অসহযোগ আন্দোলন
অসহযোগ আন্দোলন এম.কে গান্ধীর নেতৃত্বাধীনে প্রবর্তিত ভারতের একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বিভিন্ন কারণে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ সালে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকান্ড ও পাঞ্জাবে সামরিক আইন যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশদের প্রদত্ত উদার অঙ্গীকারকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে। ক্ষতিকর বলে বিবেচিত দ্বৈত-শাসনের কর্ম-পরিকল্পনাসহ মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপোর্ট খুব অল্পসংখ্যক লোককেই সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল। এতদিন পর্যন্ত সরকারের ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষ বিচারে আস্থাশীল গান্ধী এখন উপলব্ধি করলেন যে, বাধ্য হয়েই সরকারের সঙ্গে অসহযোগ আরম্ভ করতে হবে। একই সময়, মিত্র শক্তিবর্গ ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত সেভরস চুক্তির কঠোর শর্তাবলি ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। মুসলমানগণ খিলাফত আন্দোলন শুরু করে এবং গান্ধী নিজেকে তাদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যরূপে একাত্ম করার সিদ্ধান্ত নেন। ‘গান্ধীর উঁচুস্তরের রাজনৈতিক কৌশল’ ভারতে অসহযোগ আন্দোলনে মুসলমানদের সমর্থন লাভ নিশ্চিত করে।
১৯২০ সালের ২২ জুন তারিখ গান্ধী ভাইসরয়কে লেখা একটি চিঠিতে ‘স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা কুশাসনের আশ্রয় নেওয়া শাসককে সাহায্য প্রদান প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে প্রজাবৃন্দের’ স্বীকৃত অধিকারের কথা দৃঢ়রূপে ঘোষণা করেন। ওই চিঠিতে প্রদত্ত সতর্কীকরণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন চালু করা হয়। কলকাতা অধিবেশনে (সেপ্টেম্বর ১৯২০) আন্দোলনের কর্মসূচি স্পষ্টরূপে বিবৃত করা হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল খেতাব ও সরকারি পদ ত্যাগ করা এবং স্থানীয় সংস্থাসমূহের মনোনীত পদসমূহ থেকে ইস্তফা প্রদান করা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অসহযোগকারীরা সরকারি দায়িত্ব, দরবার ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে না এবং তারা স্কুল-কলেজ থেকে তাদের সন্তানদের প্রত্যাহার করবে, পরিবর্তে জাতীয় স্কুল-কলেজ স্থাপন করবে। তারা ব্রিটিশ আদালত বর্জন করবে এবং নিজস্ব সালিশি আদালত প্রতিষ্ঠা করবে; তারা স্বদেশী বস্ত্র ব্যবহার করবে। অসহযোগকারীদেরকে কঠোর নিয়মানুবর্তীভাবে সত্য ও অহিংসা পালন করতে হবে।
কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে (ডিসেম্বর ১৯২০) কলকাতার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। সেখানে দলীয় সংগঠনের উন্নতিসাধনের ওপর জোর দেওয়া হয়। চার আনা চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে সকল বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষ ও নারীর জন্য কংগ্রেসের সদস্যপদ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কংগ্রেস কর্তৃক অসহযোগের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে তা এটিকে নতুন কর্মশক্তি যোগায় এবং ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এটা সর্বভারতব্যাপী বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে শুরু করে। আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে গান্ধী সারা ভারত সফর করেন এবং শত শত জনসভায় ভাষণ দেন।
