ভাস্কর্য

ভাস্কর্য  প্রাচীনকাল থেকে এবং মধ্যযুগের প্রাথমিক পর্যায় (১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) পর্যন্ত বাংলা পূর্ব ভারতের ওপর তার রাজনৈতিক সম্প্রসারণ ও সঙ্কোচন উভয়ই প্রত্যক্ষ করেছে। যার ফলে এ অঞ্চলে তার সাংস্কৃতিক প্রভাবের উত্থান-পতন পরিলক্ষিত হয়। বাংলার ভাস্কর্যের ধারাবাহিক উপস্থাপনে ঐতিহাসিক এই বিষয়গুলি স্মরণে রাখা প্রয়োজন। আনুমানিক ৭৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পাল রাজাদের সবচেয়ে গৌরবময় দিনগুলিতে বাংলা উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় এলাকা জুড়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও পালদের মূল আবাসভূমি ছিল উত্তর বঙ্গ এবং তাদের দীর্ঘ শাসনকালে বিহার ছিল রাজ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তথাপি শশাঙ্ক (আনু. ৬০০-৬২৫ খ্রি) ব্যতীত তাদের আগে বাংলার অন্য কোন রাজা নিজ রাজ্যের বাইরে শাসন পরিচালনা করেন নি। তাই খোদাই কর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মৌর্য সম্রাট অশোকের (আনু. ২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অবদানকে হিসেবে আনার সুযোগ এখানে নাই, যদিও বেনারসের অদূরবর্তী চুনারে তাঁর শিল্পশালা পাওয়া গিয়েছে এবং তাঁর রাজধানী ছিল দক্ষিণ বিহারের পাটলীপুত্র

বাংলা অঞ্চলে ভাস্কর্য শিল্পের সূত্রপাতের সঠিক সময় নির্ধারণ করা কঠিন। যদিও নিম্ন গাঙ্গেয় বাংলা বা দক্ষিণ বাংলা কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব দুই শতক থেকে পোড়ামাটির শিল্পের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, তথাপি এমন কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নাই যা থেকে বলা যায় যে, এ অঞ্চলে ভাস্কর্য শিল্পটি ঐ সময় থেকে তার যাত্রা শুরু করেছিল। তারপরও পোড়ামাটির ভাস্কর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় দুই-তিন শতক পর্যন্ত সময়ে বাংলায় বিকশিত ভাস্কর্য শিল্পের চরিত্র নিরূপণে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বঙ্গীয় শিল্পকলা গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় বিকশিত শিল্পেরই একটি পরিবর্ধিত ধারা হিসেবে প্রতীয়মান। সুপরিচিত ভারহুত রীতিতে সামান্য রিলিফ ও ভাস্কযের্র সম্মুখভাগের সুস্পষ্ট প্রকাশ, সেই সাথে মূর্তির গায়ের মসৃর্ণতা উচ্চ গাঙ্গেয় পোড়ামাটির ভাস্কর্যে যেমন লক্ষণীয়, তেমনি নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকায়ও একই বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। কিন্তু সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় এই যে, উত্তর-মধ্য ভারতে পাথরে খোদাইকৃত মূর্তির অভাব না থাকলেও বাংলায় তা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।মনে হয় পাথরের উপর খোদাইকৃত শিল্প বাংলায় দেরিতে শুরু হয়েছিল এবং কাদামাটির সহজ লভ্যতা এ অঞ্চলের শিল্পিদের মডেলিং ও মোল্ডিংয়েই সন্তুষ্ট রেখেছিল।

তবে পাথর ব্যতীত কম শক্ত অন্য পদার্থের উপর খোদাই শিল্প সম্পর্কে তারা সম্ভবত জ্ঞাত ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চবিবশ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড় ও বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে আবিষ্কৃত কাঠ ও হাড়ের উপর খোদাইকৃত কিছু ক্ষুদ্র নমুনা এই বক্তব্যকে সমর্থন করে যে, কাঠ ও হাড়ের ওপর এবং সম্ভবত হাতির দাঁতের ওপরও খোদাই শিল্প বাংলার শিল্প জগতের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি ধারা হিসেবে বিদ্যমান ছিল।

কাঠ ও হাড়ের ভাস্কর্য কলকাতার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত বেশির ভাগ খোদাই শিল্পই ভেঙ্গে বা ক্ষয়ে গেছে। সেগুলির মধ্যে ৬টি কাঠের এবং ৪টি হাড়ের তৈরী মূর্তি। কাঠেরগুলির মধ্যে ২টি সরু যক্ষী মূর্তি, ১টি মাছ এবং অন্য আরেকটি লাঠি বা ছুরির হাতল। হাড়ের নমুনাগুলি ভাস্কর্যের গুরুত্ব বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে, এগুলিতে মূর্তি ও রিলিফ একই সাথে বিদ্যমান। ৫ সেমি ব্যাসের ১টি মেডালিয়নের উপর নর-নারীর প্রণয়রত চিত্র খোদিত, যা ভারতীয় শিল্প ইতিহাসে শূঙ্গ রীতি হিসেবে পরিচিত। নর-নারী যুগলের মাথার মুকুট ও পুঁতিসমৃদ্ধ ভারি অলংকারের ব্যবহার ভারহুতের মূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার তাদের ভরাট শারীরিক গঠন মনে করিয়ে দেয় মথুরার যক্ষ ও যক্ষিণীকে। আরেকটি আয়তকার ফলকের মধ্যে দেখা যায় গাছের নিচে যক্ষিণী ও দুজন অর্ঘ্যদাতার চিত্র। কিন্তু এর খোদাই কর্ম মেডালিয়নের তুলনায় অমসৃণ। একটি গোলাকার এবং অপরটি রিলিফের মধ্যে যথাক্রমে ৬ সেমি ও ১০ সেমি উচ্চতার ২টি যক্ষিণী মূর্তি তাদের কোমল মডেলিং ও সম্মুখভাগের দৃঢ়তার জন্য অনেকটাই সে যুগের পোড়ামাটির মূর্তির সাথে সাদৃশ্য প্রকাশ করে।

কিন্তু চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত ভাঙ্গা কিন্তু ব্যাপকভাবে অলংকৃত ৯ সেমি উচ্চতার ১টি পাখাওয়ালা সিংহমূর্তি ভিন্ন রীতির ছাপ প্রকাশ করে। এর বিষয়বস্ত্ত, খোদাই শৈলী এবং পদ্মভিত্তির উপর উপবিষ্ট সিংহ- এ সব কিছুই পশ্চিম এশিয় শিল্পরীতির সাথে এর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত বহন করে। এই রীতি উত্তর-পশ্চিম ভারত ও আফগানিস্থানের গান্ধার অঞ্চল থেকে দক্ষিণ বাংলায় আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ক্ষুদ্র মূর্তিগুলির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মঙ্গলকোট থেকে আবিষ্কৃত ফসিল হাড়ের ভাস্কর্যটি। সবচেয়ে কম ক্ষয়প্রাপ্ত ১৪ সেমি উচ্চতার এই শিল্পকর্মটিতে সামনের দিকে মুখ করে সংস্থাপিত হয়েছে একটি যক্ষ মূর্তি, যার নিচে অবস্থিত একটি যক্ষিণী মূর্তি। ভাস্কর্যের পেছনের দিকটি যক্ষীর পেছনের অংশ প্রতীয়মান করে। এই মূর্তিটি অন্যান্য হাড়ের মূর্তির তুলনায় বেশি কমনীয় এবং চুলের ভাঁজ ও অলংকারগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে খোদাইকৃত। যক্ষিণীর দেহভঙ্গী এবং অলংকারের স্বতন্ত্র কারুকাজ খোদাই যন্ত্রের দক্ষ প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়। এটিও শূঙ্গদের প্রাথমিক ভারতীয় রীতির একটি নিদর্শন, তবে সম্ভবত এটি খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকের অর্থাৎ কিছুটা পরবর্তী যুগের।

