আহমেদ, সুফিয়া: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

("'''আহমেদ, সুফিয়া''' (১৯৩২-২০২০) ‘সুফিয়া ইব্রাহিম’ ও ‘ভাষাক..." দিয়ে পাতা তৈরি)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত ৪টি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
'''আহমেদ, সুফিয়া''' (১৯৩২-২০২০)  ‘সুফিয়া ইব্রাহিম’ ও ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ ইব্রাহিম এবং মাতার নাম লুৎফুন্নেসা ইব্রাহিম। মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রী ছিলেন। মাতা লুৎফুন্নেসা ছিলেন একজন গৃহিনী। সুফিয়া আহমেদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হন। পিতার বদলি চাকুরির সুবাদে বাংলার বহুত্ববাদী সমাজ দর্শনের প্রভাব তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল।
'''আহমেদ, সুফিয়া''' (১৯৩২-২০২০)  ‘সুফিয়া ইব্রাহিম’ ও ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম [[ইবরাহিম, জাস্টিস মুহম্মদ|জাস্টিস মুহম্মদ ইবরাহিম]] এবং মাতার নাম লুৎফুন্নেসা ইবরাহিম। মুহাম্মদ ইবরাহিম ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রী ছিলেন। মাতা লুৎফুন্নেসা ছিলেন একজন গৃহিনী। সুফিয়া আহমেদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হন। পিতার বদলি চাকুরির সুবাদে বাংলার বহুত্ববাদী সমাজ দর্শনের প্রভাব তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল।


[[Image:AhmedSufia.jpg|right|thumbnail|200px|সুফিয়া আহমেদ]]
[[Image:AhmedSufia.jpg|right|thumbnail|200px|সুফিয়া আহমেদ]]
সুফিয়া আহমেদ-এর পড়াশুনায় হাতেখড়ি পরিবারে। তিনি প্রথমে ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল-এ এবং পরে ভারতের দার্জিলিং-এর ‘Dow Hill School’-এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পিতার কর্মস্থল বরিশালে চলে আসেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক (অনার্স) এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে সুফিয়া আহমেদ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে SOAS থেকে ‘Some Aspects of the History of the Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সঙ্গে অনাবাসিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক এটর্নি জেনারেল এবং ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।  
সুফিয়া আহমেদ-এর পড়াশুনায় হাতেখড়ি পরিবারে। তিনি প্রথমে ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল-এ এবং পরে ভারতের দার্জিলিং-এর ‘Dow Hill School’-এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পিতার কর্মস্থল বরিশালে চলে আসেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি [[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়|ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]]-এর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক (অনার্স) এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে সুফিয়া আহমেদ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে SOAS থেকে ‘Some Aspects of the History of the Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সঙ্গে অনাবাসিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি ব্যারিস্টার [[আহমেদ, সৈয়দ ইশতিয়াক| সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ]]-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক এটর্নি জেনারেল এবং ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।


সুফিয়া আহমেদ-এর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে তিনি সিনিয়র লেকচারার এবং ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক (রিডার) পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি অধ্যাপক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষাবিদ। তিনি ভারত ও তুরস্কের ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান করতেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। সুক্ষ্ম অন্তদৃর্ষ্টি, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, তথ্যবহুল পাঠদানের বস্তুনিষ্ঠতা ও সাবলীলতার জন্য তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর চিন্তাধারা বাঙালি মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী শিক্ষার প্রেক্ষাপটে ছিল বাস্তবমুখী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।  
সুফিয়া আহমেদ-এর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে তিনি সিনিয়র লেকচারার এবং ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক (রিডার) পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি অধ্যাপক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষাবিদ। তিনি ভারত ও তুরস্কের ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান করতেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। সুক্ষ্ম অন্তদৃর্ষ্টি, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, তথ্যবহুল পাঠদানের বস্তুনিষ্ঠতা ও সাবলীলতার জন্য তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর চিন্তাধারা বাঙালি মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী শিক্ষার প্রেক্ষাপটে ছিল বাস্তবমুখী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।


