সামাজিক স্তরবিন্যাস
সামাজিক স্তরবিন্যাস বাংলাদেশে সামাজিক স্তরবিন্যাসের মূল প্রোথিত রয়েছে অতীতের ধর্মব্যবস্থা ও আর্থকাঠামোর ভিত্তিভূমিতে। ধর্মের গতি-প্রকৃতি এদেশের জীবনধারা ও উন্নয়নের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতকে প্রভাবিত করলেও অর্থনীতি ও রাজনৈতিক উপাদানগুলির প্রাসঙ্গিকতাও এক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পেশা, বৃত্তি বা উৎপাদন ব্যবস্থাই সামাজিক স্তরবিন্যাসকে ধর্মরূপের মধ্যে স্থায়িত্ব প্রদান করেছে। বাংলার হিন্দুসমাজ বর্ণভেদ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছিল, যদিও চারটি সুপরিচিত শ্রেণি বিভাজন, যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সুসংহত ও নিয়মিত ধারায় আবির্ভূত হয় নি। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে দুটি মধ্যবর্তী বর্ণ- ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য তেমন দৃশ্যমান ছিল না। বাংলার ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণদের মধ্যে দুটি প্রধান বর্ণভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন উপবর্ণের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত মেলামেশার মাধ্যমে অব্রাহ্মণ শ্রেণির মতো মিশ্রশ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণরা সমাজের উচ্চস্থান অধিকার করে ছিল। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যেমন ভৌগোলিক বিভাজন ছিল (রাঢ় এবং বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ), তেমনি কৈবর্ত ব্রাহ্মণ নামে আরও একটি স্তর ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে যে, স্থানীয় ব্রাহ্মণরা বেদ সম্পর্কে তেমন বিশারদ ছিল না এবং সেই শূন্যতা উত্তর ভারত থেকে আগত কৈবর্ত ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত ব্রাহ্মণরা পূরণ করেছিল। অব্রাহ্মণ উপ-শ্রেণিকে সাধারণত পৌরোহিত্য সংক্রান্ত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: উচ্চ মিশ্র, মধ্যম মিশ্র এবং নিম্নশ্রেণির মিশ্র। প্রথম শ্রেণিতে করণ বা কায়স্থ (লেখক), অম্বষ্ঠ বা বৈদ্য (ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসক), এছাড়া তাঁতি, উগ্র (যোদ্ধা) এবং অন্যান্যদের মধ্যে কুড়িটি উপবর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্বর্ণকার, ধীবর (জেলে) প্রমুখ বারোটি উপবর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং সর্বশেষ শ্রেণিতে চন্ডাল (মৃতদেহ সৎকারকারী ব্যক্তি), চামার (মুচি) ও অন্যান্যদের মধ্যে নয়টি উপবর্ণের লোকজন অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেষোক্ত শ্রেণিটি ছিল অস্পৃশ্য শ্রেণি।
কিছু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসক প্রথমবারের মতো উল্লেখ করেন যে ভারতে মুসলমানদের সামাজিক স্তরবিন্যাস হিন্দু বর্ণপ্রথার অনুসরণে করা হয়েছিল। অবশ্য, এটা একটা বিতর্কের বিষয় যে বর্ণপ্রথার মৌলিক নীতিগুলি (শুদ্ধতা/অশুদ্ধতা, একত্রে আহার গ্রহণে বিধি-নিষেধ, অর্ন্তবর্তী বিবাহ বা বংশানুক্রমিক পেশা) মুসলমানদের স্তরবিন্যাস নির্ধারণে কতটুকু ভূমিকা রেখেছিল। জেমস ওয়াইস মুসলমানদের মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আশিটি বর্ণের সন্ধান পান, পক্ষান্তরে গেইট পান মাত্র তিনটি। গেইট সামাজিক স্তরবিন্যাসকে গুচ্ছাকারেও লক্ষ্য করেন। তিনটি প্রধান গুচ্ছের মধ্যে ছিল আশরাফ বা উচ্চ শ্রেণির মুসলমান, আজলাফ বা নিম্ন শ্রেণির মুসলমান এবং আরজল বা মানমর্যাদাহীন শ্রেণির মুসলমান। প্রথম গুচ্ছে ছিল সৈয়দ, শেখ, পাঠান এবং মুগল পক্ষান্তরে অন্য দুটি গুচ্ছে পঞ্চাশটির মতো পেশাজীবী বর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটা লক্ষণীয় যে, মুসলমানদের মধ্যে আন্তঃর্বিবাহ বা আন্তঃবর্ণ বিবাহের প্রচলন ছিল, কিন্তু শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা বা একত্র আহার সংক্রান্ত