আদি প্রস্তর ভাস্কর্য  এখন পর্যন্ত বাংলায় আবিষ্কৃত এবং খ্রিস্টীয় প্রথম তিন শতকের নির্মিত প্রস্তর ভাস্কর্য অত্যন্ত কম। সাধারণ রীতির এই ভাস্কর্যগুলি উত্তর ভারতের শিল্প জগতে কুষাণদের উন্নত ধারার অন্তর্গত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এই শিল্পের কেন্দ্র ছিল মথুরা। এখানে সে সময়ে ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও জৈন- মূলত এই প্রধান তিনটি ধর্মের অনুসারীরা পূজার নিমিত্তে মূর্তি বানাতে গিয়ে এর সূচনা করেছিল। মথুরা রীতির মূর্তিগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মূর্তির সংখ্যা ও দৃঢ়তার প্রতি বাড়তি গুরুত্ব, প্রথম দিকের মূর্তিগুলির সম্মুখভাগের প্রাধান্য এবং লাল বেলে পাথরের ব্যবহার। বাংলায় প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন ২টি নমুনা লাল বেলেপাথরে নির্মিত এবং এতে কুষাণ রীতির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এটি বর্তমানে আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত। এদের একটি আবিষ্কৃত হয়েছে চন্দ্রকেতুগড় থেকে। এতে মথুরা অঞ্চলের প্রকান্ড কুষাণ বুদ্ধ-বোধিসত্ত্বের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পেয়েছে। যদিও মূর্তিটির উপরের অংশই শুধু অক্ষত রয়েছে, তথাপি এর দেহ গঠনের বলিষ্ঠতা এবং উপরের অংশের পরিধেয় বস্ত্র স্পষ্টভাবেই খ্রিস্টীয় দুই শতকের দিকে কুষাণ রীতিকে প্রকাশ করেছে।

চিত্র-১ সূর্যমূর্তি, কুমারপুর, রাজশাহী

এখানে বস্ত্র শুধু বাম কাঁধকে ঢেকে ডান কাঁধকে উন্মুক্ত রেখেছে; এর বাঁকগুলিও চিরন্তন মথুরা রীতির ছাপ বহন করেছে। ৫৫ সেমি উচ্চতার লাঠিসহ দন্ডায়মান অন্য মূর্তিটি মস্তকহীন একটি পুরুষ মূর্তি, যাকে কার্তিক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মহাস্থান থেকে আবিষ্কৃত এই মূর্তিটিও একই কুষাণরীতিতে তৈরি, তবে শৈলীগত দিক থেকে এটিকে আরেকটু পরবর্তী সময়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এটি খ্রিস্টীয় তিন শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত বলে ধরে নেওয়া যায়। মূর্তিটির খোদাই কাজ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। আর অলংকরণ হিসেবে দুপাশে ঝুলানো লুপের মতো গিট দেওয়া কোমরবন্ধ এবং স্বচ্ছ পরিধেয়ের মাঝে দৃশ্যমান অন্তর্বাসের চিহ্ন দুই শতক পরবর্তী সময়ের গুপ্ত ধ্রুপদী যুগের সাথে সাদৃশ্য প্রকাশ করে। একই কথা প্রযোজ্য এর দেহের গঠন ও পেশীবহুল বাহু এবং বাম হাতে ধরা লাঠির উপর আঙ্গুলের প্রাণবন্ত গঠনে।

কুষাণরীতির আরও তিনটি মূর্তি বাংলাদেশের রাজশাহীতে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরএ সংরক্ষিত আছে। এদের মধ্যে দুটি অমসৃণ-কঙ্করময় বেলে পাথরে নির্মিত সূর্যমূর্তি। এদের একটি পাওয়া গেছে রাজশাহীর কুমারপুর এবং অন্যটি নিয়ামতপুরে। অত্যন্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় বিদ্যমান কুমারপুরের সূর্য মূর্তিটি (চিত্র-১) একটি উঁচু বেদির উপরে সাত ঘোড়ার রথের উপরে দুজন পরিচারকের মাঝে দন্ডায়মান। রথ চালক অরুণ দন্ডায়মান সূর্য দেবতার সামনে উবু হয়ে আসীন। মূর্তিটির রুক্ষ খোদাই কাজ ও ঘোড়াগুলির গোলমেলে শারীরিক বৈশিষ্ট্য ইঙ্গিত দেয় যে, এটি একটি শিক্ষানবিশ শিল্পীর কর্ম যিনি কুষাণরীতির সূর্যমূর্তি নকল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। খোদাই কর্মের গুণাবলি বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, নিয়ামতপুরের নমুনাটিতেও খুব একটা উন্নতি সাধিত হয় নি। কণিষ্ক তাঁর মুদ্রায় যেভাবে দৃশ্যমান, যেমন- মূর্তিটির সামনের দিকে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, টুপি ও প্রলম্বিত টিউনিক (tunic) ইত্যাদি কুষাণ সূর্যের সাথে এর যোগ সূত্রতার ইঙ্গিত বহন করে। পশ্চিম বঙ্গের মালদা জেলার হাঙ্ক্রেইল থেকে প্রাপ্ত একই রীতির তৃতীয় নমুনাটি একটি দন্ডায়মান বিষ্ণুমূর্তি। কুষাণরীতির আরও কিছু বৈশিষ্ট্যসহ এই মূর্তিটিও আজানু প্রলম্বিত টিউনিক পরিহিত এবং কোমরে কোমরবন্ধ বাঁধা।

চিত্র-২ বিষ্ণুমূর্তি , মাকমইল বাঘমারাম, রাজশাহী

ঈষৎ হলুদবর্ণের বেলেপাথরে খোদিত বিষ্ণুমূর্তিটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অঙ্গ-সরঞ্জামাদির খোদাই কর্ম যথেষ্ট উন্নত ও কমণীয়, যা সূর্যমূর্তিসমূহে একেবারেই অনুপস্থিত। শৈলীগত দিক বিবেচনা করলে এটিকে খ্রিস্টীয় তিন শতকের শেষের দিক অথবা চার শতকের প্রথম দিকের বলে গণ্য করা যায়।

দুই থেকে চার শতকের মধ্যে নির্মিত উপরোক্ত ভাস্কর্যগুলি, যার অধিকাংশই কুষাণ রীতির অন্তর্ভুক্ত, স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, এ সময়ে প্রস্তর ভাস্কর্য তার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব ও কার্তিক মূর্তি বাংলার না হয়ে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার হওয়ারই বেশি সম্ভাবনা। এগুলির নির্মাণ সামগ্রী, লাল বেলেপাথর, শিল্পরীতি এবং আকৃতি ইঙ্গিত করে যে, এগুলি মথুরা অঞ্চল থেকে গঙ্গাস্রোতে বাহিত হয়ে বাংলার নদী তীরে এসে পড়েছে। অন্যদিকে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সূর্যমূর্তি দুটির রুক্ষ খোদাই কাজ ও আকৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, এগুলি স্থানীয় শিল্পিদের অদক্ষ হাতের শিল্পকর্ম। পরবর্তী যুগে নির্মিত হাঙ্ক্রেইলের বিষ্ণু মূর্তিটি ইঙ্গিত দেয় যে, ঐ সময়ের মধ্যে খোদাইকর্ম শৈলীটি স্থানীয় শিল্পি কর্তৃক কিছুটা হলেও রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গুপ্ত যুগের অন্তর্ভুক্ত পরবর্তী দুই শতকে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। এ সময়ে বাংলায় প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা প্রতীয়মান হয়।

গুপ্ত ভাস্কর্য  ভারতের মূর্তি শিল্পের দীর্ঘ ইতিহাসে গুপ্ত যুগকে (আনুমানিক ৩০০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) উপেক্ষা করা কঠিন। ভারতীয় ভাস্কর্যের শিল্প বিবেচনায় এই অধ্যায়টি ছিল শিল্প জগতের সর্বোচ্চ চূড়া। এই অবস্থানটি অবশ্য পরবর্তী ৫০০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে শিল্পিদের ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে।

গুপ্ত যুগে মূর্তির শারীরিক গঠন, আসন ভঙ্গি ও দেহের ভাঁজ এবং ভারতের প্রধান তিনটি ধর্মের দেব-দেবীর প্রতীকী বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই যে, এ যুগে মনুষ্য মূর্তিতে ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধ হয়, যা ছিল দুটি প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত (১) নমনীয়তা ও (২) রেখার কমনীয় প্রকাশ। তদুপরি, এযুগের মূর্তিগুলির বলিষ্ঠ অবয়ব ও সূক্ষ্ম প্রকাশভঙ্গী ভাস্কর্য  এগুলিকে বিশেষ শ্রীমন্ডিত করেছে, যাকে ধ্রুপদী আখ্যা দেওয়া যায়।

বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশ ব্যতীত এটি প্রায় প্রথম থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও সাংস্কৃতিক বিবেচনায় অঞ্চলটি কিন্তু সীমান্তবর্তী হিসেবেই রয়ে যায়। আবিষ্কৃত এ যুগের বেশ কিছু মূর্তির শৈলীগত দিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে কমপক্ষে চার-পাঁচ শতক থেকে এ শিল্পের একটি ধারাবাহিক বিকাশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ যুগের ভাস্কর্যগুলি দক্ষিণ বিহারের বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া গেছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, এগুলির নির্মাণ সামগ্রী গুপ্ত রাজাদের রাজধানী পাটলিপুত্র অঞ্চলের এবং এ থেকে অনুমিত হয় যে, এখান থেকেই শিল্পটি সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে বিস্তার লাভ করে।

