বেথুন কলেজ
বেথুন কলেজ বাংলায় নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী প্রথম কলেজ। হিন্দু ফিমেল স্কুল হিসেবে প্রথম এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৪৯ সালের ৭ মে বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় বেথুন স্কুল। এর প্রতিষ্ঠাতা জন ইলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১) ছিলেন ট্রিনিটি কলেজ কেম্ব্রিজের গ্র্যাজুয়েট ও চতুর্থ র্যাঙ্গলার। তিনি গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের আইন উপদেষ্টা হিসেবে ১৮৪৮ সালের এপ্রিলে ভারতে আসেন। তিনি কাউন্সিল অব এডুকেশনেরও সভাপতি ছিলেন। নারীশিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ও পদক্ষেপে তিনি রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী, পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখের ন্যায় কয়েকজন ভারতীয় পন্ডিত ও মনীষীর সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেন।
কলকাতার মির্জাপুরে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জীর দানকৃত জমিতে মাত্র একুশ জন ছাত্রী নিয়ে বেথুন স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫১ সালের ১২ আগস্ট বেথুন এর মৃত্যু হলে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী বেথুন স্কুলের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা নেন। কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের একটি নতুন ভবনে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়। ১৮৫১ সালের ৬ নভেম্বর নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কলকাতার অপর একটি প্রধান মহিলা স্কুল বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে একত্রীকরণের ফলে বেথুন স্কুলের অগ্রগতি দ্রুততর হয়। পুনর্গঠিত বেথুন স্কুল থেকে প্রথমবারের মতো মিস কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে ১৮৭৯ সালের এন্ট্রাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পাঠানো হয় এবং তিনি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর গভীর আগ্রহে সরকার একটি মহিলা কলেজ স্থাপনের বিকল্প পথ আবিষ্কার অথবা কলকাতায় নারীদের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বেথুন স্কুলে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয়।
শুধু কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে ছাত্রী তালিকাভুক্ত করে ১৮৭৯ সালে বেথুন কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৮৩ সালে দেরাদুনের অধিবাসী দেশীয় খ্রিস্টান মেয়ে চন্দ্রমুখী বসু তাঁর সহপাঠী হন। ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে অনুষ্ঠিতব্য ডিগ্রি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৭-১৮৮৮ সালে বেথুন স্কুলের কলেজ শাখায় আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং এগারো জন ছাত্রী তালিকাভুক্ত হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন এম.এ ক্লাসের ছাত্রী। ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেথুন কলেজ বি.এ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি লাভ করে। এরই মধ্যে চন্দ্রমুখী বসু ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং বেথুন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষা নিযুক্ত হন।
কলেজের গৌরবময় প্রথম পঞ্চাশ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও কারিকুলাম বহির্ভূত কার্যক্রমে কলেজটি চমৎকার সাফল্য অর্জন করে। ১৯১৪-১৫ সালের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাহাত্তরে উন্নীত হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটিই ছিল সর্বোচ্চ ছাত্রীসংখ্যা। পরের দশকের দিকে ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ১৫১-তে। পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ২৬০-এ উন্নীত হয়। আইন অমান্য আন্দোলন ও আগস্ট আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক গোলযোগ এবং প্রধানত মহাযুদ্ধের কারণে সাময়িকভাবে কলেজের অগ্রগতি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৪৯ সালের মধ্যে কলেজের ছাত্রীসংখ্যা পুনরায় বাড়তে শুরু করে। শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কলেজের পাঠ্যক্রম সম্প্রসারণ এবং পাঠদানের বিষয়-সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
প্রথিতযশা শিক্ষকবৃন্দ যেমন কামিনী রায়, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিখ্যাত দার্শনিক চিত্তহরণ চক্রবর্তী ও গোপীনাথ ভট্টাচার্য এবং বিখ্যাত পন্ডিত সুশোভন চন্দ্র সরকার বিভিন্ন সময়ে এ কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই খ্যাতনামা শিক্ষার্থী তৈরির ক্ষেত্রে বেথুন কলেজ সাফল্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে আসছে।
১৮৯০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে বাইশ জন মহিলা পরীক্ষার্থী বি.এ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করায় বেথুন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৩৮ সালে কাজী আখতার বানু (পরবর্তীকালে আখতার ইমাম) দর্শনশাস্ত্রে বি.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে গঙ্গামণি দেবী স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪০ সালে কলকাতার বিভিন্ন কলেজের ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণে বেথুন কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজের পরেই স্থান লাভ করে। প্রেসিডেন্সি কলেজ এর ফলাফল ছিল শীর্ষ মানের। ১৯২৫ সালের পরীক্ষার্থী ফজিলতুন্নেসা থেকে শুরু করে বেথুন কলেজের কজন মুসলিম ছাত্রী উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তীকালে ফজিলতুন্নেসা জোহা এই কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান এবং একই সঙ্গে কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আখতার ইমাম (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপিকা ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট) ও শামসুন্নাহার মাহমুদ (পরবর্তীকালে স্কুল পরিদর্শক) বেথুন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুবিদিত নারী ছিলেন যাঁরা তাদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেন এবং নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী মুক্তির আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কামিনী রায়, সরলা দেবী চৌধুরানী, লীলা রায় ও ড. দীপ্তি ত্রিপাঠী। তাঁরা সকলেই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে মূল্যবান অবদান রেখেছেন। ড. অসীমা চ্যাটার্জী সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারে নিজেকে নিয়োজিত করেন, আর বীণা ভৌমিক, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা যোশী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাখেন মূল্যবান অবদান। [রচনা চক্রবর্তী]