বিধিনিষেধের দিকগুলি অনুসরণ করা হতো না। বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে উচ্চবর্ণের উপস্থিতির বিষয়টি ভারতের উত্তরাঞ্চলের তুলনায় অনেক কমই গুরুত্ব বহন করত। এ সকল বিভেদ এখানে কম ছিল বলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে বর্ণবিভেদ খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কেউ কেউ বিশ্বাস করত বাংলার মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, এসব কারণে দ্রুত ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারেনি। মুসলমানদের সামাজিক স্তরবিন্যাসের বাধ্যবাধকতার বাঁধন নমনীয় হওয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই যে, বর্ণসমূহের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অনেকটা সহজ ছিল। একজন নিম্নবর্ণের মুসলমানের পক্ষে উচ্চ অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভবপর ছিল। এ ধরনের অবস্থানের পরিবর্তন বাংলাদেশে ত্বরান্বিত হয় ধনসম্পদ অর্জনের কারণে। মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের এ ধরনের নমনীয় প্রক্রিয়াটি একটি পৃথক আদর্শগত পরিপ্রেক্ষিত থেকে এর উপাদান সংগ্রহ করে, যা ‘শরাফতি’ বলে পরিচিত। এটা একজন মানুষের মহৎ পরিচিতি থেকে পরোক্ষভাবে এসেছে। হিন্দু বর্ণপ্রথার মতো কোন গভীর ধর্মীয় আদর্শের চেয়ে বরং কারও বংশগত পরিবারের ওপর এটা অধিকাংশে নির্ভরশীল ছিল। হিন্দুধর্মীয় পুরাণমতে, মহাপ্রভু ব্রহ্মার চারটি ভিন্ন ভিন্ন অংশ থেকেই চারটি বর্ণের উদ্ভব। তাতে আরও নির্দেশ করা হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণ মাথা থেকে উদ্ভূত, নিম্নবর্ণ শূদ্র পা থেকে উদ্ভূত। এই বিন্যাস জন্মগত ও অপরিবর্তনীয়। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের স্তরবিন্যাসে গতিশীলতা এ কারণে সম্ভব হয়েছিল যে, এখানে বিশ্বাস করা হতো বিশেষভাবে মানুষ তার বংশ-পরম্পরার ইতিহাসকে কৌশলে পরিবর্তন করতে পারে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের নির্মাণে প্রাথমিক পর্যায় থেকে কৃষিকাঠামো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা পর্যায়ক্রমে বর্তমান আকারে রূপ নেয়। একটি ছোট শহরের জনগোষ্ঠীর বিপরীতে জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গ্রামাঞ্চলে বাস করত। যারা গ্রামে বসবাস করত তারা কৃষি থেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। অতএব কৃষিকাঠামো থেকে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বাংলার প্রাক্-ঔপনিবেশিক আমল থেকে জমিদার বা রাজস্ব সংগ্রাহকগণ কৃষি কার্যক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শ্রেণি ছিল এবং ১৯৭৩ সালে নতুন ঔপনিবেশিক ভূমিনীতি এই মৌলিক ভারসাম্যকে নষ্ট করেনি। ভূমির মালিকানার হাত বদল হয়েছিল, কিন্তু শ্রেণিটি বিলুপ্ত হয়নি। জমিদার শ্রেণির নিচেই ছিল একটা বিশাল কৃষক শ্রেণি। পর্যায়ক্রমিক ঔপনিবেশিক আমল, বিশেষত উপ-সামন্তপ্রথার (যা বাংলায় ‘পত্তনধারী’ বলে পরিচিত) সময়কার ভূমিনীতি একটা মধ্যবর্তী খাজনা সংগ্রাহক ব্যবস্থার সৃষ্টি করে, যার ফলে জোতদার, গণতিদার, হাওলাদার বা তালুকদার কিংবা ভূঁইয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কৃষিনির্ভর স্তরের অভ্যুদয় ঘটে। বিভিন্ন ভূমি-রায়তি ব্যবস্থা প্রবর্তনের সামগ্রিক ফলাফল ছিল ভূমি-সংশ্লিষ্ট ব্যাপক ভিত্তিক স্তরবিন্যাসকৃত সমাজের অভ্যুদয়।