গুপ্ত শাসকগণ ছিলেন একনিষ্ঠ বৈষ্ণব। প্রাথমিক গুপ্ত মূর্তিগুলির বেশির ভাগই বিষ্ণু অথবা বিষ্ণু সংশ্লিষ্ট অন্য যে কোন মূর্তি। এ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যটি বিহারের ভাগলপুরের শাহকুন্ড থেকে আবিষ্কৃত নরসিংহ মূর্তি। চতুর্ভুজ এই মূর্তিটির চার হাতে রয়েছে বিষ্ণুর চারটি অস্ত্র, যথা- শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। মূর্তির আকার ও আকৃতি সে যুগের গতাণুগতিক চিত্রেরই প্রকাশ ঘটায়। তবে মূর্তিটি যে কারণে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে তা হলো এর বলিষ্ঠ গোলাকার গঠন, যার সাথে রয়েছে দীর্ঘ কেশর বিশিষ্ট সবল কাঁধের উপর সিংহমস্তক। খোদাই কর্মের নিপুণতা এবং এর সাথে দেবতার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকরণ এবং সিংহের ক্রুদ্ধ মুখের বহিঃপ্রকাশ পূর্ববর্তী যুগের কুষাণ রীতি থেকে একে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে ফেলেছে।

বাংলার প্রথম দিককার গুপ্ত ভাস্কর্যটি সম্ভবত রাজশাহীর মাকমইল বাগমারা থেকে প্রাপ্ত ধূসর বেলে পাথরের উপর খোদিত বিষ্ণু (চিত্র-২) মূর্তিটি। ঈষৎ ভগ্ন মূর্তিটি সামনের দিকে মূখ করে দন্ডায়মান। যদিও এর মডেলিং এবং প্রতীকী বৈশিষ্ট্য পূর্বের গুপ্ত রীতি বহির্ভূত এবং এর নিগূঢ় গুণাবলি এতই নগণ্য যে, এর শৈলীকে কুষাণ ও গুপ্ত রীতির মাঝামাঝি এক ক্রান্তিলগ্ন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে গুপ্ত যুগের বেশ কিছু বিষ্ণু মূর্তির সাথে এই মূর্তিটিও সংরক্ষিত আছে। এরূপ অসম্পূর্ণ বিষ্ণু মূর্তি দিনাজপুরের কড়ইচেরচর থেকে পাওয়া গেছে। এখানেও দেব মূর্তিটি দন্ডায়মান অবস্থায় বিদ্যমান, এর চার হাতে রয়েছে পূর্বোক্ত চার ধরনের অস্ত্র। এর স৫ময়ে পঞ্চম শতকের বলে ধরা যায়। এরকমই আরেকটি দেবমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে খুলনা থেকে।

চিত্র-৩ বিষ্ণুমূর্তি, খৈরা, রাজশাহী

হলদে বেলেপাথরের ওপর খোদিত খুলনার বিষ্ণু মূর্তিটি যদিও একটি মিনিয়েচার (উচ্চতা ১৯ সেমি), তারপরও এতে স্পষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রকাশ পেয়েছে গুপ্ত রীতির মডেলিং। পূর্বের বিষ্ণু মূর্তির প্রস্তর খন্ডটি ডিম্বাকৃতির, অন্যদিকে পরেরটিতে পাথর কেটে গোলাকার করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পরবর্তী শতকে বাংলার শিল্পিরা প্রস্তর দ্রবাদি ব্যবহারে যথেষ্ট দক্ষ হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বগুড়ার নারহাটা থেকে প্রাপ্ত একটি এবং রাজশাহীর খৈরা থেকে পাওয়া আরেকটি মূর্তির মাঝে (চিত্র-৩)। নারহাটার বিষ্ণুটি খোদিত হয়েছে একটি গোলাকার অবকাঠামোর উপর, যাতে শিথিল দেহে মোলায়েম পেশীর মাঝে হালকা গতিময়তা পরিদৃষ্ট হয়। এটি পরবর্তীকালে বাংলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহূত কালো কষ্টি পাথরের হওয়ায় শিল্পির দক্ষতার প্রশ্নকে আরও জোরালো করে। খৈরা-র বিষ্ণু মূর্তিটি ধূসর বেলেপাথরের তৈরী, যা বর্তমানে অত্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান। এটি দন্ডায়মান অবস্থায় হলেও এর মূর্তিতত্ত্বে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। এখানে অস্ত্র-চিহ্নগুলিতে, যেমন- গদা ও চক্র, নরত্ব আরোপমূলক (anthropomorphic) বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে

এর পর থেকে এটি চিহ্নিত করা কঠিন হয় না, যে বাংলার এই প্রচলিত বিষ্ণু রীতি এই অঞ্চলে পরবর্তী পাঁচশত বছর ধরে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।

পাহাড়পুর ভাস্কর্য  বাংলার গুপ্ত ভাস্কর্যগুলি বেশিরভাগই প্রতীকী এবং এগুলির আকৃতি নির্ধারিত হয়েছে মধ্যদেশ বা মধ্য ভারতের পুরোহিত কর্তৃক বর্ণিত দেবতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণে।

চিত্র-৪ বুদ্ধমূর্তি, পাহাড়পুর

এতে শিল্পিদের কল্পনা কেবল একটি গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার থেকে আবিষ্কৃত এক সারি পোড়ামাটির প্যানেল থেকে বাংলার ভাস্করদের প্রচলিত ও কলাবিদ্যায় তাদের পছন্দের একটি সূক্ষ্ম আভাস পাওয়া যায়। এই বিহারের ভিত্তি-প্রাচীর থেকে আট শতকের শেষার্ধে নির্মিত মোট ৬৩টি প্রস্তর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। এই ভাস্কর্যগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দা বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তিমুখে নির্মিত ভাস্কর্যগুলির মতোই পাথরের স্লাবের উপর গভীর রিলিফসহ খোদাইকৃত।

শৈলীগত দিক বিবেচনা করে পাহাড়পুরের ভাস্কর্যগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি তৃতীয় গ্রুপের মূর্তিগুলি সম্ভবত বিহার নির্মাণকালে নির্মিত হয়েছিল। ফলে এদের সময়ে আট শতকের বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণ গ্রুপ, যমুনা, বলরাম ও শিব দ্বারা সবচেয়ে প্রকৃষ্টভাবে উপস্থাপিত প্রথম গ্রুপটি গুপ্ত যুগের ধ্রুপদী শিল্পের সাথে এর সম্পৃক্ততা প্রকাশ করছে।

পাহাড়পুর ভাস্কর্যের দ্বিতীয় গ্রুপটিকে ছয় থেকে আট শতকের মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। গুপ্ত ধ্রুপদী শিল্প মানুষের শুধু কাল্পনিক ফর্ম এবং নর-নারীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এতে আবেগ ও জীবন্ত অনুভূতির গুণাবলিও প্রকাশ পেয়েছে। এই শিল্পশৈলী মানবের অভিব্যক্তি প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে প্রকাশিত। আর এতে অন্তর্ভুক্ত হয় জাগতিক ও অধিজাগতিক অভিব্যক্তি। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত ধূসর বেলেপাথরের একক দন্ডায়মান বুদ্ধ মূর্তিটি (চিত্র-৪) পাথরে খোদাইকৃত আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের একটি উদাহরণ। এই মূর্তিটি বিখ্যাত সারনাথ বুদ্ধ মূর্তিগুলির মতো শৈলীগত বৈশিষ্ট্যে সম আসনের হলেও এটি আকারে কিছুটা বড়। হাঁটুর কাছে ঈষৎ ভাঁজ করা ডান পা-সহ বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো এই মূর্তিটি ফিনফিনে পোশাক ও অন্তর্বাস পরিহিত, যা শুধুমাত্র কাপড়ের সীমানা এবং গলার কাছে এর পাতলা ভাঁজ থেকে বোঝা যায়।

চিত্র-৫ বুদ্ধমূর্তি, রূপবান মুড়া, ময়নামতি

এর জ্যোতিশ্চক্র ও ঊর্ধ্ববাহু এবং সেই সাথে এর বিভিন্ন মুদ্রাভঙ্গি মুছে গেছে। সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ ফিগারের মূর্তিটিতে খোদাই কর্মের দক্ষতা ও অবনমিত নেত্রে প্রসন্ন মুখাবয়ব উপরোল্লিখিত আলোচিত বিষ্ণু মূর্তির তুলনায় এই বুদ্ধ মূর্তিটিকে আধ্যাত্মিকভাবে অনেক উন্নত করে তুলেছে। রাজশাহী জেলার বিহারৈল থেকে প্রাপ্ত এই নমুনাটি বঙ্গীয় খোদাই কর্মীদের কাজ না হয়ে বরং গঙ্গার উজানে বারাণসী থেকে উত্তরবঙ্গে প্রবাহিত হয়ে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। শৈলীগত দিক বিবেচনা করলে এটিকে পাঁচ শতকের শেষ অথবা ছয় শতকের প্রথম পর্যায়ভুক্ত করা যায়।

