রোজ গার্ডেন

রোজ গার্ডেন  পুরানো ঢাকার টিকাটুলিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে জমিদার হূষিকেশ দাস সাত একর জমির উপরে এই অট্টালিকাটি নির্মাণ করেন এবং বাড়ির চারপাশে ফুলবাগান ও অন্যান্য গাছগাছালিতে দৃষ্টিনন্দিত পরিবেশ সৃষ্টি করেন।

রোজ গার্ডেনের বহুবিচিত্র গোলাপের সুপ্রশস্ত উদ্যানে স্থাপিত বিচিত্র সকল মূর্তি ও অলংকরণের মাঝে ঝর্ণা ও দিঘির চিত্তাকর্ষক প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে নির্মিত সুবিশাল গম্বুজ, বর্ণময় অলংকৃত সারি সারি জানালা ও বৃহৎ স্ফটিকস্বচ্ছ ঝাড়বাতি সম্বলিত এই অট্টালিকাটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকলার এক অনুপম নিদর্শন। করিন্থীয়-গ্রিক শৈলী অনুসরণে এই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করা হয়।

রোজ গার্ডেন

নির্মাণশৈলীর অভিনবত্বে এই ভবনটি অনন্য। এর ভিত্তির উপর ছয়টি বিভিন্ন উচ্চতার খাঁজকাটা থাম রয়েছে। এগুলির শীর্ষাংশ লতাপাতার নকশা করা। এই ছয়টি থামকে নিয়ে নির্মিত সম্পূর্ণ অট্টালিকাটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত। ভবনের মধ্যভাগের তিনটি অংশের প্রবেশদ্বারের উপরের খিলানগুলি ঢালাইকৃত এবং অর্ধবৃত্তাকারের। দুপাশের দুঅংশের ছাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রায় বৃত্তাকার চাঁদোয়ারীসদৃশ, যা মধ্যবর্তী অংশটিকে ঘিরে রেখেছে। ভবনের মূল বারান্দার সাথে রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকৃতির ব্যালকনি, এর অবস্থান প্রবেশপথের তিনটি খিলানের উপরে। প্রাসাদে যানবাহন প্রবেশ করে পূর্বদিক থেকে, সেদিক থেকে রাস্তা এসে মিলেছে পোর্টিকোতে। উদ্যানের শোভা উপভোগের জন্য ভবনের প্রতিটি অংশে ঢালাইকৃত লোহার ব্রাকেটের উপর বর্গাকৃতির অবস্থান। এর শীর্ষ গম্বুজ আকৃতির সেখানে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখা হয়।

ভবনটির সকল প্রবেশদ্বার কাঠ, রঙিন বেলজীয় কাঁচ ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি এবং সেগুলি জটিল জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতা ও বিভিন্ন প্রাণীর মোটিফে অলংকৃত। উপর তলায় শ্বেত পাথরের মেঝের পরে রয়েছে এক বিশাল বলরুম। এর সিলিং জুড়ে রয়েছে সবুজ কাচ দিয়ে তৈরি ফুলের নকশা। বলরুমের সামনে ছাদে যাওয়ার জন্য একটি নকশাকাটা পেঁচানো সিঁড়ি বসানো হয়েছে। ঘুরানো সিড়ির সমান্তরালে জমাটবাঁধা সিমেন্টের রেলিং-এ রয়েছে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা।

প্রায় সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত পশ্চিমমুখী এই অট্টালিকাটি প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফুট উঁচু। এর সম্মুখ ভাগ অন্যান্য সকল দিকের চাইতে আকর্ষণীয়। সাধারণ মানের পার্শ্ববর্তী বর্ধিত অংশের ঢালু ছাদ পূর্ব ও পশ্চিমের ত্রিকোণাকৃতির চাঁদোয়ারীর সাথে মিশেছে যা উপনিবেশিক স্থাপত্যরীতির পরিচায়ক। অট্টালিকাটির বাইরের দেয়ালের অধিকাংশই গোলাপি রঙে রঞ্জিত ছিল। তবে কালের বিবর্তনে সেখানকার রং বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

১৯৬৩ সালে হূষিকেশ দাসের নিকট থেকে বিত্তশালী ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদ ক্রয়সূত্রে এই সম্পত্তির অধিকারী হন। ১৯৩৭ সালে তিনি সপরিবারে সেখানে বসবাস শুরু করেন এবং রোজ গার্ডেনের নতুন নাম করেন ‘রশীদ মঞ্জিল’।

ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয় এই রোজ গার্ডেনে। এই ভবনে আতিথ্য গ্রহণ করেন বাংলাদেশ ও ভারতের বিখ্যাত অনেক জননেতা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল এ রোজ গার্ডেন। ১৯৪৯ সনে এ বাড়িতেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়া এবং এর প্রথম অনানুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে রশিদের দ্বিতীয় পুত্র কাজী আব্দুর রকিব বেঙ্গল স্টুডিও অ্যান্ড মোশন পিকচার্স-এর নিকট এই সম্পত্তি ভাড়া প্রদান করেন। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে রোজগার্ডেন রাজ-রাজড়া ও জমিদারদের কাহিনী সংশ্লিষ্ট বহু চলচ্চিত্র নির্মাণের জনপ্রিয় স্পটে পরিণত হয়। এখানে চিত্রায়িত প্রথম কাহিনীচিত্র হারানো দিন দেখে দর্শকবৃন্দ উদ্যান পরিবেষ্টিত অট্টালিকাটির মহিমা প্রত্যক্ষ করেন।

১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর এই প্রাসাদটিকে সংরক্ষণ তালিকাভুক্ত করে এবং তখন থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই স্থাপনাটি সংরক্ষণ করে চলেছে।  [এ.এস.এম এনায়েত করিম]