প্রথম মাসে ৯,০০০ ছাত্র-ছাত্রী স্কুল-কলেজ পরিত্যাগ করে এবং সমগ্র দেশব্যাপী গড়ে তোলা আটশরও অধিক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীনে বাংলায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বর্জন বিশেষভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়। পাঞ্জাবও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বর্জনের ডাকে সাড়া দেয় এবং এ ব্যাপারে লালা লাজপৎ রায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। অন্যান্য যে সকল এলাকা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিল সেগুলি হলো মুম্বাই, উত্তর প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম; মাদ্রাজ তেমন একটা ঐকান্তিকতা প্রদর্শন না করে পেছনে পড়ে থাকে।
আইনজীবীদের আদালত বর্জন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বর্জনের মতো ততটা সফল ছিল না। সি.আর দাশ, মতিলাল নেহরু, এম.আর জয়াকর, এস.কিচলু, ভি.প্যাটেল, আসফ আলী খান ও অন্যান্যদের মতো অনেক বিশিষ্ট আইনজীবী তাঁদের লাভজনক ব্যবসায় পরিত্যাগ করেন, এবং তাঁদের এ আত্মত্যাগ অনেকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। আবারও সংখ্যার দিক থেকে বাংলার অবস্থান ছিল সকলের শীর্ষে এবং এরপর আসে অন্ধ্র, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক ও পাঞ্জাব।
কিন্তু সম্ভবত এ কর্মসূচির সবচেয়ে সফল দিক হলো বিদেশি বস্ত্র বর্জন। বিদেশ থেকে যে সকল বস্ত্র আমদানি করা হয় তার মূল্য ১৯২০-২১ সালের ১০২ কোটি টাকা থেকে নেমে এসে ১৯২১-২২ সালে ৫৭ কোটিতে দাঁড়ায়।
১৯২১ সালের জুলাই মাসে সরকারের প্রতি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া হয়। ‘মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে চাকরি চালিয়ে যাওয়া ধর্মীয় দিক থেকে আইন-বিরুদ্ধ’, এ মত পোষণ করার কারণে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মুহম্মদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। গান্ধী এবং তাঁর সঙ্গে কংগ্রেস মুহম্মদ আলীকে সমর্থন করেন এবং এতদ্বিষয়ে প্রকাশ্য লিখিত ঘোষণা প্রচার করেন। পরবর্তী নাটকীয় ঘটনা হলো ১৯২১ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখ শুরু হওয়া প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর। প্রিন্স যেদিন মুম্বাই এসে পৌঁছেন সেদিন সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল পালিত হয়। তিনি যেখানেই যান সেখানে তাঁকে রাস্তাঘাট জনশূন্য ও দরজা জানালা অর্গলবদ্ধ রাখার মাধ্যমে বিরূপ সংবর্ধনা জানানো হয়। সরকারের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ বিরোধিতায় সাফল্য অর্জনের দ্বারা সাহসী হয়ে অসহযোগকারীরা ক্রমেই অধিকতর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পুলিশের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং এর সদস্যদের সারিবদ্ধভাবে ও একই রকম বেশে সজ্জিত হয়ে কুচকাওয়াজ করে গমনের দৃশ্য সরকারের নিকট কোনোক্রমেই অভিপ্রেত ছিল না। কংগ্রেস ইতঃপূর্বেই প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিসমূহকে যেখানে তারা মনে করত জনগণ প্রস্ত্তত সেখানে ট্যাক্স প্রদান না করাসহ ব্যাপক আইন অমান্যকারী আন্দোলন বলবৎ করার অনুমতি প্রদান করে রেখেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের অন্যান্য অপ্রত্যক্ষ ফলাফলও ছিল। উত্তর প্রদেশে অসহযোগের সভা ও চাষীদের সভার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ আন্দোলন কেরালার মালাবারে মুসলমান প্রজাদের তাদের ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হতে সাহায্য করে। আসামে চা বাগানের শ্রমিকগণ ধর্মঘটে যায়। পাঞ্জাবে আকালি আন্দোলন ছিল সর্বজনীন অসহযোগ আন্দোলনের একটি অংশ।