সম্প্রতি কুমিল্লা জেলার ময়নামতী দেবপর্বতের রূপবান মুরার প্রধান পূর্ব-মন্দির থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় প্রাপ্ত আরেকটি দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্ববহ (চিত্র-৫)। অত্যন্ত ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত প্রায় ২.৬ মিটার উচ্চতার বুদ্ধের এই অতিকায় মূর্তিটির শৈল্পিক সৌন্দর্য বাংলায় এযাবৎ প্রাপ্ত মূর্তিগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। অভয় মুদ্রা বা আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে আসীন উত্থিত ডান হস্তসহ ঈষৎ ফেরানো শারীরিক ভঙ্গিতে দন্ডায়মান মূর্তিটির প্লাস্টিক মডেলিং-এ সামান্য বৈচিত্রই পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে ঈষৎ উন্মুক্ত নেত্র ও মুখের মলিন হাসির সাহায্যে বাইরের জগতের প্রতি মুখায়ববের প্রাণবন্ততা সাত শতকের গুপ্ত পরবর্তী শৈলীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। উদাহরণ হিসেবে ময়নামতী বুদ্ধটির কথা বলা যায়, যা বিহারৈলের বুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মূর্তিটি স্থানীয় শিল্পির তৈরি হলেও তিনি ছিলেন সারনাথ ঘরানার দক্ষ শিল্পির মাধ্যমে শিক্ষিত। আরেকটি অসাধারণ উদাহরণ হলো বিহারের ভাগলপুরের সুলতানগঞ্জ থেকে সংগৃহীত ব্রোঞ্জের দাঁড়ানো বিশালকায় বুদ্ধ মূর্তি। এটি এখন বার্মিংহাম মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।

গুপ্ত-পরবর্তী ভাস্কর্য  সাত শতকে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় ভাস্কর্য নির্মাণ সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যায়। এছাড়া এই শিল্পের সংখ্যাধিক্যও পরিদৃষ্ট হয়। বিহারেও একই অবস্থা দেখা যায়। এই শতকের শিল্প পরিচিত হয়ে ওঠে গুপ্ত-পরবর্তী রীতি হিসেবে। এই রীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুপ্ত ধ্রুপদী রীতির তুলনায় আরও বেশি প্রাণবন্ত। এখানে মানব শরীরে আরও বেশি গতিময়তা সঞ্চারিত হয়েছে এবং দেহরেখায় প্রকাশ পেয়েছে ছন্দময় বাঁক। মুখাবয়বে সংযুক্ত হয়েছে আরও বেশি আবেগ। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলি এ যুগের ভাস্কর্যে ব্যাপক আকারে দেখা যায়। তবে এসব মূর্তিতে শৈলীগত পরিবর্তন, যেমন, গঠনশৈলী ও মানসিকতায়, তেমন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না।

চিত্র-৬ বিষ্ণুমূতি, খিয়ারমাহমুদপুর, দিনাজপুর

দেবতাদের মধ্যে বিষ্ণুর জনপ্রিয়তা এ যুগেও অব্যাহত থাকে। বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন জেলা থেকে এই মূর্তিগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে। সাত শতকের বাংলার বিষ্ণু মূর্তির মধ্যে মালদার গাজল থেকে প্রাপ্ত মূর্তিটির কথা উল্লেখ করতেই হয়। এটি এখন মালদা জাদুঘরে সংরক্ষিত। তবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত দিনাজপুর জেলার খিয়ারমাহমুদপুরের বিষ্ণু মূর্তিটি তুলনায় বিষয়গত এবং নৈপুণ্য শৈলীতে অনেক বেশি অগ্রসর (চিত্র-৬)। ১১০ সেমি উঁচু মূর্তিটি বিষ্ণুর প্রচলিত অস্ত্রসহ স্পষ্ট রেখায় খোদাইকৃত। এর গলায় প্রলম্বিত বনমালা একে বিশেষ সৌকুমার্য দান করেছে।

তবে অধিকতর আকর্ষণীয় শিল্পসৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পাটনা জাদুঘরে সংরক্ষিত বিহারের সিংভূমের বেনীসাগর বিষ্ণু মূর্তিটির মাঝে। ৪০ সেমি উঁচু এই মূর্তিটিতে গুপ্ত ধ্রুপদী রীতির বহু বৈশিষ্ট্যই বজায় রয়েছে। তবে এর মসৃণ ও সূক্ষ্ম প্লাস্টিক মডেলিং, সম্পূর্ণ গোলাকার ও সুনির্দিষ্ট গঠন, পার্শ্ববর্তী গদাদেবী ও চক্রপুরুষ এবং দীপ্তির ভারসাম্যতা একে বাংলার প্রাথমিক গুপ্ত মূর্তির তুলনায় অনেক বেশি উন্নত রূপ দিয়েছে। বিষ্ণু মূর্তির মধ্যে আকর্ষণীয় বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চৈতন্যপুরের বিষ্ণুর মাঝে।

চিত্র-৭ সূর্য/বিষ্ণু মূর্তি, দেওরা, বগুড়া

এই দেবমূর্তিটি প্রচলিত মূর্তিতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসহ পেশীবহুল শারীরিক অবকাঠামো নিয়ে প্রতীয়মান। আনুমানিক সাত শতকে নির্মিত এবং ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বিষ্ণুর একটি স্বতন্ত্র মূর্তি পাওয়া গেছে। এটি দেবতার পরশ্রীকাতরতার দিকটিকে উপস্থাপন করছে বলে বিশ্বাস করা হয়। ব্রাহ্মণ দেবতাদের মধ্যে বাংলায় সূর্য/বিষ্ণুর দুটি মূর্তি পাওয়া গেছে একটি চবিবশ পরগনা জেলার কাশীপুর থেকে এবং অপরটি বগুড়া জেলার দেওরা থেকে (চিত্র-৭)। এগুলি সাত শতকের গুপ্ত-পরবর্তী রীতির বিশুদ্ধ উদাহরণ। উভয় মূর্তিই সাত ঘোড়ায় টানা রথের সারথি ও সহযোগী নর-নারীসহ সুস্পষ্টভাবে খোদাইকৃত। মূর্তিদ্বয়ের দৈহিক গঠন, প্লাস্টিক মডেলিং এবং ধ্যানমগ্ন মুখাবয়ব তাদের পূজনীয় গুণাবলিকে প্রকাশ করে। বাংলার শিল্পিদের পছন্দনীয় কালো ব্যাসল্ট পাথরে নির্মিত ৯০ সেমি উঁচু কাশীপুর বিষ্ণু মূর্তিটি সম্ভবত এ অঞ্চলের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। দেওরার বিষ্ণু মূর্তিটি নীলাভ ব্যাসল্ট পাথরে খোদিত। কাশীপুরের সূর্য মূর্তিটি বর্তমানে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে এবং দেওরার মূর্তিটি রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

চিত্র-৮ মঞ্জুশ্রী মূর্তি, সালার, মহাস্থান

ইউরোপ ও আমেরিকার কোন কোন জাদুঘর প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় ভাস্কর্য সমৃদ্ধ। এ সকল ভাস্কর্যের মধ্যে ছয় ও সাত শতকের পূর্বভারতীয় ভাস্কর্যও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়ামের কথা বলা যায়। এখানে গভীরভাবে খোদাইকৃত কালো পাথরের গরুড়াসীন বিষ্ণুর একটি মূর্তিসহ (৮০ সেমি) এ যুগ ও এতদ্বঞ্চলের বেশকিছু বুদ্ধ মূর্তি সংরক্ষিত আছে। তবে বুদ্ধ মূর্তির আরও কিছু নমুনা, বিশেষ করে বিভিন্ন রকমের বোধিসত্ত্ব ও তারা মূর্তি, সংরক্ষিত আছে নালন্দা মিউজিয়াম ও ভারতীয় মিউজিয়ামে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অসাধারণ অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বগুড়ার মহাস্থানের নিকটবর্তী সালার থেকে প্রাপ্ত গিল্টি করা ব্রোঞ্জের মঞ্জুশ্রী মূর্তিতে (চিত্র-৮)। এটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত। সম্মুখভাগের মুখ সামান্য ঘোরানো অবস্থায় বিদ্যমান এই বোধিসত্ত্বটি তার ডান হাত দিয়ে আশীর্বাদ ও বাম হাত দিয়ে বরাভয় দান করছেন।ছন্দময় শরীরী বিহঙ্গ ও আধ্যাত্মিক সজীবতায় প্রাণবন্ত মুখাবয়বের এই মঞ্জুশ্রী মূর্তিটি এখন পর্যন্ত সাত-আট শতকের বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য।

