তরফদারের পি-এইচ.ডি অভিসন্দর্ভের জন্য রচিত হোসেনশাহী বেঙ্গল বাঙালি জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বাংলার ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে উপর প্রণীত সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তৎকালীন প্রশাসন, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যে সকল চিন্তা-চেতনা লেখকের বাকি জীবন আবিষ্ট করে, তা এগুলির মধ্যেই ভ্রূণাবস্থায় নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের দায়িত্ব হচ্ছে অতীতের তথ্য সরবরাহ করা, যাতে বর্তমান বোধগম্য হয়। সমকালীন সমাজের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করে তোলে। তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক বাঙালি ব্যক্তিসত্ত্বার স্থান নির্ধারণে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও শেকড় অনুসন্ধানে ব্রত হন। গবেষণার জন্য তিনি হোসেনশাহী যুগকে বেছে নেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় এ যুগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যোগ্যতার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণা উপকরণ ব্যবহারে পারঙ্গম তরফদারের ছিল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে, বিশেষ করে লোকজ ও প্রচলিত নিয়মানুগ নয় এমন পর্যায়ে, গতিশীল সম্পর্ক অনুসন্ধানে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। তিনি বাঙালির বস্ত্তগত সংস্কৃতি অনুধাবনের জন্য সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে গবেষণা করেন।  


<nowiki>#</nowiki> #[[Image:তরফদার, মমতাজুর রহমান_html_88407781.png]]
১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তাঁর ''Trade, Technology and Society in Medieval Bengal'' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি মধ্যযুগে বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে। সাহিত্য, ধর্ম ও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক তাঁর অন্যান্য গবেষণাবলী সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ, আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।


[[Image:TarafdarMomtazurRahman.jpg|thumb|400px]]
অধ্যাপক তরফদারের বাংলা রোমান্টিক কাব্যের হিন্দি-আউধি পটভূমি হচ্ছে চৌদ্দ থেকে ষোল শতকের হিন্দি কাব্য এবং সতেরো ও আঠারো শতকের বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান কবিদের দ্বারা অনুকরণকৃত গ্রন্থগুলির একটি তুলনামূলক আলোচনা। এ সকল হিন্দি কবির মানবীয় গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে তরফদার তাঁদেরকে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের পূর্বসূরী হিসেবে উচ্চাসন দান করেন। তিনি অনুবাদসহ হিন্দি কবিতা থেকে উদাহরণ দেন এবং বাংলা কবিতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। এগুলির উৎপত্তি অনুসন্ধানের জন্য তিনি গোটা ভারত, এমনকি ভারতের বাইরের সাহিত্যের প্রতিও নজর দেন এবং ফারসি, আরবি, গ্রিক ও ইতালীয় কাব্যের সম্ভাব্য উৎসের সঙ্গে হিন্দি কাব্যের তুলনা করেন।


# #মমতাজুর রহমান তরফদার
মমতাজুর রহমান তাঁর ‘The Cultural Identity of Bengali Muslims as Reflected in Medieval Bengali Literature’ প্রবন্ধে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি অভিযানের পর মুসলিম অভিজাত শ্রেণি গঠন সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রথম তিন শতক ব্যাপী মুসলিম অভিজাত শ্রেণি ছিল বিদেশি। তারা নগরকেন্দ্রগুলিতে বসবাস করতেন এবং ব্যবহার করতেন কেবল আরবি ও ফারসি ভাষা। তাঁদের শিক্ষা গ্রামাঞ্চলের ধর্মান্তরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে পৌঁছত না, কেননা তারা বাংলা ব্যতীত অপর কোন ভাষা জানত না। ষোল শতকের শেষ দিকে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে সুফি সাহিত্যের চর্চা শুরু হলে তার মধ্য দিয়ে দেশিয় মুসলমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। এ সুফি সাহিত্যের চর্চা হতো প্রধানত চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে, যে অঞ্চল ছিল বেশ কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিলন-মিশ্রণের জন্য খ্যাত। সৈয়দ সুলতান, মুহাম্মদ খান, শেখ চাঁদ, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত ওয়াজির বাহরাম, শাহ বরিদ খান প্রমুখ কবি যদিও এদেশে এসেছিলেন অভিবাসি হয়ে, কিন্তু তাঁরা বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। তাঁদের কবিতায় বাংলার আবহে হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর জীবন, ইসলামি কিংবদন্তী এবং প্রেমোপাখ্যান স্থান পায়।
 
