খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
অ (Text replacement - "\[মুয়ায্যম হুসায়ন খান\]" to "[মুয়ায্যম হুসায়ন খান]") |
||
(একজন ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:বাংলাপিডিয়া]] | [[Category:বাংলাপিডিয়া]] | ||
[[Image:KhanAgaMohammadYahya.jpg|thumb|right|আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান]] | |||
'''খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া''' (১৯১৭-১৯৮০) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। পাঠান বংশোদ্ভূত আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের চাকওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ জুলাই কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বালুচ রেজিমেন্টের চতুর্থ পদাতিক ডিভিশনের অফিসার হিসেবে তিনি ইরাক, ইতালি ও উত্তর আফ্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কোয়েটায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টাফ কলেজে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। | '''খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া''' (১৯১৭-১৯৮০) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। পাঠান বংশোদ্ভূত আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের চাকওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ জুলাই কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বালুচ রেজিমেন্টের চতুর্থ পদাতিক ডিভিশনের অফিসার হিসেবে তিনি ইরাক, ইতালি ও উত্তর আফ্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কোয়েটায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টাফ কলেজে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। | ||
ইয়াহিয়া খান ১৯৫১ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৫১-৫২ সালে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি সীমারেখায় নিয়োজিত ১০৫ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ডেপুটি চীফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক গঠিত আর্মি প্ল্যানিং বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আর্মি চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সালে একটি পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চীফ পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে তাকে আর্মি কমান্ডার-ইন-চীফ নিয়োগ করা হয়। ইয়াহিয়া খান তাঁর দু’জন সিনিয়র সহকর্মীকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক সিতারা-এ পাকিস্তান, হিলাল-এ জুরাত এবং হিলাল-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। | ইয়াহিয়া খান ১৯৫১ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৫১-৫২ সালে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি সীমারেখায় নিয়োজিত ১০৫ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ডেপুটি চীফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক গঠিত আর্মি প্ল্যানিং বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আর্মি চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সালে একটি পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চীফ পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে তাকে আর্মি কমান্ডার-ইন-চীফ নিয়োগ করা হয়। ইয়াহিয়া খান তাঁর দু’জন সিনিয়র সহকর্মীকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক সিতারা-এ পাকিস্তান, হিলাল-এ জুরাত এবং হিলাল-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। | ||
প্রেসিডেন্ট আইউব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে উদ্ভূত [[ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান|উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান]]-এর মোকাবিলায় আইউব খান পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রকট রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হন এবং ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। | প্রেসিডেন্ট আইউব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে উদ্ভূত [[ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান|উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান]]-এর মোকাবিলায় আইউব খান পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রকট রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হন এবং ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। | ||
১৩ নং লাইন: | ১১ নং লাইন: | ||
ইয়াহিয়া খান অবশ্য এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের সকল আনুষ্ঠানিকতা ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে [[বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ|আওয়ামী লীগ]] (শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে) জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন) অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি ইতোমধ্যে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন (১৬-২৪ মার্চ)। কিন্তু ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে ব্যর্থ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে সামরিক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। এরই পরিণতিতে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং নয় মাস যুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। | ইয়াহিয়া খান অবশ্য এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের সকল আনুষ্ঠানিকতা ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে [[বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ|আওয়ামী লীগ]] (শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে) জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন) অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি ইতোমধ্যে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন (১৬-২৪ মার্চ)। কিন্তু ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে ব্যর্থ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে সামরিক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। এরই পরিণতিতে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং নয় মাস যুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। | ||
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের দায় অনেকটাই ইয়াহিয়া খানের উপর চাপানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর স্বল্পকাল পরেই নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পূর্বসুরীকে গৃহবন্দী করেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন। [ | ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের দায় অনেকটাই ইয়াহিয়া খানের উপর চাপানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর স্বল্পকাল পরেই নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পূর্বসুরীকে গৃহবন্দী করেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান] | ||
[[en:Khan, Aga Mohammad Yahya]] | [[en:Khan, Aga Mohammad Yahya]] |
১৬:৩৮, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
খান, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (১৯১৭-১৯৮০) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। পাঠান বংশোদ্ভূত আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ১৯১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের চাকওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন এবং দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ জুলাই কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বালুচ রেজিমেন্টের চতুর্থ পদাতিক ডিভিশনের অফিসার হিসেবে তিনি ইরাক, ইতালি ও উত্তর আফ্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কোয়েটায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টাফ কলেজে ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন।
ইয়াহিয়া খান ১৯৫১ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৫১-৫২ সালে কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি সীমারেখায় নিয়োজিত ১০৫ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ডেপুটি চীফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক গঠিত আর্মি প্ল্যানিং বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আর্মি চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৬২-১৯৬৫ সালে একটি পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চীফ পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে তাকে আর্মি কমান্ডার-ইন-চীফ নিয়োগ করা হয়। ইয়াহিয়া খান তাঁর দু’জন সিনিয়র সহকর্মীকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক সিতারা-এ পাকিস্তান, হিলাল-এ জুরাত এবং হিলাল-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন।
প্রেসিডেন্ট আইউব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে উদ্ভূত উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান-এর মোকাবিলায় আইউব খান পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রকট রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হন এবং ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর ইয়াহিয়া খান দুটি প্রকট সমস্যার মুখোমুখি হন। এর একটি হলো, দুই দশকব্যাপী চলমান আন্তঃপ্রাদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো সাংবিধানিক সমস্যা, আর অন্যটি হলো দীর্ঘ এগারো বছর ধরে এক ব্যক্তি শাসিত একটি দেশকে গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তর। ১৯৬৯ সালের ২৮ জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সাংবিধানিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যে তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম বড় ধরনের পদক্ষেপ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের কোটা দ্বিগুণ করা। তিনি এক ইউনিট প্রথা বিলোপ করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে ১৯৫৫ সাল পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেন এবং পূর্ণবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি প্যারিটি নীতি বাতিল করে আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকতর সুযোগদানের পদক্ষেপ নেন এবং আশাপোষণ করেন যে, আইন পরিষদে বর্ধিত অংশীদারিত্ব তাদের আঞ্চলিক বঞ্চনার ক্ষোভ কিছুটা হলেও লাঘব করবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা ও পদক্ষেপ আসলেই অনেক বিলম্বে আসে এবং এতে করে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যকার রাজনৈতিক বিভেদ বরং আরও ঘনীভূত হয়।
ইয়াহিয়া খান অবশ্য এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের সকল আনুষ্ঠানিকতা ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে) জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন) অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি ইতোমধ্যে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন (১৬-২৪ মার্চ)। কিন্তু ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে ব্যর্থ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে সামরিক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। এরই পরিণতিতে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং নয় মাস যুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের দায় অনেকটাই ইয়াহিয়া খানের উপর চাপানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর স্বল্পকাল পরেই নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পূর্বসুরীকে গৃহবন্দী করেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]