আহাদ, অলি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
অ (Text replacement - "সোহ্রাওয়ার্দী" to "সোহ্রাওয়ার্দী") |
||
৩ নং লাইন: | ৩ নং লাইন: | ||
'''আহাদ, অলি''' (১৯২৭/২৮-২০১২) ভাষা সৈনিক, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। ১৯২৭ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মসাল ১৯২৭ বা ১৯২৮। ১৯৪৪ সালে দাউদকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৭ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে বি.কম পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.কম ক্লাশে ভর্তির আবেদন পত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করেন। | '''আহাদ, অলি''' (১৯২৭/২৮-২০১২) ভাষা সৈনিক, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। ১৯২৭ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মসাল ১৯২৭ বা ১৯২৮। ১৯৪৪ সালে দাউদকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৭ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে বি.কম পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.কম ক্লাশে ভর্তির আবেদন পত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করেন। | ||
অলি আহাদ কৈশোর বয়স থেকেই রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রাবস্থায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান দাবির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজ শাখা মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের [[হাশিম, আবুল|আবুল হাশিম]], [[হক, শামসুল|শামসুল হক]], [[আহমদ, কামরুদ্দীন|কামরুদ্দীন আহমদ]], [[তোয়াহা, মোহাম্মদ|মোহাম্মদ তোয়াহা]] ও [[আহমদ, তাজউদ্দিন|তাজউদ্দিন আহমদ]] প্রমুখ প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচিত হন এবং কালক্রমে মুসলিম লীগের এ প্রগতিশীল অংশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পরেন। ১৯৪৬ সালের ২২ এপ্রিল [[ | অলি আহাদ কৈশোর বয়স থেকেই রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রাবস্থায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান দাবির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজ শাখা মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের [[হাশিম, আবুল|আবুল হাশিম]], [[হক, শামসুল|শামসুল হক]], [[আহমদ, কামরুদ্দীন|কামরুদ্দীন আহমদ]], [[তোয়াহা, মোহাম্মদ|মোহাম্মদ তোয়াহা]] ও [[আহমদ, তাজউদ্দিন|তাজউদ্দিন আহমদ]] প্রমুখ প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচিত হন এবং কালক্রমে মুসলিম লীগের এ প্রগতিশীল অংশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পরেন। ১৯৪৬ সালের ২২ এপ্রিল [[সোহ্রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী]] পাকিস্তান দাবির পক্ষে প্রচারণার জন্য প্রতিটি জেলা, মহকুমা ও থানাতে কর্মী সং&ঘ গঠনের নির্দেশ দিলে অলি আহাদ ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। এসময় রাজনৈতিক প্রচারকার্যের জন্য আইএসসি পরীক্ষা (১৯৪৬) থেকে বিরত থাকেন। ১৯৪৭ সালের ৬-৭ জুলাই গণভোটের সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আসামের শ্রীহট্ট জেলায় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে প্রচার চালান। | ||
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠনে অলি আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে গণ আজাদী লীগ নামক আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন যদিও এটি কখনো গণ-সংগঠনে পরিণত হয়নি। ভারত বিভক্তির সময় হোসেন শহীদ | ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠনে অলি আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে গণ আজাদী লীগ নামক আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন যদিও এটি কখনো গণ-সংগঠনে পরিণত হয়নি। ভারত বিভক্তির সময় হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে শহীদ-হাশিম গ্রুপের ছাত্রকর্মী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। এসময় সরকার বিরোধী একমাত্র সক্রিয় ছাত্র সংগঠন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃতাধীন ছাত্র ফেডারেশন। শহীদ-হাশিম গ্রুপের ছাত্রকর্মী অলি আহাদসহ অনেকে এই ছাত্র সংগঠনের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। তাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি অলি আহাদের অগ্রণী ভূমিকায় নঈমুদ্দিন আহমদকে আহবায়ক করে গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। তিনি নিজে ঢাকা জেলার মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ৮ জানুয়ারি অলি আহাদসহ অনেকে ভাষার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণ-পরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্তৃক বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হলে তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ (Committee of Action for State Language) নামে একটি কমিটি গঠন করেন। গণ-পরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাখার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহবান করেন। এ কর্মসূচি পালনের সময় সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় অলি আহাদসহ [[বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান|শেখ মুজিবুর রহমান]], খালেক নেওয়াজ খান ও শামসুল হক আটক হন। ইতোমধ্যে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্মবেতনভুক্ত কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে অলি আহাদ তাদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি ঘোষণা করেন। তিনি ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট আহবান করেন। ফলে কর্মচারীদের আন্দোলন একটি ছাত্র আন্দোলনের রূপ নেয় এবং তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। আন্দোলন স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ২৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ প্রক্রিয়ায় অলি আহাদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রদের বহিষ্কার এবং অনেককে জরিমানা করে। | ||
অলি আহাদ ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্মপরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ‘ঢাকা শান্তি রিলিফ কমিটি’ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০) গঠন করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। সরকারের বন্ধ্যা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তিনি ১৯৫০ সালের ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে অলি আহাদকে আহবায়ক করে গণশিক্ষা পরিষদ গঠন করা হয়। | অলি আহাদ ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্মপরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ‘ঢাকা শান্তি রিলিফ কমিটি’ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০) গঠন করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। সরকারের বন্ধ্যা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তিনি ১৯৫০ সালের ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে অলি আহাদকে আহবায়ক করে গণশিক্ষা পরিষদ গঠন করা হয়। |
১৫:৫৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
আহাদ, অলি (১৯২৭/২৮-২০১২) ভাষা সৈনিক, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। ১৯২৭ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইসলামপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মসাল ১৯২৭ বা ১৯২৮। ১৯৪৪ সালে দাউদকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৭ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে বি.কম পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.কম ক্লাশে ভর্তির আবেদন পত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করেন।