১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তাঁর ''Trade'','' Technology and Society in Medieval Bengal'' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি মধ্যযুগে বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে। সাহিত্য, ধর্ম ও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক তাঁর অন্যান্য গবেষণাবলী সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ, আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।
 
অধ্যাপক তরফদারের বাংলা রোমান্টিক কাব্যের হিন্দি''-''আউধি পটভূমি হচ্ছে চৌদ্দ থেকে ষোল শতকের হিন্দি কাব্য এবং সতেরো ও আঠারো শতকের বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান কবিদের দ্বারা অনুকরণকৃত গ্রন্থগুলির একটি তুলনামূলক আলোচনা। এ সকল হিন্দি কবির মানবীয় গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে তরফদার তাঁদেরকে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের পূর্বসূরী হিসেবে উচ্চাসন দান করেন। তিনি অনুবাদসহ হিন্দি কবিতা থেকে উদাহরণ দেন এবং বাংলা কবিতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। এগুলির উৎপত্তি অনুসন্ধানের জন্য তিনি গোটা ভারত, এমনকি ভারতের বাইরের সাহিত্যের প্রতিও নজর দেন এবং ফারসি, আরবি, গ্রিক ও ইতালীয় কাব্যের সম্ভাব্য উৎসের সঙ্গে হিন্দি কাব্যের তুলনা করেন।
 
মমতাজুর রহমান তাঁর ‘''The Cultural Identity of Bengali Muslims as Reflected in Medieval Bengali Literature''’ প্রবন্ধে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি অভিযানের পর মুসলিম অভিজাত শ্রেণি গঠন সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রথম তিন শতক ব্যাপী মুসলিম অভিজাত শ্রেণি ছিল বিদেশি। তারা নগরকেন্দ্রগুলিতে বসবাস করতেন এবং ব্যবহার করতেন কেবল আরবি ও ফারসি ভাষা। তাঁদের শিক্ষা গ্রামাঞ্চলের ধর্মান্তরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে পৌঁছত না, কেননা তারা বাংলা ব্যতীত অপর কোন ভাষা জানত না। ষোল শতকের শেষ দিকে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে সুফি সাহিত্যের চর্চা শুরু হলে তার মধ্য দিয়ে দেশিয় মুসলমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। এ সুফি সাহিত্যের চর্চা হতো প্রধানত চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে, যে অঞ্চল ছিল বেশ কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিলন-মিশ্রণের জন্য খ্যাত। সৈয়দ সুলতান, মুহাম্মদ খান, শেখ চাঁদ, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত ওয়াজির বাহরাম, শাহ বরিদ খান প্রমুখ কবি যদিও এদেশে এসেছিলেন অভিবাসি হয়ে, কিন্তু তাঁরা বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। তাঁদের কবিতায় বাংলার আবহে হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর জীবন, ইসলামি কিংবদন্তী এবং প্রেমোপাখ্যান স্থান পায়।


ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহিরাগত ও স্থানীয় মুসলমান এবং দেশিয় বৌদ্ধ ও হিন্দুর সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উপাদানসমূহের প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন সাহিত্য (ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার) এবং স্থাপত্য কর্মে। সুফি পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে বংশানুক্রমিক পীর এবং অন্যরা ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে সাধারণ জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অধ্যাপক তরফদার সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক অবনতি ঘটে তখন, যখন এ সকল সুফি পরিবারকে হীন অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রথমত বহিরাগত আশরাফদের (অভিজাত) ক্রমান্বয়ে বাংলায় আগমন এবং দ্বিতীয়ত উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।  
ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহিরাগত ও স্থানীয় মুসলমান এবং দেশিয় বৌদ্ধ ও হিন্দুর সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উপাদানসমূহের প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন সাহিত্য (ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার) এবং স্থাপত্য কর্মে। সুফি পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে বংশানুক্রমিক পীর এবং অন্যরা ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে সাধারণ জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অধ্যাপক তরফদার সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক অবনতি ঘটে তখন, যখন এ সকল সুফি পরিবারকে হীন অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রথমত বহিরাগত আশরাফদের (অভিজাত) ক্রমান্বয়ে বাংলায় আগমন এবং দ্বিতীয়ত উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।  
২০ নং লাইন: ১৫ নং লাইন:
সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের মাধ্যমে বিশ শতকে জাতি গঠন প্রক্রিয়া পুনরায় বাধাগ্রস্থ হয়। এ জাতির ক্রমবিকাশের তথ্য সংগ্রহকারী একজন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক হিসেবে তরফদার খোদ বাংলাদেশেই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক সংকট দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বেশ কিছু বাংলা প্রবন্ধে তিনি এ সমস্যা অনুধাবনের ও এর সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করেন। এ সকল প্রবন্ধের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭১ সালে তিনি রচনা করেন ‘জাতীয় চেতনা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে বাঙালি জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির বিন্যাস এবং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।
সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের মাধ্যমে বিশ শতকে জাতি গঠন প্রক্রিয়া পুনরায় বাধাগ্রস্থ হয়। এ জাতির ক্রমবিকাশের তথ্য সংগ্রহকারী একজন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক হিসেবে তরফদার খোদ বাংলাদেশেই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক সংকট দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বেশ কিছু বাংলা প্রবন্ধে তিনি এ সমস্যা অনুধাবনের ও এর সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করেন। এ সকল প্রবন্ধের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭১ সালে তিনি রচনা করেন ‘জাতীয় চেতনা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে বাঙালি জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির বিন্যাস এবং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।


ইতিহাসের কাল বিভাজনের ক্ষেত্রেও তরফদারের ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সূচিত সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে তিনি প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ ইত্যাদি রূপে কাল বিভাজনের পক্ষাবলম্বন করেন। একই সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কাল নির্ধারণ, যেমন হিন্দু/বৌদ্ধ, মুসলিম এবং ব্রিটিশ আমল ইত্যাদি হিসেবে কাল বিভাজনের রীতির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ যেমন [[১০৩৫৮৬|রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়]], [[১০৪৪৪৯|রমেশচন্দ্র মজুমদার]], [[১০৫৫৫৬|হরপ্রসাদ শাস্ত্রী]] প্রমুখ ভারতীয় ইতিহাস বর্ণনায় সম্প্রদায়ভিত্তিক কাল বিভাজনের পক্ষে ছিলেন। তরফদার যুক্তি দেন যে, শাসকের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনই এক অবস্থা থেকে অপর অবস্থায় রূপান্তরের ক্রান্তিকালকে নির্দেশ করে না; বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সূচিত হওয়া থেকেই ক্রান্তিকালকে সুনির্দিষ্ট করা যায়।  [পারভীন হাসান]  
ইতিহাসের কাল বিভাজনের ক্ষেত্রেও তরফদারের ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সূচিত সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে তিনি প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ ইত্যাদি রূপে কাল বিভাজনের পক্ষাবলম্বন করেন। একই সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কাল নির্ধারণ, যেমন হিন্দু/বৌদ্ধ, মুসলিম এবং ব্রিটিশ আমল ইত্যাদি হিসেবে কাল বিভাজনের রীতির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ যেমন [[বন্দ্যোপাধ্যায়, রাখালদাস]|রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়]], [[মজুমদার, রমেশচন্দ্র|রমেশচন্দ্র মজুমদার]], [[শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ|হরপ্রসাদ শাস্ত্রী]] প্রমুখ ভারতীয় ইতিহাস বর্ণনায় সম্প্রদায়ভিত্তিক কাল বিভাজনের পক্ষে ছিলেন। তরফদার যুক্তি দেন যে, শাসকের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনই এক অবস্থা থেকে অপর অবস্থায় রূপান্তরের ক্রান্তিকালকে নির্দেশ করে না; বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সূচিত হওয়া থেকেই ক্রান্তিকালকে সুনির্দিষ্ট করা যায়।  [পারভীন হাসান]  
 