ঔপনিবেশিক অঞ্চলের কৃষিসমাজে একটি ধনী কৃষক শ্রেণির অভ্যুদয়ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যারা সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত। অন্তত একটি বিশেষ অর্থব্যবস্থাগত উন্নয়ন ধনাঢ্য পাতি বুর্জোয়া কৃষকশ্রেণির অভ্যুদয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। নীল চাষ এবং পাট চাষের মাধ্যমে বাংলার কৃষির সাথে বিশ্ব অর্থনীতির বাজারের সংযোগ ঘটে। ধনী কৃষকশ্রেণি পল্লী সমাজ কাঠামোতে অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতাকে উপভোগ করতে থাকে। পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক আমলে কৃষিভিত্তিক সমাজও নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়, যার ফলে ভূমিহীন শ্রেণির অভ্যুদয় ঘটে এবং এখানে বিভিন্ন ভূমি রায়তি ব্যবস্থা কৃষিকাঠামোর শ্রেণিবিন্যাস ঘটায়; ফলে এসবের দ্বারা সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রভাবিত হয়। ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদ কৃষিক্ষেত্রে মজুরি শ্রমিকদের আবির্ভাবের সুযোগ সৃষ্টি করে। ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট সামাজিক স্তরবিন্যাস উচ্চতর ভূমিমালিক শ্রেণি, বহুস্তরবিশিষ্ট মধ্যস্বত্বভোগী ভূমিমালিক, ধনী কৃষক/পাতি বুর্জোয়া, দরিদ্র কৃষক বর্গাচাষি এবং ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে থেকে আসা কৃষি শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত হয়।
শহরাঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের সাথে সাথে শহরের সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়। শহুরে বাংলায় শিক্ষিত পেশাজীবী (আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলি, চাকুরিজীবী) এবং অন্যান্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ভদ্রলোক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে, যারা শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নতুন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। অন্যদিকে, নতুন সৃষ্ট ব্যবসায়ী শ্রেণি ছিল আকারে ছোট, তবে এটি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে পাশ্চাত্যের ধনিক শ্রেণির সাথে তুলনীয় ছিল না। পূর্বে, ব্যবসায়ী বা বণিকদের ভোগকৃত সামাজিক মর্যাদা ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চবর্ণের তুলনায় কম ছিল এবং ঔপনিবেশিক আমলে এটা বদলে যায়। ব্যবসায়ী শ্রেণি শিক্ষিত হয়ে ওঠে এবং শিক্ষিত শ্রেণিও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপৃত হয়। জমির মালিকরা মালিকানাসূত্রে ভদ্রলোকদের আভিজাত্যের সারিতে শামিল হয়। জীবনযাপন পদ্ধতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে তারা অভিনব বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। শিল্প, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের অভিনবত্ব বেশ দৃষ্টিগোচর ছিল।
বাংলাদেশে জমিদারি ভূমিব্যবস্থার বিলোপ সাধন ছিল উপমহাদেশের বিভাজনের অব্যবহিত পরবর্তী উন্নয়নের একটি বাস্তবতা। যেহেতু অধিকাংশ জমির মালিক ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, ভারত বিভাজনের পর ভারতে তাদের অভিবাসন এদেশের সমাজ কাঠামোতে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করে। কৃষির সাথে যুক্ত মুসলমানদের ঐতিহ্যগত ধনিক শ্রেণি সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে, যদিও বাস্তবে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। একই সময়ে ১৯৫০-এর দিকে কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি প্রচলনের ফলে একজন ধনী কৃষকের/কৃষিভিত্তিক পুঁজিপতি শ্রেণির শক্তিশালী হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয় এবং তারা সামাজিক স্তরবিন্যাসের উচ্চ স্থান অধিকারের শক্তিশালী দাবিদার হয়ে ওঠে। মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণিরূপে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা আদায় করে এবং যারা ভারত বিভাগের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত হয়, এ সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে তারা বিশেষ দৃষ্টির প্রকাশ ঘটায়। সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াটি কালক্রমে তার গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবেই হারিয়ে ফেলে। কৃষির পুঁজিবাদী বিকাশ এবং