প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বিদগ্ধ প-িত ও ইতিহাস গবেষক সুফিয়া আহমেদ ভারত-বাংলার মুসলিম সমাজকে কেন্দ্রে স্থাপন করে আজীবন গবেষণা করে গেছেন। তিনি বাংলার মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতার চিত্র এঁকেছেন এবং ছক কেটে তাদের উন্নয়নের পথরেখা নিদের্শ করেছেন একাডেমিক পন্থায়। তাঁর গবেষণার একটি বিশেষত্ব ছিল তুরস্কের সেক্যুলারিজম, যার আলোকে বাঙালি নারী মুক্তির স্বপ্ন তিনি দেখতেন। কর্মজীবনে তাঁর চারটি গবেষণামূলক ও প্রায় ২৫টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশে গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘The Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। ‘নারীবাদ’ তাঁর সময়ে বিশেষ ডিসকোর্সরূপে বিকশিত হয়নি বটে, তবে তাঁর বক্তব্য ও লেখায় নারীবাদী ধ্যান-ধারণা বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বিদগ্ধ পণ্ডিত ও ইতিহাস গবেষক সুফিয়া আহমেদ ভারত-বাংলার মুসলিম সমাজকে কেন্দ্রে স্থাপন করে আজীবন গবেষণা করে গেছেন। তিনি বাংলার মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতার চিত্র এঁকেছেন এবং ছক কেটে তাদের উন্নয়নের পথরেখা নিদের্শ করেছেন একাডেমিক পন্থায়। তাঁর গবেষণার একটি বিশেষত্ব ছিল তুরস্কের সেক্যুলারিজম, যার আলোকে বাঙালি নারী মুক্তির স্বপ্ন তিনি দেখতেন। কর্মজীবনে তাঁর চারটি গবেষণামূলক ও প্রায় ২৫টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশে গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘The Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। ‘নারীবাদ’ তাঁর সময়ে বিশেষ ডিসকোর্সরূপে বিকশিত হয়নি বটে, তবে তাঁর বক্তব্য ও লেখায় নারীবাদী ধ্যান-ধারণা বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।


সুফিয়া আহমেদ অধ্যাপনা ব্যতিত সৃজনশীল, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলন চলাকালীন তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সেদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনে আহত হন। একই সময়ে সুফিয়া আহমেদ ছাত্রীদেরকে সক্রিয় করাসহ অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ জন্যই তিনি ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ বাংলা ভাষায় ইতিহাস গবেষণায় একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এ.বি.এম হবিবুল্লাহ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যখন নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জীবন সদস্য এবং দুই বার এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পরিষদের সুবর্ণজয়ন্তীতে (২০১৬) তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন সংস্থার যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, বাংলাদেশ পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (BPATC) সেন্টার-এর বোর্ড অব গভর্নরস, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ‘ফেলো’ নির্বাচন করে।
সুফিয়া আহমেদ অধ্যাপনা ব্যতিত সৃজনশীল, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলন চলাকালীন তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং [[ভাষা আন্দোলন|ভাষা আন্দোলন]]-এর একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সেদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনে আহত হন। একই সময়ে সুফিয়া আহমেদ ছাত্রীদেরকে সক্রিয় করাসহ অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ জন্যই তিনি ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ বাংলা ভাষায় ইতিহাস গবেষণায় একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এ.বি.এম হবিবুল্লাহ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যখন নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জীবন সদস্য এবং দুই বার এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পরিষদের সুবর্ণজয়ন্তীতে (২০১৬) তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন সংস্থার যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, বাংলাদেশ পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (BPATC) সেন্টার-এর বোর্ড অব গভর্নরস, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে [[বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি|বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি]] তাঁকে ‘ফেলো’ নির্বাচন করে।  


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পাশাপাশি সুফিয়া আহমেদ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখেন। ১৯৫২ সালে তিনি তুরস্কে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের, ১৯৬৯ ও ১৯৭৯ সালে দু’বার জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে এবং ১৯৮৩ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭২-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ‘গালর্স গাইড এ্যাসেসিয়েশন’-এর আন্তর্জাতিক কমিশনার। সুফিয়া আহমেদ ১৯৮৪-৮৫ সালে তুরস্কের ‘বসফোরাস বিশ্ববিদ্যালয়ে’ এবং ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Wisconsin স্টেটের ‘Alverno College’-এ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।   
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পাশাপাশি সুফিয়া আহমেদ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখেন। ১৯৫২ সালে তিনি তুরস্কে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের, ১৯৬৯ ও ১৯৭৯ সালে দু’বার জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে এবং ১৯৮৩ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭২-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন 'বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন’-এর আন্তর্জাতিক কমিশনার। সুফিয়া আহমেদ ১৯৮৪-৮৫ সালে তুরস্কের ‘বসফোরাস বিশ্ববিদ্যালয়ে’ এবং ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Wisconsin স্টেটের ‘Alverno College’-এ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।   


ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০১০ সালে ধানম-ির ১২ নং সড়কটির নামকরণ করে ‘ভাষা সৈনিক ড. সুফিয়া আহমেদ’ সড়ক। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সম্মানে কলা ভবনের ৩০৫৭ নম্বর কক্ষটির নামকরণ করে ‘ভাষা সংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ শ্রেণি কক্ষ’।  মর্যাদাপূর্ণ নেতৃত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাঁর জীবনী American Biographical Institute Inc কর্তৃক ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘International Dictionary of Distinguished Leadership’ এর নবম সংকরণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  
ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০১০ সালে ধানম-ির ১২ নং সড়কটির নামকরণ করে ‘ভাষা সৈনিক ড. সুফিয়া আহমেদ’ সড়ক। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সম্মানে কলা ভবনের ৩০৫৭ নম্বর কক্ষটির নামকরণ করে ‘ভাষা সংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ শ্রেণি কক্ষ’।  মর্যাদাপূর্ণ নেতৃত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাঁর জীবনী American Biographical Institute Inc কর্তৃক ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘International Dictionary of Distinguished Leadership’-এর নবম সংকরণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  


সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন উদারপন্থী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে নয় বরং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে সকল নাগরিকের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। মননে ও চিন্তনে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী। সামাজিক ধ্যান-ধারণায় তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী ও উদারনৈতিক। সুফিয়া আহমেদ ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল ৮৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আবদুল বাছির]
সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন উদারপন্থী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে নয় বরং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে সকল নাগরিকের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। মননে ও চিন্তনে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী। সামাজিক ধ্যান-ধারণায় তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী ও উদারনৈতিক।


''তথ্যসূত্র''  Dhaka University Record Room, Personal File of Dr. (Mos) Sufia Ahmed, File No: 38, Islamic History, 1992-1993 (General-c), p.21; ওয়াকিল আহমদ ও নাজিমুদ্দিন আহমদ (সম্পা.), ‘জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ এর জীবনবৃত্তান্ত ''ইতিহাস'', বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পত্রিকা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সংখ্যা, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ১৫৫; অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সংরক্ষিত ব্যক্তিগত ফাইল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, (১৯৬১-২০১৬), পৃ. ৫২।
সুফিয়া আহমেদ ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল ৮৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আবদুল বাছির]
 
'''তথ্যসূত্র'''  Dhaka University Record Room, Personal File of Dr. (Mos) Sufia Ahmed, ''File No: 38, Islamic History, 1992-1993'' (General-c), p.21; ওয়াকিল আহমদ ও নাজিমুদ্দিন আহমদ (সম্পা.), ‘জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ এর জীবনবৃত্তান্ত' ''ইতিহাস'', বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পত্রিকা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সংখ্যা, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ১৫৫; অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সংরক্ষিত ব্যক্তিগত ফাইল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, (১৯৬১-২০১৬), পৃ. ৫২।
 
[[en: Ahmed, Sufia]]

১৬:৫১, ১৪ জুলাই ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

আহমেদ, সুফিয়া (১৯৩২-২০২০) ‘সুফিয়া ইব্রাহিম’ ও ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩২ সালের ২০ নভেম্বর ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জাস্টিস মুহম্মদ ইবরাহিম এবং মাতার নাম লুৎফুন্নেসা ইবরাহিম। মুহাম্মদ ইবরাহিম ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রী ছিলেন। মাতা লুৎফুন্নেসা ছিলেন একজন গৃহিনী। সুফিয়া আহমেদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবেশে লালিত-পালিত হন। পিতার বদলি চাকুরির সুবাদে বাংলার বহুত্ববাদী সমাজ দর্শনের প্রভাব তাঁর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল।

সুফিয়া আহমেদ

সুফিয়া আহমেদ-এর পড়াশুনায় হাতেখড়ি পরিবারে। তিনি প্রথমে ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল-এ এবং পরে ভারতের দার্জিলিং-এর ‘Dow Hill School’-এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পিতার কর্মস্থল বরিশালে চলে আসেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক (অনার্স) এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে সুফিয়া আহমেদ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে SOAS থেকে ‘Some Aspects of the History of the Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সঙ্গে অনাবাসিক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের সদস্য পদে নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক এটর্নি জেনারেল এবং ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