চিত্র-৯ বিষ্ণুমূর্তি, কুমারপুর, রাজশাহী

আরেকটি আকর্ষণীয় ব্রোঞ্জ মূর্তি, যা একদা স্বর্ণপত্রে গিল্টি করা ছিল, পাওয়া গেছে কুমিল্লা জেলার দেউলবাড়ি থেকে। এটি ব্রাহ্মণ দেবী সর্বাণীর মূর্তি। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া এই মূর্তিটি সাত শতকের শেষার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় রাজত্বকারী খড়গ বংশীয় রাজা দেবখড়গের রানী প্রভাদেবী কর্তৃক উৎসর্গীকৃত। যদিও এই মূর্তিটি মঞ্জুশ্রী মূর্তির তুলনায় অনেকটাই অমসৃণ, তথাপি এই দুটি মূর্তি প্রমাণ করে যে, সাত শতকের শেষ দিকে বাংলায় ধাতু ঢালাই পদ্ধতিটি সূচিত হয়ে গিয়েছিল।

সাত শতকের প্রথম দিকে বাংলায় পাথর এবং ধাতু ছাড়াও নির্মাণ শিল্পের মাধ্যম হিসেবে স্টাকো ভাস্কর্যের ব্যবহার শুরু হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ মঠের নিকটে রক্তমৃত্তিকা বিহারে খননকার্যের ফলে অত্যন্ত জীর্ণ অবস্থায় বেশ কিছু স্টাকো ভাষ্কর্ষ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে মানুষের মাথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি স্টাকো ভাষ্কর্ষের মুখাবয়বে কমনীয় হাসি সহযোগে  নালন্দা থেকে প্রাপ্ত সমসাময়িক একই রকম স্টাকো মুখের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মূর্তিটি এখন পশ্চিমবঙ্গ প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী মাৎস্যন্যায়ের প্রায় ১০০ বছর, বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের মতো ব্যয়বহুল মাধ্যমটিতে পৃষ্টপোষকতার অভাব দেখা দেয়। ফলে সাত শতকের শেষাংশ থেকে আট শতকের প্রথমাংশ পর্যন্ত পাথর অথবা ধাতু নির্মিত তেমন উল্লেখযোগ্য ভার্স্কয বাংলায় পাওয়া যায় না। তবে বিহারের কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকায় এ সময়ে দেব-দেবীর খোদাইকৃত মূর্তির কাজ হয়েছে।

আট শতকের মাঝামাঝিতে পাল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং এ ধর্মের মহাযান মতবাদটি তাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ধর্মপাল বাংলা ও বিহারে বেশকিছু মন্দির ও মঠ নির্মাণ করেন। দেবপাল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দার মতো পুরাতন বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলিতে নব যুগের সূচনা করেন। এই যুগের বৌদ্ধ মঠগুলি ছিল ভারতীয় জ্ঞান ও পান্ডিত্যের ভান্ডার এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের বিশ্ববিদ্যালয়। কিছু কিছু মঠের পাঠক্রমে মূর্তি নির্মাণ পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এজন্য প্রয়োজনীয় কর্মশালা ও অগ্নিকুন্ডের সংস্থান ছিল।

চিত্র-১০ মনসা মূর্তি ঘাটনগর পোরসা, রাজশাহী

পাল ও সেন যুগে পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে ৪০০ বছরেরও অধিককাল ধরে এই শিল্পটি বিকাশলাভ করে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে এই শিল্প কখনও একই ধারা বজায় রাখেনি এবং ‘পাল-সেন স্কুল’ হিসেবে পরিচিত এই স্কুলের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবর্তনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। কালপর্ব ব্যতীত স্থানীয় চিন্তা-চেতনা ও গঠনশৈলীও এই শিল্পের উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল এর ব্যাপক উৎপাদনশীলতা- পাথর ও ধাতু উভয় মাধ্যমেই। বৌদ্ধ এবং সেই সাথে ব্রাহ্মণ দেব-দেবীর সংখ্যাধিক্য এবং মূর্তি ভাষ্কর্ষের শৈল্পিক ছোঁয়া ও অলঙ্করণের আধিক্য বাড়তে থাকে। মূর্তি নির্মাণে বাধ্যবাধকতার সূচনা হয় মূর্তিতাত্ত্বিক বর্ণনার অন্তর্ভুক্তিতে। এতসব নিয়ম-কানুন থাকা সত্ত্বেও শিল্পী তার নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে ভোলেন নি; আর তা তারা করেছেন উদ্দেশ্য সাধনে কঠোর শ্রম দিয়ে এবং চোখে যতটুকু ধরা পড়ে, কাজকে অন্তত ততটুকু নিখুঁত করে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, পাল ও সেন যুগের কোন দুটি বুদ্ধ বা বিষ্ণু মূর্তি কখনোই একেবারে এক রকম হয় নি, যদিও এদের শৈলীগত দিক ছিল সাদৃশ্যপূর্ণ। এমনকি মূর্তির খুঁটিনাটিতেও বৈচিত্র্য চোখে পড়ে।

প্রাপ্ত ভাস্কর্য থেকে এটি উপলব্ধি করা সম্ভব যে, নয় শতকের প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব ভারতের পাল এবং গঙ্গা যমুনা উপত্যকার গুর্জর-প্রতীহারদের সময় গুপ্ত যুগের মূর্তি শিল্পের পুনরুত্থান ঘটে। সতেরো শতকের ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের তিববতীয় ঐতিহাসিক লামা তারনাথ এর বক্তব্যে এর প্রমাণ মেলে। তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ধীমান ও তার পুত্র বীতপাল ঢালাই ধাতু শিল্প, খোদাইকর্ম এবং চিত্রাঙ্কণে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তারা ধর্মপাল ও দেবপালের সমসাময়িক এবং তারা নাগ শিল্পরীতি অনুসরণ করতেন। এই রীতিটি কুষাণ পরবর্তী ও প্রাক-গুপ্ত যুগে মথুরা অঞ্চলে বিকাশলাভ করেছিল। এ অঞ্চলেই কুষাণ যুগের অভিজ্ঞতা থেকে গুপ্ত ধ্রুপদী শিল্প রীতিটি প্রথম বিকাশলাভ করে। ধীমান ও বীতপাল কর্তৃক আট শতকের শেষ ও নয় শতকের প্রথম দিকে পূর্ব ভারতীয় শিল্পে গুপ্ত ধ্রুপদী শিল্পের পুনরুত্থান ঘটানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

চিত্র-১১ লক্ষ্ণী-নারায়ণ, এহনাইল, পশ্চিম দিনাজপুর

বিহার যেহেতু প্রায় প্রথম থেকেই পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই বাংলার ভাস্কর্যের সাথে সাথে এখানকার ভাস্কর্যগুলিকেও বিবেচনায় নেওয়াটা জরুরি। পাল ভাস্কর্যের সর্ব প্রাচীন নমুনাটি ধর্মপালের ২৬ রাজ্যাঙ্কের (আনুমানিক ৭৭৫-৮১০ খ্রি), যা বিহারের গয়া থেকে পাওয়া গেছে। দেবপালের সময়ের তারিখ সম্বলিত বলরামের দুটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য ও তারার একটি প্রস্তর ভাস্কর্য এ অঞ্চল থেকেই পাওয়া গেছে। নালন্দা প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর থেকে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের যে ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে, তা দেবপালের সময়ের। এগুলি নয় শতকে পাল ভাস্কর্যের শৈলীগত রীতি প্রকাশ করে। এই শতকের পর থেকে বিহার ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে খোদাইকৃত ও ঢালাইকৃত ভাস্কর্য নির্মিত হতে থাকে, যা এই স্কুলের শৈলীগত উন্নয়ন নিরীক্ষা করা সহজ   করে দিয়েছে।