সীমিত শিল্পায়ন সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী উন্নয়ন একটি স্বতন্ত্র শ্রেণির বিকাশ সংঘটনে যথেষ্ট ছিল না। পরাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সব সময়েই একটি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অভ্যুদয়কে ব্যাহত করে, যে ধরনের অভ্যুদয় শিল্পায়িত পাশ্চাত্য বুর্জোয়া, উচ্চ শ্রেণির ভদ্রলোক ও পেশাজীবীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তার বদলে রাজনৈতিক, অর্থনীতির পরিভাষায় দালাল বুর্জোয়া, প্রতিনিধিত্বমূলক মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং উদ্বাস্ত্ত শ্রেণি শহর এলাকায় সামাজিক শূন্য স্থানসমূহ দখল করে ফেলে।
বংশক্রম বা গোষ্ঠীর পরিচয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে অর্থনৈতিক শক্তির ক্রমবর্ধমান ভূমিকা বাংলাদেশ আমলেও অব্যাহতভাবে সক্রিয় রয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ অবশ্য গ্রামীণ ও শহুরে স্তরবিন্যাসের পার্থক্যকে উপেক্ষা করতে পারে না। অর্থনৈতিক শ্রেণিসমূহের মর্যাদাকে অনুসরণ করেই পল্লীর সামাজিক স্তরবিন্যাসের গঠন বিন্যাস করা হয়েছে। সম্পদ হচ্ছে সামাজিক স্তরবিন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। সম্পদের জন্য ভূমির মালিকানা এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। সামাজিক মর্যাদার আরও প্রকাশ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চাকরিজীবী, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা শিক্ষিত শ্রেণির সদস্য হিসেবে সমাজে মর্যাদা ভোগ করে। তথাপি, সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণে বস্ত্তগত সম্পদ অন্য সকল উপাদানকে ছাড়িয়ে যায়। খ্যাতিমান বংশের কোন ব্যক্তি যদি সম্পদশালী না হয়, তা’হলে সে উঠতি ধনীর তুলনায় গ্রামীণ সমাজে যথেষ্ট মর্যাদা ভোগ করে না।
যেসব কৃষিভিত্তিক শ্রেণি ও গোষ্ঠী বংশক্রমানুপাতিক মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে গ্রামীণ সমাজ গঠন করে সেগুলি হচ্ছে পুঁজিপতি কৃষক, ধনী চাষি, মাঝারি চাষি, প্রান্তিক চাষি এবং ভূমিহীন। পুঁজিপতি কৃষকরা সম্পদশালী, জমি ও প্রযুক্তির মালিক, বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগ করে এবং বাজারের জন্য চাষাবাদ করে। ধনী চাষিরাও সম্পদশালী, বাইরের শ্রমিক নিয়োগ করে, তথাপি তারা চাষাবাদেই নিয়োজিত থাকে। মাঝারি চাষি প্রধানত জীবিকার জন্য চাষাবাদ করে, কখনও কখনও বাজারে বেচা-কেনায় অংশ নেয় এবং প্রধানত গৃহস্থালি শ্রমের উপরই নির্ভর করে। প্রান্তিক চাষি বেঁচে থাকা নিশ্চিতকরণকল্পে চাষাবাদ ও শ্রম বিক্রয় করে। ভূমিহীন জনগণ মজুরির ভিত্তিতে শ্রম বিক্রয় করে, প্রধানত কৃষিতে, মাঝে মাঝে অকৃষিজ কাজেও নিয়োজিত হয়। পরিসংখ্যানের দিক থেকে, পল্লী পরিবারের তিন-চতুর্থাংশ প্রান্তিক চাষি এবং ভূমিহীনদের শ্রেণিভুক্ত। যে প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ব্যতিরেকে ভূমিহীন পরিবারের উদ্ভব ঘটে তাকে বলা হয় নিঃস্বকরণ এবং গ্রাম-বাংলাদেশে এর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পল্লীর স্তরবিন্যাসে কামার, স্বর্ণকার, মেথর, তাঁতি, কলু (তেলি বা যারা তেল উৎপাদন করে) এবং অন্যান্য যারা ন্যূনতম মর্যাদা পেয়ে থাকে এজাতীয় কতিপয় পুরানো গোষ্ঠী বসবাস করে। তবে ক্রমেই পেশাদার উৎপাদকগণ এ সকল গোষ্ঠীর স্থান দখল করে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে ভোজ্য তেল আসে কারখানা থেকে।