বাংলায়ও এটি প্রচন্ড শক্তি অর্জন করে। শুধু কলকাতায়ই নয়, গ্রাম বাংলায়ও প্রাথমিক জাগরণ পরিলক্ষিত হয়। চাঁদপুর নদীবন্দরে গুর্খারা কুলিদের বে-আইনিভাবে দৈহিক আঘাত করার পর (২০-২১ মে) এটা চরম সীমায় পৌঁছে। জে.এম সেনগুপ্তের নেতৃত্বাধীনে সমগ্র পূর্ববাংলা ছিল উত্তপ্ত। কিন্তু সবচেয়ে সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত গ্রামীণ আন্দোলন ছিল মেদিনীপুরে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে পরিচালিত ইউনিয়ন বোর্ড-বিরোধী বিক্ষোভ।
অসহযোগ আন্দোলন যত চলতে থাকে ততই এটা পরিষ্কাররূপে প্রতিভাত হয় যে, বাংলার নারীরা প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক। নারী জাতীয়তাবাদীরা এখানে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির ’মহিলা কর্ম সমাজ’ অথবা মহিলাদের সংগঠন বোর্ডের আওতাধীনে নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে। সমাজের নারীরা সভার আয়োজন করে ও অসহযোগের মর্ম জনে জনে প্রচার করে। নারী স্বেচ্ছাসেবিকাগণ এগিয়ে আসে। সি.আর দাশের স্ত্রী ও ভগিনী যথাক্রমে বাসন্তী দেবী ও ঊর্মিলা দেবী, জে.এম সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা, অন্যান্যদের যেমন মোহিনী দেবী, লাবণ্যপ্রভা চন্দকে সঙ্গে নিয়ে এ আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের কর্মকান্ডের প্রধান ক্ষেত্র ছিল বিদেশি মদ ও বস্ত্রের দোকানে পিকেটিং করা এবং রাস্তাঘাটে খদ্দরের কাপড় বিক্রি করা।
আন্দোলনের বিভিন্ন কেন্দ্রে সরকার ফৌজদারি আইনের ১০৮ ও ১৪৪ ধারা জারি করে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং ডিসেম্বর মাস নাগাদ ভারতের সকল স্থান থেকে ৩০,০০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে শুধু গান্ধী জেলের বাইরে ছিলেন। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি মালব্যের উদ্যোগে আপস-মীমাংসায় পৌঁছতে আলাপ-আলোচনার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এতে এমন শর্তাবলি জুড়ে দেওয়া হয় যার অর্থ দাঁড়ায় খিলাফত নেতৃবৃন্দকে বলি দেওয়া। এ পন্থা গ্রহণে গান্ধী রাজি ছিলেন না। ওই সময় তিনি কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীদের নিকট থেকে ব্যাপক আইন অমান্যকারী আন্দোলনের পর্ব শুরু করার বিষয়ে বেশ কিছুটা চাপের মধ্যেও ছিলেন। গান্ধী সরকারের সমীপে চরমপত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু সরকার এতে কোনো সাড়া না দেওয়ায় তিনি সুরাট জেলার বারদলি তালুকে আইন অমান্যকারী আন্দোলন প্রবর্তন শুরু করেন। এ সময় চৌরিচৌরার দুঃখজনক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় যা আন্দোলনের গতি পরিবর্তন করে। ৩,০০০ ব্যক্তির এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা ২৫ জন পুলিশ ও একজন ইন্সপেক্টরকে হত্যা করে। এ ঘটনা গান্ধীর নিকট বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয়। এর ফল হলো যে, তিনি তৎক্ষণাৎ আন্দোলন স্থগতি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এভাবে ১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিরতে অসহযোগ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
অসহযোগ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও অর্জন সম্পর্কে বলা যায়, এটি খিলাফতকে নিশ্চিত করতে ও পাঞ্জাবের অন্যায় প্রতিবিধানের লক্ষ্য অর্জনে আপাতভাবে ব্যর্থ হয়। এক বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুত স্বরাজ আসে নি। তৎসত্ত্বেও, ১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা ছিল শুধু অস্থায়ী পদক্ষেপ। একটি খন্ডযুদ্ধ শেষ হলেও বৃহত্তর সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। [রঞ্জিৎ রায়]