নয় থেকে বারো শতকে পাল-সেন ভাস্কর্য শিল্পরীতিতে মোটামুটি গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার শিল্পের প্রায় অনুরূপ, যদিও এতে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্যেরও অভাব ছিল না। উভয় অঞ্চলে শতক ব্যাপী এই শিল্প বিকাশের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল গুপ্ত রীতির মতো গোলাকার মনুষ্য ভাষ্কর্ষ তৈরির বিষয়টি অব্যাহত রাখা। তবে ভাস্কর্য অলঙ্করণ ও সহযোগী ভাস্কর্ষের সংখ্যাধিক্য গুপ্ত যুগ থেকে এই যুগের ভাস্কর্যগুলিকে আলাদা করেছিল। এই অলঙ্করণ চিহ্নিত করা যায় বিভিন্ন মোটিফ, দন্ডায়ামান স্তম্ভ, পেডেস্টল ও মনুষ্য শরীরে অলঙ্করণ এবং সহযোগী ভাস্কর্ষের সংখ্যাধিক্য এবং কখনও কখনও পার্শ্বদেবতার মতো কেন্দ্রীয় ফিগারের চার পাশে নির্মিত ভাস্কর্ষগুলির অলঙ্করণের মাঝে। পেডেস্টালে রত্ন অভিক্ষেপের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আসনের জন্য ব্যবহূত পদ্মের উপস্থাপনা পরবর্তী শতকের ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। এগুলি ছিল সাধারণ প্রচলিত রীতি, যা নয়-দশ শতকের মূর্তিগুলিকে এগারো-বারো শতকের মূর্তিগুলি থেকে পৃথক করে।

চিত্র-১২: বুদ্ধমূর্তি , ঝেরয়ারী, চট্টগ্রাম

ধারাবাহিক ক্রম অনুসারে পাল ভাস্কর্যের তৃতীয় গ্রুপের মধ্যে প্রথম প্রধান উদাহরণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় ইতিমধ্যেই উল্লিখিত পাহাড়পুরের বৌদ্ধ মন্দিরের ভিত্তিতে খোদিত পাথরের রিলিফগুলিকে।

এই গ্রুপের রিলিফগুলি কৃষ্ণের কিংবদন্তীসহ বহু বিষয় উপস্থাপন করে। তবে এই কৃষ্ণ ব্রাহ্মণ ধারার কেউ নন, বরং এই কৃষ্ণ বাংলার ঘরে ঘরে জনপ্রিয় যশোদার শিশু পুত্র, গোপীর প্রেমিক ও অসীমসাহসী ঐশ্বরিক বীর। এই গ্রুপের ভাস্কর্যগুলিতে মহাভারত ও রামায়ণ থেকেও দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। যদিও এগুলিতে গুপ্তোত্তর রীতির উদাহরণ হিসেবে গণ্য প্রথম গ্রুপের মতো ভাস্কর্যগুলি ততটা উৎকৃষ্ট মানের ও ছন্দময়ভাবে বিন্যস্ত হয় নি। অধিকাংশ প্যানেলেই বর্ণনাধর্মী ও নর-নারীর কর্মজীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব দৃশ্যে শিল্পি তার নিজের চিন্তা-চেতনাকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবলীল হয়েছেন, অনেকটা একই স্থান থেকে প্রাপ্ত জনপ্রিয় পোড়ামাটির ফলকের রীতি এখানে ফুটে উঠেছে। এই ভাস্কর্যগুলি যদিও পাল স্কুলের প্রথম দিকের সংস্করণ, তবুও এগুলি তাদের বিষয়বস্ত্ত ও জনপ্রিয় অভিব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্র। তবে এই নমুনাগুলি পরবর্তী কয়েক শতকে দুর্লভ হয়ে ওঠে। তখন বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের অনুসারীদের পূজার প্রয়োজনে নির্মিত মূর্তিসমূহ প্রাধান্য পায় এবং মূর্তিতাত্ত্বিক চরিত্রের দৃশ্যপট দখল করে নেয়।

চিত্র-১৩ বুদ্ধমূর্তি , ময়নামতী

নালন্দা ছিল পাল শিল্পের প্রধান কেন্দ্র, যেখানে নয় শতক থেকে সমগ্র পাল যুগ ব্যাপী পাথর ও ধাতুর অসংখ্য বৌদ্ধ মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এই মূর্তিগুলির প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হলো এগুলির পেডেস্টল ও মাথার পিছনে জ্যোতিশ্চক্র। পাল ধারার প্রাথমিক পর্যায়ের এই পেডেস্টলগুলি মূলত দুই ধরনের- সিংহাসন ও ত্রিরথ। নালন্দার ব্রোঞ্জের পঞ্চিকা ও হারিতি মূর্তি দুটি দেবপালের সময়ের। এগুলি সিংহাসনে আসীন অবস্থায় বিদ্যমান। অন্যদিকে দক্ষিণ বিহার থেকে প্রাপ্ত একই সময়ের বলরাম মূর্তি দুটি, যার একটি পাওয়া গেছে নালন্দা থেকে এবং অন্যটি কুর্কিহর থেকে, ত্রিরথের উপর দন্ডায়মান। আড়াআড়ি দন্ডের উপরে স্থিত বলরাম দুটির মাথার উপরে সাপের সাতটি ফনা ছত্রাকারে বিদ্যমান। কিন্তু অন্য মূর্তিতে প্রচলিত রীতিতে এই স্থানটি দখল করেছে চারপাশে আগুনের মোটিফসহ ডিম্বাকৃতির জ্যোতিশ্চক্র। মূর্তির পাশে উল্লম্ব দন্ডগুলি গজ-সিংহ দ্বারা শোভিত। মাঝে মাঝে রাজহংসও দেখা যায়। এ ধরনের পেডেস্টল ও জ্যোতিশ্চক্রগুলি মোটিফ ও বিষয় উভয় দিক থেকে অবধারিতভাবে গুপ্ত ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। কিন্তু এগুলি এখানে অনেক বেশি শৈল্পিক। পরবর্তী শতকগুলিতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে এগারো ও বারো শতকে, এগুলি আরও বেশি চলিতরীতি নির্ভর ও কিম্ভূতকিমাকার হয়ে ওঠে।

পাল যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে ভাস্কর্যগুলি গুপ্ত রীতির প্লাস্টিক মডেলিং ও বর্ণালি রেখার হালকা ছোঁয়া এবং সেই সাথে মাংসপেশীর সংবেদনশীলতা বজায় রাখে। কখনও কখনও গভীর বিশ্লেষণধর্মী যোগী দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বর্গীয় হাসির ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়।

উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত ভালভাবে সংরক্ষিত উপরিল্লিখিত বৌদ্ধ দেবতা পঞ্চিকার ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যায়। মূর্তিটিতে পেডেস্টল ও জ্যোতিশ্চক্রের অসাধারণ সমানুপাত ভারসাম্যে এই সবগুলি বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত। মূর্তিটি বর্তমানে দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। কুর্কিহরের বলরাম মূর্তিটিও তার সাবলীল ভঙ্গি ও সংবেদনশীল প্লাস্টিক মডেলিংয়ের জন্য অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

চিত্র-১৪ শিব-নটরাজ , মানিয়ারি, নওগাঁ

বাংলা থেকে এখন পর্যন্ত এই সময়ের তুলনামূলকভাবে অল্প কিছু ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এর বেশিরভাগই বিষ্ণুমূর্তি। দুটি ব্রোঞ্জ বিষ্ণু মূর্তিতে একই রকমের ডিম্বাকৃতির জ্যোতিশ্চক্র ও সামনের দিকে ভঙ্গি দিয়ে দাঁড়ানো কম্পোজিশন লক্ষ্য করা যায়। একটি আবিষ্কৃত হয়েছে রাজশাহীর কুমারপুর থেকে (চিত্র-৯), যা এখন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত (২৬ সেমি) এবং বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত অন্যটির প্রাপ্তিস্থান অজানা। তবে দিনাজপুরের অগ্রদিগুন থেকে প্রাপ্ত উড়ন্ত গরুড়ের উপর আসীন বিষ্ণু মূর্তিটি আরও কৌতূহলোদ্দীপক। আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত কালো ব্যাসল্ট পাথরের উপর খোদাইকৃত মূর্তিটিতে দেবতা অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে কোমল ও সংবেদনশীলভাবে দৃশ্যমান। আর এ কম্পোজিশনটি ভারসাম্যপূর্ণ হয়েছে মানুষের আদলে শৈল্পিকভাবে ছড়ানো পাখির ডানার সংযোজনে।