সুফিয়া আহমেদ-এর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে লেকচারার পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৭ সালে তিনি সিনিয়র লেকচারার এবং ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক (রিডার) পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি অধ্যাপক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষাবিদ। তিনি ভারত ও তুরস্কের ইতিহাস বিষয়ে পাঠদান করতেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। সুক্ষ্ম অন্তদৃর্ষ্টি, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, তথ্যবহুল পাঠদানের বস্তুনিষ্ঠতা ও সাবলীলতার জন্য তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর চিন্তাধারা বাঙালি মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী শিক্ষার প্রেক্ষাপটে ছিল বাস্তবমুখী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।

প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বিদগ্ধ পণ্ডিত ও ইতিহাস গবেষক সুফিয়া আহমেদ ভারত-বাংলার মুসলিম সমাজকে কেন্দ্রে স্থাপন করে আজীবন গবেষণা করে গেছেন। তিনি বাংলার মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতার চিত্র এঁকেছেন এবং ছক কেটে তাদের উন্নয়নের পথরেখা নিদের্শ করেছেন একাডেমিক পন্থায়। তাঁর গবেষণার একটি বিশেষত্ব ছিল তুরস্কের সেক্যুলারিজম, যার আলোকে বাঙালি নারী মুক্তির স্বপ্ন তিনি দেখতেন। কর্মজীবনে তাঁর চারটি গবেষণামূলক ও প্রায় ২৫টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশে গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘The Muslim Community in Bengal (১৮৮৪-১৯১২)’ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। ‘নারীবাদ’ তাঁর সময়ে বিশেষ ডিসকোর্সরূপে বিকশিত হয়নি বটে, তবে তাঁর বক্তব্য ও লেখায় নারীবাদী ধ্যান-ধারণা বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

সুফিয়া আহমেদ অধ্যাপনা ব্যতিত সৃজনশীল, সমাজসেবা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলন চলাকালীন তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী এবং ভাষা আন্দোলন-এর একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সেদিন তিনি পুলিশি নির্যাতনে আহত হন। একই সময়ে সুফিয়া আহমেদ ছাত্রীদেরকে সক্রিয় করাসহ অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ জন্যই তিনি ‘ভাষাকন্যা’ হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ বাংলা ভাষায় ইতিহাস গবেষণায় একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এ.বি.এম হবিবুল্লাহ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৬ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যখন নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সুফিয়া আহমেদ ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জীবন সদস্য এবং দুই বার এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পরিষদের সুবর্ণজয়ন্তীতে (২০১৬) তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন সংস্থার যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, বাংলাদেশ পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (BPATC) সেন্টার-এর বোর্ড অব গভর্নরস, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ‘ফেলো’ নির্বাচন করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পাশাপাশি সুফিয়া আহমেদ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখেন। ১৯৫২ সালে তিনি তুরস্কে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের, ১৯৬৯ ও ১৯৭৯ সালে দু’বার জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে এবং ১৯৮৩ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭২-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন 'বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন’-এর আন্তর্জাতিক কমিশনার। সুফিয়া আহমেদ ১৯৮৪-৮৫ সালে তুরস্কের ‘বসফোরাস বিশ্ববিদ্যালয়ে’ এবং ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Wisconsin স্টেটের ‘Alverno College’-এ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত করে। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০১০ সালে ধানম-ির ১২ নং সড়কটির নামকরণ করে ‘ভাষা সৈনিক ড. সুফিয়া আহমেদ’ সড়ক। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সম্মানে কলা ভবনের ৩০৫৭ নম্বর কক্ষটির নামকরণ করে ‘ভাষা সংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ শ্রেণি কক্ষ’। মর্যাদাপূর্ণ নেতৃত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তাঁর জীবনী American Biographical Institute Inc কর্তৃক ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘International Dictionary of Distinguished Leadership’-এর নবম সংকরণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সুফিয়া আহমেদ ছিলেন একজন উদারপন্থী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে নয় বরং ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে সকল নাগরিকের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। মননে ও চিন্তনে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী। সামাজিক ধ্যান-ধারণায় তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী ও উদারনৈতিক।

সুফিয়া আহমেদ ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল ৮৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আবদুল বাছির]

তথ্যসূত্র Dhaka University Record Room, Personal File of Dr. (Mos) Sufia Ahmed, File No: 38, Islamic History, 1992-1993 (General-c), p.21; ওয়াকিল আহমদ ও নাজিমুদ্দিন আহমদ (সম্পা.), ‘জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ এর জীবনবৃত্তান্ত' ইতিহাস, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পত্রিকা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সংখ্যা, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ১৫৫; অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সংরক্ষিত ব্যক্তিগত ফাইল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, (১৯৬১-২০১৬), পৃ. ৫২।