দীর্ঘ সময়ের তথ্য পরীক্ষা করে দেখলে একটি গ্রামীণ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার গতিশীলতা অনুধাবন করা যায়। গ্রামীণ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের পেছনে বিভিন্ন ধরনের শক্তি কাজ করে। অনেক উদ্বৃত্ত উৎপাদনকারী গ্রামীণ পরিবার পর্যায়ক্রমে প্রথমে গ্রাসাচ্ছাদনকারী এবং পরবর্তীকালে অসচ্ছল পরিবারে পরিণত হয়। অন্যদিকে অনেক অসচ্ছল পরিবার অবস্থাপন্ন পরিবারে উন্নীত হয়। বাজার ব্যবস্থা, জনসংখ্যার অবস্থা, উত্তরাধিকার আইন, পরিবারসমূহের ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি এই গতিশীলতার পেছনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে গ্রামীণ সামাজিক স্তরবিন্যাসটি সব সময় অবশ্য জীবনযাত্রা, আচারপ্রথা, নৈতিকতা ও বিভিন্ন শ্রেণির ভাষার পার্থক্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়নি। পোশাক-আশাক ও ভাষার ক্ষেত্রে সাধারণ বিষয়গুলি কখনও কখনও সামাজিক মর্যাদার পার্থক্যসমূহকে আড়াল করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, লুঙ্গি ও শার্ট হচ্ছে এমন পোশাক যা অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে গ্রামের সকল মানুষ পরিধান করে, যদিও অতি দরিদ্র ব্যক্তিগণ অর্থনৈতিক কারণে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ আবৃত করতে পারে না। ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহার মতো সামাজিক উৎসব ও অনুষ্ঠানসমূহ সম্প্রীতি চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পল্লী অঞ্চলে সমাজের চেতনা বা ধারণা সামাজিক বিভাজনের প্রভাবকে কমিয়ে দেয়। পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সমাজের সুবিধাভোগের সম্পর্কটিও কোন কোন ক্ষেত্রে ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যকার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। খানদান বা বংশানুক্রমিক মর্যাদাকেও হিসেবের মধ্যে রাখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, চৌধুরী, খন্দকার, সৈয়দ প্রভৃতি খানদানি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় ধনীরা ধনীকে অগ্রাধিকার দেয়। সামাজিক স্তরবিন্যাসের পার্থক্যকে বস্ত্তগত স্বাচ্ছন্দ্যের পার্থক্য হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। মর্যাদা ও ক্ষমতার সাথে বিলাসবহুল জীবনযাপন ও বিপুল ব্যয় একজনের সম্পদ সম্পর্কে ধারণা দেয়। অবশ্য, সমাজের উপরিস্তর পর্যায়ক্রমে শিক্ষিত হয়ে উঠছে এবং এতে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে একটা সামাজিক পার্থক্য গড়ে উঠেছে। বস্ত্তত, আধুনিক শিক্ষা, আচার ব্যবহার এবং সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে পল্লী অঞ্চলে একটি ভদ্রলোক শ্রেণি স্বতন্ত্র জীবনধারার ভিত্তিতে আবির্ভূত হতে পারে।
শহুরে সামাজিক স্তরবিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে পূর্ণ। অধিকাংশ জেলা শহর এখনও ছোট ও পশ্চাৎপদ, তবে তাদের মধ্যে কিছু কিছু শহর তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনা এই তিনটি শহর বিবিধ প্রাণবন্ত আর্থিক সেবাখাতের পাশাপাশি বড় বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই সকল শহরে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকৃতিকে গড়ে তুলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নির্বাহী, বেসামরিক আমলা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পকর্মী, শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে শহরাঞ্চল গড়ে উঠেছে। আধুনিক শ্রেণি আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতে একটি বিরাট সংখ্যক শ্রমিক শ্রেণি নাগরিক জনসংখ্যার উপাদান হয়ে আছে। সম্পদ এবং শিক্ষার উপরে শহরের সামাজিক মর্যাদা বহুলাংশে নির্ভরশীল। বংশানুক্রমিক পরিচয়ের মতো পুরানো উপাদানের গুরুত্ব এক্ষেত্রে নিম্নতম পর্যায়ে চলে এসেছে। নাগরিক জীবনধারা, পোশাক-আশাক, সৌজন্য, বিনোদনমূলক কার্যক্রম ইত্যাদি শ্রেণির ভিত্তিতে বিভাজিত হয়। ১৯৮০-র শেষার্ধের একটি গবেষণায় জানা যায় যে, ৪৩.৪ শতাংশ পরিবার সরকারি অফিস, সংস্থা, ব্যাংক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেতনভুক পেশাজীবী ছিলেন: এদের মধ্যে শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী এবং অন্যান্যরাও অন্তর্ভুক্ত। বড় ব্যবসায়ী, মাঝারি ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে গঠিত শ্রেণিটির বিভাজন ছিল ৩৬.৭ শতাংশ। এর অতিরিক্ত ৭.৪ শতাংশের মধ্যে গৃহবধু, শিক্ষার্থী, বেকার এবং অন্যান্যদের মতো কোন রকম আনুষ্ঠানিক পেশাবিহীনদের পাওয়া যায়।