দেবপালের ঠিক পরপরই যেসকল পাল রাজা শাসন করেন তাদের শাসনামলে পাল শিল্প ক্রমাগত উন্নয়ন বজায় রাখে। শুধু বিহারেই নয়, বাংলায়ও খোদাই ও ঢালাইকৃত মূর্তি নির্মাণের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দশ শতকে যেসকল ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে বৌদ্ধ মূর্তির সাথে অনেক ব্রাহ্মণ্য মূর্তিও অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে প্রতীকী চিহ্ন সম্বলিত বেশ কিছু মনসা মূর্তির কথা বলা যায়, যেগুলি এ অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত পশ্চিম দিনাজপুরের তপন থেকে প্রাপ্ত একটি এবং রাজশাহীর ঘাটনগর পোরসা থেকে প্রাপ্ত আরেকটি মূর্তি (চিত্র-১০) নতুন ধরনের কম্পোজিশনের অবতরণা করে। একই কথা প্রযোজ্য একই জাদুঘরে সংরক্ষিত লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তিটির ক্ষেত্রে। এটির আসন ভঙ্গি উমা-মহেশ্বরের আসন ভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। পশ্চিম দিনাজপুরের এহনাইল থেকে প্রাপ্ত লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগল মূর্তিটি (২৪.৪ সেমি) (চিত্র-১১) তাদের কমনীয় আলিঙ্গন ভঙ্গির জন্য শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হিসেবে প্রতীয়মান। তুলনমূলকভাবে কলকাতা প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়া জেলার বোরাম থেকে প্রাপ্ত উমা-মহেশ্বর মূর্তিটি (৩৫ সেমি) সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এখানেও দেব-দেবী আলিঙ্গনরত, তবে স্বর্গীয় দম্পতি-সুলভ বিচ্ছিন্ন ভঙ্গিমায়। তবে এটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর দ্বিবিভাজীত স্টাইল।

অন্যদিকে গুপ্তোত্তর রীতিতে মহেশ্বর দন্ডায়মান, কিন্তু উমা প্রসারিত নেত্রে স্থানীয় রমণীর ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। সমগ্র পাল-সেন যুগ ধরে বাংলার ভাস্কর্যে স্থানীয় জনপ্রিয় রীতি সমুপস্থিত। পশ্চিমবঙ্গ প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের আরেকটি আকর্ষণীয় সংগ্রহ হলো পশ্চিম দিনাজপুরের কালিকামুরা গ্রাম থেকে সংগৃহীত কার্তিক মূর্তিটি। এখানে ময়ূরের উপর উপবিষ্ট দেবতাকে এমন কমনীয়, সজীব ও জীবন্তভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে মনে হয় যেন কালো পাথরের ওপর নয়, এটি নির্মিত হয়েছে মাটি দিয়ে।

দশ শতকের বাংলা পাথর ও ব্রোঞ্জের বৌদ্ধ ভাস্কর্যের জন্যও সমৃদ্ধ। তবে সম্ভবত পাথরের চেয়ে ব্রোঞ্জই ব্যবহূত হয়েছিল বেশি। কলকাতা প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত নদীয়া জেলার বড়িয়ার ভূমিস্পর্শী বুদ্ধের প্রস্তর মূর্তিটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় (৬৯ সেমি)। এখানে বুদ্ধ উপস্থাপিত হয়েছেন গুপ্তোত্তর যুগের আনুমানিক আদলে, উপরের দিকে পাঁচটি ধ্যানী বুদ্ধ ও দুপাশে দুটি বোধিসত্ত্বসহ যথোপযুক্ত জ্যোতিশ্চক্র মন্ডিত হয়ে। তবে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, স্তূপের ন্যায় বস্ত্ত শীর্ষায়িত মোচাসদৃশ উষ্ণীষ। বুদ্ধ মস্তকের এই অস্বাভাবিক গঠন পাল শিল্পরীতির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা পরবর্তীকালে বাংলা থেকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে বিস্তার লাভ করেছে।

যদিও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে, তথাপি এর প্রধান কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ পূর্ব বাংলায়, যা সমতট বা হরিকেল নামে পরিচিত। এই অঞ্চলটি আট শতকের মাঝামাঝি থেকে এগারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যথাক্রমে দেব ও চন্দ্র রাজবংশ কর্তৃক শাসিত হয়। এই দুই বংশের রাজারাই বৌদ্ধ ধর্মানুসারী ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে কুমিল্লা জেলার ময়নামতী-দেবপর্বত এলাকা থেকে বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠ ও স্তূপ এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির ফলক এবং প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই প্রত্নস্থলের বেশির ভাগ মূর্তি সাধারণত ছোট সাইজের এবং এগুলির স্থানিক চেহারা জনপ্রিয় শিল্পরীতির পরিচায়ক।

চিত্র-১৫ সদাশিব, নিয়ামতপুর, নওগাঁ

চট্রগ্রাম থেকে ১৬ কিমি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত ঝেওয়ারী গ্রাম থেকে ৬১টি ব্রোঞ্জ বুদ্ধ মূর্তির বিশাল এক ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তিগুলি সাত শতকের শেষ থেকে এগারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত। তবে বেশিরভাগই দশ শতকের। যদি পাল রাজা দেবপালের সময়ে নির্মিত নালন্দার নয় শতকের প্রথম দিকের ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলিকে প্রথম পর্যায়ের ধরা হয়, তাহলে ঝেওয়ারীরগুলিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্রোঞ্জ বুদ্ধ বলা যেতে পারে। ঝেওয়ারী বুদ্ধগুলি মূলত তিনটি স্বতন্ত্র ভাগে বিভক্ত। প্রথম ধরনেরটি হলো স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত আত্নরক্ষার ভঙ্গিতে দন্ডায়মান বুদ্ধ, যা অভ্রান্তভাবেই সারনাথ রীতির। দ্বিতীয় ধারার বুদ্ধগুলি উপরোল্লিখিত ময়নামতী বুদ্ধের সেই একই জনপ্রিয় রীতির। তৃতীয় ধারাটিতে চট্রগ্রাম শিল্পিদের প্রতিভার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর প্রতীয়মান। সর্বোৎকৃষ্ট বুদ্ধ মূর্তি এদের মাধ্যমেই ঢালাইকৃত বা খোদিত হয়েছিল। এই রীতিতে বুদ্ধ ভূমিস্পর্শী ভঙ্গিমায় আসনের উপর আসীন। এই ধারার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনাটিতে সুনির্দিষ্ট শারীরিক ও শৈলীগত বৈশিষ্ট্য তাদের নালন্দা প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে এদের সম্পূর্ণ আলাদা করেছে। যেখানে নালন্দার ব্রোঞ্জ বুদ্ধগুলির দুটি কাঁধই কাপড়ে আবৃত, সেখানে ঝেওয়ারী বুদ্ধগুলির ডান কাঁধ অনাবৃত (চিত্র-১২)। নালন্দা মূর্তিগুলি সুতার মতো সরু বস্ত্র দ্বারা মোড়া হলেও ঝেওয়ারী মূর্তিগুলি স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত। তদুপরি উন্নত নাসা, ধনুকের মতো বাঁকা ভুরু, অর্ধনিমিলিত নেত্র ও সংবেদনশীল ঠোঁট ঝেওয়ারী বুদ্ধগুলিকে স্বাতন্ত্রীমন্ডিত করেছে। কপালের উপরে চুলের আলাদা একটি স্তর, বস্ত্রের সুস্পষ্ট দ্বি-ভাঁজ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে প্রতীয়মান করে। সব মিলে এই বুদ্ধগুলি প্রথাগত ও শৈলীগত উভয় দিক থেকে একটি নতুন রীতির উপস্থাপন করে।

তবে এগারো শতকের প্রথম দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধ মূর্তিটি ময়নামতী-দেবপর্বত থেকে পাওয়া গেছে (চিত্র-১৩)। ব্রোঞ্জের এই বিশালাকায় মূর্তিটিতে বোধিসত্ত্ব-বজ্রসত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। বসা অবস্থাতেও এই মূর্তিটির উচ্চতা ১.৫ মিটার। এ যাবৎ পূর্ব ভারত থেকে আবিষ্কৃত ধাতব মূর্তিগুলির মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় ও সম্ভবত সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত। শরীরতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, হাতের ভারসাম্যময় অবস্থান এবং সঠিক জ্যামিতিক কম্পোজিশন সম্বলিত বজ্রসত্ত্ব মূর্তিটি পূর্বের নালন্দা ও ঝেওয়ারী অভিজ্ঞতাকে সংমিশ্রিত করে অসাধারণভাবে নির্মিত। দেহ, অলংকার, মাথার মুকুট ও ঝুলানো কানের দুলসহ মূর্তির অন্যান্য অংশের প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়া এই মূর্তিটি ধ্রুপদী ও মধ্যযুগীয় মূর্তির ঠিক মাঝামাঝিতে অবস্থান নিয়েছে। এটি সন্দেহাতীতভাবেই বাংলার মূর্তি শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একই স্থানের প্রমাণ সাইজের আর একটি সমসাময়িক ব্রোঞ্জ বোধিসত্ত্ব-অবলোকিতেশ্বর মূর্তির খন্ডিত মস্তক থেকে মনে হয় যে, ময়নামতীর শিল্পিরা ফাঁপা মূর্তি নির্মাণে সুদক্ষ ছিলেন।