অলি আহাদ কৈশোর বয়স থেকেই রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রাবস্থায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম বাসভূমি পাকিস্তান দাবির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজ শাখা মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের আবুল হাশিম, শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচিত হন এবং কালক্রমে মুসলিম লীগের এ প্রগতিশীল অংশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পরেন। ১৯৪৬ সালের ২২ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী পাকিস্তান দাবির পক্ষে প্রচারণার জন্য প্রতিটি জেলা, মহকুমা ও থানাতে কর্মী সং&ঘ গঠনের নির্দেশ দিলে অলি আহাদ ত্রিপুরা জেলা নির্বাচনী বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। এসময় রাজনৈতিক প্রচারকার্যের জন্য আইএসসি পরীক্ষা (১৯৪৬) থেকে বিরত থাকেন। ১৯৪৭ সালের ৬-৭ জুলাই গণভোটের সময় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আসামের শ্রীহট্ট জেলায় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে প্রচার চালান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠনে অলি আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে গণ আজাদী লীগ নামক আরেকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন যদিও এটি কখনো গণ-সংগঠনে পরিণত হয়নি। ভারত বিভক্তির সময় হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে শহীদ-হাশিম গ্রুপের ছাত্রকর্মী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। এসময় সরকার বিরোধী একমাত্র সক্রিয় ছাত্র সংগঠন ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃতাধীন ছাত্র ফেডারেশন। শহীদ-হাশিম গ্রুপের ছাত্রকর্মী অলি আহাদসহ অনেকে এই ছাত্র সংগঠনের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। তাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি অলি আহাদের অগ্রণী ভূমিকায় নঈমুদ্দিন আহমদকে আহবায়ক করে গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। তিনি নিজে ঢাকা জেলার মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ৮ জানুয়ারি অলি আহাদসহ অনেকে ভাষার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণ-পরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্তৃক বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হলে তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ (Committee of Action for State Language) নামে একটি কমিটি গঠন করেন। গণ-পরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাখার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহবান করেন। এ কর্মসূচি পালনের সময় সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় অলি আহাদসহ শেখ মুজিবুর রহমান, খালেক নেওয়াজ খান ও শামসুল হক আটক হন। ইতোমধ্যে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্মবেতনভুক্ত কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে অলি আহাদ তাদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি ঘোষণা করেন। তিনি ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট আহবান করেন। ফলে কর্মচারীদের আন্দোলন একটি ছাত্র আন্দোলনের রূপ নেয় এবং তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। আন্দোলন স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ২৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ প্রক্রিয়ায় অলি আহাদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রদের বহিষ্কার এবং অনেককে জরিমানা করে।
অলি আহাদ ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্মপরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ‘ঢাকা শান্তি রিলিফ কমিটি’ (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০) গঠন করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। সরকারের বন্ধ্যা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তিনি ১৯৫০ সালের ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে অলি আহাদকে আহবায়ক করে গণশিক্ষা পরিষদ গঠন করা হয়।
১৯৫১ সালের ২৭-২৮ মার্চ যুব সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ গঠিত হলে অলি আহাদ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের শেষার্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগের অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এসময় অলি আহাদ যুব লীগকে শক্তিশালী একটি সক্রিয় সংগঠনে পরিণত করেন। ১৯৫১ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামক একটি ছাত্র সমিতি গঠন করেন যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে আত্মপ্রকাশ করে। এ বছরই সরকারের অত্যাচার ও বিরোধী সমালোচকদের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি নাগরিক স্বাধীনতা লীগ (Civil Liberties League) গঠন করেন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দীন ঊর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। অলি আহাদ এ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, বিক্ষোভ সভা ও মিছিলের আহবান করে। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু অলি আহাদ ও আবদুল মতিনসহ ৪ জন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহমুদ আন্দোলনের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে সরে দাঁড়ান। এমন সংকটময় অবস্থায় অলি আহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পরামর্শেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করে তিনি এর প্রচার সম্পাদক (১৯৫৪) ও সাংগঠনিক সম্পাদক (১৯৫৫) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরোধিতা করেন।
১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাগমারিতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে (কাগমারি সম্মেলন) অলি আহাদ ও ভাসানীসহ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একাংশের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতবিরোধ হলে ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এপ্রিলে অলি আহাদ দল থেকে বহিষ্কৃত হলে রাজনৈতিকভাবে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৫৯-১৯৬২ সাল পর্যন্ত কারাবাসের পর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ভারত ঘেঁষানীতির বিরোধিতা করে তিনি বাংলা জাতীয় লীগের সাথে একাত্ম হন। তিনি মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠ ছিলেন, যদিও এটি ছিল একটি নামে মাত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের পর তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে’ গ্রেফতার হন এবং বিনা বিচারে আটক থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্ত হন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫ (১৯৮২) নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এ গ্রন্থে সমকালীন রাজনীতির অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ঢাকা সিটি করর্পোরেশন ২০০৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর নামনুসারে ধানমন্ডির ৪নং সড়কটির নামকরণ করা হয়। মৃত্যু ২০ অক্টোবর, ২০১২ । [গাজী মো. মিজানুর রহমান]
গ্রন্থপঞ্জি অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি (১৯৪৫-’৭৫), খোশরোজ কিতাব মহল লিমিটেড, বাংলাবাজার, ঢাকা, ১৯৮২