ইবরাহিম, জাস্টিস মুহম্মদ

ইবরাহিম, জাস্টিস মুহম্মদ (১৮৯৪-১৯৬৬)  শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা। তিনি ১৮৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার শৈলডুবি গ্রামে মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী গিয়াসউদ্দীন আহমদ। মুহম্মদ ইবরাহিম বরিশাল জেলা স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯১৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ঢাকা আইন কলেজে আইন বিষয় অধ্যয়ন করেন।

বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী জাস্টিস মুহম্মদ ইবরাহিম সমকালীন ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হন এবং  অসহযোগ ও  খিলাফত আন্দোলন-এ যোগ দেন। ১৯২১ সালে তিনি আইন পাস করেন।

জাস্টিস মুহম্মদ ইবরাহিম

১৯২২-২৩ সালে জাস্টিস ইবরাহিম ফরিদপুরে আইন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হন এবং ১৯২৪ সালে ঢাকা বারে যোগ দেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ১৯২৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ঢাকা জেলা কোর্টে পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে মনোনীত হন। অতঃপর তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কাজ করেন এবং অবশেষে ১৯৫০ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বেঞ্চে যোগ দেন। সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে থেকে তিনি তার সততা ও স্পষ্টবাদিতার কারণে আইনজীবী ও বিচারক হিসেবে জনপ্রিয়তা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন।

হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে ছয় বছর সুনামের সাথে কাজ করে তিনি ১৯৫৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ইলেকশন ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং পরে ১৯৫৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন ঘোষণা করেন। তিনি শীঘ্রই দেশে গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এই ঘোষণায় আস্থাবান হয়ে জাস্টিস ইবরাহিম তাঁর মন্ত্রিসভায় আইন মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। আইয়ুব খানের উদ্দেশ্য ছিল যে, তিনি শীঘ্রই সামরিক আইন তুলে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। আইনমন্ত্রী হিসেবে নারীর স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তিনি ১৯৬১ সালে মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বস্ত্তত, নারীর অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

কিন্তু গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আইয়ুব খানের অঙ্গীকার সম্পর্কে জাস্টিস ইবরাহিমের আশা কখনও পূরণ হয় নি। সংবিধান কমিশন কর্তৃক রিপোর্ট পেশ করার বহু পূর্বেই তদানীন্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর কাদেরের সহায়তায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁর নিজের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী একটি খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করেন। তিনি এ বিষয়ে, এমনকি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শও করেন নি। যখন সংবিধান কমিশন রিপোর্ট পেশ করে, তখন আইয়ুবের চিন্তাভাবনা সম্বলিত খসড়া সংবিধান নিয়ে মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকটি সভায় আলোচিত হয়। জাস্টিস ইবরাহিম খসড়া সংবিধানের অধিকাংশ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে, একটি যুক্ত রাষ্ট্রীয় সরকার গঠন করতে হবে যাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রার মতো কয়েকটি বিষয়ের এখতিয়ার থাকবে কেন্দ্রের হাতে এবং অবশিষ্ট সকল ক্ষমতা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে প্রদেশসমূহের কাছে ন্যস্ত থাকবে ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে। সংসদীয় সরকারের প্রতি তার অধিকতর আগ্রহ থাকলেও তিনি প্রস্তাব করেন যে, যদি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীতই হয় তাহলে প্রেসিডেন্ট এবং প্রাদেশিক গভর্নরগণকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে এবং এক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় শর্ত থাকবে যে, প্রাদেশিক গভর্নর যে প্রদেশের জন্য নির্বাচিত হবেন তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রদেশের লোক হতে হবে। তিনি আরও পরামর্শ দেন যে, ভাইস-প্রেসিডেন্টের পদ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ পাকিস্তানের উভয় অংশে পালাক্রমে বদল হতে পারে। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বিস্তর অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছিল, তা দূর করার জন্য সাংবিধানিক ধারা প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন। তাঁর সবচেয়ে বৈপ্লবিক মত ছিল যে, প্রাদেশিক বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রদেশসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রাদেশিক সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন। তিনি মন্ত্রিসভায় দেশের উভয় অংশের সমপ্রতিনিধিত্ব এবং আইনসভার অধিবেশনসমূহ স্থায়িভাবে ঢাকায় অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন।

জাস্টিস ইবরাহিমের সাংবিধানিক প্রস্তাবসমূহে এটি স্পষ্ট যে, সম্মতি ও স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে গঠিত ফেডারেল সরকারের ব্যাপারে পূর্বপাকিস্তানে আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। তাঁর এ সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তিনি প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভায় তার সহকর্মীদের দ্বারা তীব্রভাষায় সমালোচিত হন। ১৯৬২ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

পদত্যাগের পরও তিনি সংবিধান, সরকার পদ্ধতি ও পাকিস্তানের উভয় অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার উপর তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে আইয়ুব খানের বিরোধিতা করার জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনে (COP) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জাস্টিস ইবরাহিম ছিলেন একজন অত্যন্ত উৎসাহী ও দৃঢ়চেতা সমাজকর্মী এবং বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আবহমান ঐতিহ্য বিকাশের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি  বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এর (১৯২৬-১৯৩৮) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৫ সালের ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এর নবম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশনের (বর্তমানে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে পরিচিত) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বুলবুল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সভাপতি, অবৈতনিক প্রাদেশিক স্কাউট কমিশনার, পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান এবং ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটির (বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি) সভাপতি ছিলেন।

একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক সংবিধান ঘোষণা এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আইয়ুব খানের অসংবেদনশীল, অন্যায় ও বৈষ্যমমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ও সাহসী বক্তব্যসমূহ এ অঞ্চলের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ও সংগঠকদের উদ্বুদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল। জাস্টিস ইবরাহিম ১৯৬৬ সালের ১৩ অক্টোবর মারা যান।  [সুফিয়া আহমেদ]