উপরে উল্লিখিত চারটি শ্রেণিকে দুইটি বড় দলে স্তরবিন্যাস করা যায় এবং পূর্বের দুইটি শ্রেণিকে উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন দল ও পরের দুটি শ্রেণিকে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন দল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ব্যবসায়িক সম্প্রদায় অর্থসম্পদের জোরে সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। সামাজিক মর্যাদা এবং ক্ষমতার মধ্যে অত্যন্ত নিকট সম্পর্ক রয়েছে। এখন ব্যবসায়ী লোকজন রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। অবশ্য, সাধারণ মানুষের চোখে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সকল মানুষ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে না। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সবসময় সম্পদশালী না হলেও ভাল সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে থাকে। যে ব্যক্তি সফলভাবে সম্পদ এবং শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে পারে সে ব্যক্তি সামাজিক মর্যাদা ভোগের ক্ষেত্রে অন্য সকলকে অতিক্রম করে যায়। শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার শিল্পীরাও সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। সম্পদশালী ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক ভোগকৃত সামাজিক মর্যাদা সবসময় সামাজিকভাবে অনুধাবন করা যায় না। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায় কাকে কতটুকু সামাজিক মর্যাদা দেবে তা নির্ধারণ করে ওই সমাজের অন্তর্নিহিত নৈতিকতার ওপর। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে অর্থসম্পদ সবসময় সামাজিক মর্যাদা বিধান করে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি মানুষ যদি সমাজের চোখে কলঙ্কজনক কোন কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকে সে যত অর্থসম্পদের মালিক হোক না কেন তাতে তার সামাজিক মর্যাদা খুব বেশি বৃদ্ধি পায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে শহরাঞ্চলের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে মাস্তানদের আবির্ভাব ঘটেছে। তবে তাদের অর্থ ও ক্ষমতা থাকলেও তাদেরকে সমাজে হীনদৃষ্টিতে দেখা হয়। অর্থসম্পদ উপার্জনের উৎস ও উপায় কখনও কখনও সামাজিক মর্যাদা ও সুনাম অর্জন নির্ধারণ করে দেয়।
বাংলাদেশের বড় বড় শহরে বসবাসকারী জনসাধারণের জীবনযাত্রায় পার্থক্য রয়েছে। ধনীরা বড় হোটেলে, ক্লাবে এবং কেনাকাটায় সময় ব্যয় করে, পক্ষান্তরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি টেলিভিশন দেখে বাইরে খাওয়া-দাওয়া করে বা ছবি দেখে। গরিবরা মাঝে মাঝে ছবি দেখে, পার্ক ও চিড়িয়াখানায় যায়, স্টেডিয়ামে খেলা দেখে, নেশা করে অথবা দেশীয় মদ পান করে। পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে ধনীরা হাল ফ্যাশনের পোশাক পরে যা বেশ দামিও বটে। ইদানীং ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ইংরেজিতে বা মান বাংলায় কথাবার্তা বলে। বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীমূলক শিল্পকর্মে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ মর্যাদার একটা প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও একথা সত্য যে দুর্বল শিল্পায়ন ও নিরক্ষরতা এবং দারিদ্র্য বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মূল চিত্র, তথাপি পুরানো সমাজকাঠামো থেকে আধুনিকতার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উত্তরণমূলক প্রক্রিয়াও ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। [মনিরুল ইসলাম খান]