<!-- imported from file: তরফদার, মমতাজুর রহমান.html-->


[[en:Tarafdar, Momtazur Rahman]]
[[en:Tarafdar, Momtazur Rahman]]

১২:৩৯, ৯ জুলাই ২০২১ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

মমতাজুর রহমান তরফদার

তরফদার, মমতাজুর রহমান (১৯২৮-১৯৯৭)  একজন জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক। বগুড়া জেলার মেঘগাছা গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জন্মগ্রহণকারী তরফদার তাঁর নিজ জেলাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশুনা সম্পন্ন করেন। ১৯৪৭ সালে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে বগুড়া ছেড়ে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে বি.এ ও ১৯৫১ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম.এ পাস করেন। ১৯৬১ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তরফদার মুন্সিগঞ্জ জেলার হরগঙ্গা কলেজে ১৯৫২ সালে প্রভাসক হিসেবে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বিভাগে যোগদানের জন্য হরগঙ্গা কলেজের চাকরি ত্যাগ করেন। ১৯৯৭ সালের ৩১ জুলাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময়ই শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকেছেন। এই দীর্ঘ ও কৃতিত্বপূর্ণ চাকরি জীবনে তিনি ব্রিটেনের নুফিল্ড ফাউন্ডেশন (১৯৭২-১৯৭৪), আমেরিকার ডারহামস্থ ডিউক ইউনিভার্সিটি (১৯৯৬) এবং ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমী (১৯৯৭) ও বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (১৯৯৭) ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে সাহিত্য পদক প্রদান করে।

তরফদারের পি-এইচ.ডি অভিসন্দর্ভের জন্য রচিত হোসেনশাহী বেঙ্গল বাঙালি জাতি গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বাংলার ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে উপর প্রণীত সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তৎকালীন প্রশাসন, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। যে সকল চিন্তা-চেতনা লেখকের বাকি জীবন আবিষ্ট করে, তা এগুলির মধ্যেই ভ্রূণাবস্থায় নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের দায়িত্ব হচ্ছে অতীতের তথ্য সরবরাহ করা, যাতে বর্তমান বোধগম্য হয়। সমকালীন সমাজের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করে তোলে। তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক বাঙালি ব্যক্তিসত্ত্বার স্থান নির্ধারণে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি ও শেকড় অনুসন্ধানে ব্রত হন। গবেষণার জন্য তিনি হোসেনশাহী যুগকে বেছে নেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় এ যুগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যোগ্যতার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণা উপকরণ ব্যবহারে পারঙ্গম তরফদারের ছিল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে, বিশেষ করে লোকজ ও প্রচলিত নিয়মানুগ নয় এমন পর্যায়ে, গতিশীল সম্পর্ক অনুসন্ধানে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। তিনি বাঙালির বস্ত্তগত সংস্কৃতি অনুধাবনের জন্য সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব, স্থাপত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে গবেষণা করেন।

১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তাঁর Trade, Technology and Society in Medieval Bengal গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি মধ্যযুগে বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে। সাহিত্য, ধর্ম ও বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক তাঁর অন্যান্য গবেষণাবলী সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ, আর্থ-সামাজিক ইতিহাস ও ইতিহাস চর্চার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।

অধ্যাপক তরফদারের বাংলা রোমান্টিক কাব্যের হিন্দি-আউধি পটভূমি হচ্ছে চৌদ্দ থেকে ষোল শতকের হিন্দি কাব্য এবং সতেরো ও আঠারো শতকের বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান কবিদের দ্বারা অনুকরণকৃত গ্রন্থগুলির একটি তুলনামূলক আলোচনা। এ সকল হিন্দি কবির মানবীয় গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে তরফদার তাঁদেরকে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের পূর্বসূরী হিসেবে উচ্চাসন দান করেন। তিনি অনুবাদসহ হিন্দি কবিতা থেকে উদাহরণ দেন এবং বাংলা কবিতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। এগুলির উৎপত্তি অনুসন্ধানের জন্য তিনি গোটা ভারত, এমনকি ভারতের বাইরের সাহিত্যের প্রতিও নজর দেন এবং ফারসি, আরবি, গ্রিক ও ইতালীয় কাব্যের সম্ভাব্য উৎসের সঙ্গে হিন্দি কাব্যের তুলনা করেন।

মমতাজুর রহমান তাঁর ‘The Cultural Identity of Bengali Muslims as Reflected in Medieval Bengali Literature’ প্রবন্ধে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি অভিযানের পর মুসলিম অভিজাত শ্রেণি গঠন সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রথম তিন শতক ব্যাপী মুসলিম অভিজাত শ্রেণি ছিল বিদেশি। তারা নগরকেন্দ্রগুলিতে বসবাস করতেন এবং ব্যবহার করতেন কেবল আরবি ও ফারসি ভাষা। তাঁদের শিক্ষা গ্রামাঞ্চলের ধর্মান্তরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে পৌঁছত না, কেননা তারা বাংলা ব্যতীত অপর কোন ভাষা জানত না। ষোল শতকের শেষ দিকে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে সুফি সাহিত্যের চর্চা শুরু হলে তার মধ্য দিয়ে দেশিয় মুসলমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। এ সুফি সাহিত্যের চর্চা হতো প্রধানত চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে, যে অঞ্চল ছিল বেশ কয়েক শতক ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিলন-মিশ্রণের জন্য খ্যাত। সৈয়দ সুলতান, মুহাম্মদ খান, শেখ চাঁদ, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত ওয়াজির বাহরাম, শাহ বরিদ খান প্রমুখ কবি যদিও এদেশে এসেছিলেন অভিবাসি হয়ে, কিন্তু তাঁরা বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। তাঁদের কবিতায় বাংলার আবহে হজরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর জীবন, ইসলামি কিংবদন্তী এবং প্রেমোপাখ্যান স্থান পায়।

ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ অবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহিরাগত ও স্থানীয় মুসলমান এবং দেশিয় বৌদ্ধ ও হিন্দুর সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উপাদানসমূহের প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন সাহিত্য (ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার) এবং স্থাপত্য কর্মে। সুফি পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে বংশানুক্রমিক পীর এবং অন্যরা ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে সাধারণ জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অধ্যাপক তরফদার সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় গঠন প্রক্রিয়ায় মারাত্মক অবনতি ঘটে তখন, যখন এ সকল সুফি পরিবারকে হীন অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রথমত বহিরাগত আশরাফদের (অভিজাত) ক্রমান্বয়ে বাংলায় আগমন এবং দ্বিতীয়ত উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।

সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের মাধ্যমে বিশ শতকে জাতি গঠন প্রক্রিয়া পুনরায় বাধাগ্রস্থ হয়। এ জাতির ক্রমবিকাশের তথ্য সংগ্রহকারী একজন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক হিসেবে তরফদার খোদ বাংলাদেশেই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক সংকট দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বেশ কিছু বাংলা প্রবন্ধে তিনি এ সমস্যা অনুধাবনের ও এর সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করেন। এ সকল প্রবন্ধের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭১ সালে তিনি রচনা করেন ‘জাতীয় চেতনা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে বাঙালি জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির বিন্যাস এবং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্র নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।

ইতিহাসের কাল বিভাজনের ক্ষেত্রেও তরফদারের ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সূচিত সামাজিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে তিনি প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ ইত্যাদি রূপে কাল বিভাজনের পক্ষাবলম্বন করেন। একই সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে কাল নির্ধারণ, যেমন হিন্দু/বৌদ্ধ, মুসলিম এবং ব্রিটিশ আমল ইত্যাদি হিসেবে কাল বিভাজনের রীতির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ যেমন [[বন্দ্যোপাধ্যায়, রাখালদাস]|রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়]], রমেশচন্দ্র মজুমদার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ভারতীয় ইতিহাস বর্ণনায় সম্প্রদায়ভিত্তিক কাল বিভাজনের পক্ষে ছিলেন। তরফদার যুক্তি দেন যে, শাসকের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তনই এক অবস্থা থেকে অপর অবস্থায় রূপান্তরের ক্রান্তিকালকে নির্দেশ করে না; বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সূচিত হওয়া থেকেই ক্রান্তিকালকে সুনির্দিষ্ট করা যায়।  [পারভীন হাসান]