চিত্র-১৬ কার্তিক, মাহাতোর, পশ্চিম দিনাজপুর

যেখানে নয় ও দশ শতকের পাল ভাস্কর্যে গুপ্ত ধ্রুপদী রীতির প্রভাব লক্ষণীয়, সেখানে এগারো শতক থেকে বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের দেবী মূর্তিতে সহযোগীদের নতুন বৈশিষ্ট্য, পেডেস্টল ও জ্যোতিশ্চক্র নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাদের শৈলীগত পরিবর্তন সূচিত করে। যদিও পূর্ববর্তী দুটি শতকের প্রচলিত রীতি থেকে তারা সরে আসে নি, তথাপি নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজনে এটি শিল্প ঐতিহাসিকদের কাছে ‘মধ্যযুগীয়’ রীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠে। এই রীতির ভাস্কর্যগুলিতে প্রধান বিষয়বস্ত্ত অপেক্ষা অলংকরণের উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়, বিশেষ করে এগারো ও বারো শতকে নির্মিত মূর্তিগুলিতে। ফলে এগুলিতে সহযোগী ভাষ্কর্ষ বৃদ্ধি, গভীরভাবে খোদাইকৃত অলংকরণ, পেডেস্টল ও জ্যোতিশ্চক্রে মোটিফের আধিক্য প্রভৃতি ক্রমশ তাদের উপস্থিতি বাড়াতে থাকে।

এগারো শতকের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যগুলি মধ্যযুগের প্রাথমিক পর্যায়ে নিপুণ ঢালাইকর্ম ও খোদিত ভাষ্কর্ষ এবং অলঙ্করণের প্রকাশ ঘটায়। উদাহরণ হিসেবে পঞ্চরথ পেডেস্টল ভিত্তিতে দ্বৈত পদ্মের ওপর দন্ডায়মান রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় মুকুট পরিহিত বুদ্ধ মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। চারপাশে আগুনের আভা সম্বলিত জ্যোতিশ্চক্র সম্বলিত এই মূর্তিটি মধ্যযুগীয় বাংলায় প্রচলিত রীতিকে প্রকাশ করছে। যেটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো দক্ষিণ বিহারে তৃতীয় বিগ্রহপালের সময় উদ্ভাবিত বুদ্ধ রীতিটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তির জন্যও রীতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বর্তমানে আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ও উত্তর বঙ্গের রংপুর থেকে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের দুটি বিষ্ণু মূর্তি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। উভয় মূর্তিই এগারো শতকের। কিন্তু তারপরও ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বিক্রমপুরের সোনারং থেকে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের বিষ্ণু মূর্তিটি বেশি আকর্ষণীয়। কেন না এখানে আরো নিঁখুত ও জটিল অলংকরণ সংযুক্ত হয়েছে, যা পূর্ব ভারতের অন্যান্য সুনিপুণ ধাতব মূর্তিতেও দুর্লভ।

যদিও বাংলার ভাস্কর্যের বিকাশ সবচেয়ে ভালভাবে বোঝা যায় বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থান থেকে আবিষ্কৃত বুদ্ধ ও বিষ্ণু মূর্তির সাহায্যে, তথাপি এগুলির অধিকাংশই একক কম্পোজিশনাল রীতি উপস্থাপন করে, আর তা হলো সম্মুখের উল্লম্ব ফর্ম। তবে অন্যরকম রীতির মূর্তিও আছে। যেমন বৌদ্ধ দেবী মারীচী বা হিন্দু দেবী মহীষাসুরমর্দিণী। এগুলির ফিগার কৌণিক আকারে উপস্থাপিত। আবার যশোদা ও কৃষ্ণ, ‘সদ্যোজাত’ হিসেবেও পরিচিত, এবং অনন্তশ্যায়ী-বিষ্ণু বা অনন্ত সর্পের উপর শায়িত বিষ্ণু অনুভূমিক কম্পোজিশনের উদাহরণ। এর চেয়েও নমনীয় ভঙ্গিতে লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবী বজ্রতারা। মূর্তিটি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। গুণগত মানের বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবশ্য নৃত্যরত গণেশ ও শিব-নটরাজ মূর্তি। আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রাজশাহীর হাজীনগর থেকে প্রাপ্ত প্রথমোক্তটির একটি নমুনায় খোদাই দক্ষতার সাথে ছন্দোময় মুভমেন্ট এবং রেখার মসৃণ সংমিশ্রণ চোখে পড়ে।

তারপরও বিষয়বস্ত্ত ও কারিগরি দক্ষতা উভয় ক্ষেত্রেই শিব-নটরাজের মূর্তিটি বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। অধিকাংশ শিব-নটরাজ (চিত্র-১৪) মূর্তিই ঢাকা জেলা এবং বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তরের ত্রিপুরা থেকে পাওয়া গেছে। এগুলি দক্ষিণ ভারতের নটরাজের তুলনায় সমান উজ্জ্বল। এখানে শিব তাঁর বাহন বৃষের উপর নৃত্যরত, অন্যদিকে তাঁর বাহন বৃষও প্রভুর নৃত্যের ছন্দে নৃত্যরত ভঙ্গিমায়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের নটরাজ তান্ডবে মত্ত। তাঁর পায়ের নিচে দলিত হচ্ছে অপ্সরারূপী অশুভ প্রেতাত্মা। বাংলায় শিব-নটরাজের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো লিপিতাত্ত্বিকভাবে নটেশ্বর নামে অভিহিত মূর্তিটি। এটি এখন ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। ঢাকার রামপালের নিকটবর্তী শংকরবন্ধ থেকে আবিষ্কৃত বিশাল মূর্তিটি প্রসারিত দশ হাতে অস্ত্র ধরা অবস্থায় নৃত্যরত ভঙ্গিমায়। এর পশ্চাৎ দেশ ও পেডেস্টল-ও বিষয়গত দিক থেকে উন্নত। এই দুটি শিব-নটরাজ ও গণেশের নৃত্যরত মূর্তির মধ্য দিয়ে বাংলার শিল্প বারো শতকে প্রবেশ করে।

পাথর ও ব্রোঞ্জ নির্বিশেষে বারো শতকের মূর্তিগুলি পূর্ব ভারতীয় ভাস্কর্যের শেষ ও চুড়ান্ত পর্যায়। এই পর্যায়ের রীতিটি এগারো শতকের রীতির বর্ধিত, বিস্তারিত ও দক্ষতার চরম নির্দশন, তবে এতে একটি গুণগত পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই পরিবর্তন প্রধানত রাজনৈতিক, যা বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এ শতকের প্রথম দিকে কর্ণাটক থেকে আগত সেনরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাল শাসকদের বিতাড়িত করে। তারা তাদের সাথে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোড়া সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় রীতি নিয়ে আসে। ফলে এ যুগে পৌরাণিক দেবমূর্তি যেমন- বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূর্য ও গণেশ ব্যাপকভাবে নির্মিত হয়। এছাড়াও কিছু মাঝারি মানের দেবমূর্তি যেমন- কার্তিক, সরস্বতী, মনসা ও গঙ্গাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একদা দেবতাদের মধ্যে প্রধান ব্রহ্মাকেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। এই সকল মূর্তিসহ মহাযান-তন্ত্রযান বৌদ্ধ দেব-দেবীও নির্দিষ্ট কম্পোজিশন ফর্মে সূচিত হয়েছে। তবে এগারো শতকের তুলনায় আকারের দিক থেকে তাদের শৈলী সেভাবে বদলায় নি, যতটা না বদলেছে অলঙ্করণের দিক থেকে। পেডেস্টল ও জ্যোতিশ্চক্রের বিস্তৃতি ও অলঙ্কৃত মোটিফের আধিক্য এত বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে যে, প্রধান ভাস্কর্যটি নিজেই দ্বিতীয় সারিতে চলে গিয়েছে।

জ্যোতিশ্চক্রগুলি ঢাকা পড়ে যায় স্বর্গীয় প্রাণী যেমন- হাতির উপর সিংহ, রাজহংস, কিন্নর-কিন্নরী, গন্ধর্ব-গন্ধর্বী এবং সবার উপরে পৌরাণিক প্রাণীর মুখ, ‘কীর্তিমুখ’ দ্বারা। সেনরা তাদের আবাসভূমি কর্ণাটকে প্রচলিত কীর্তিমুখকে বাংলার শিল্প অলঙ্করণের শেষ নিয়ামক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। মাঝে মাঝে স্থাপত্যিক মোটিফ যেমন মন্দিরের ফাসাদ ও স্তূপ জ্যোতিশ্চক্রের স্থান দখল করে। পেডেস্টলগুলির অলঙ্করণেও আধিক্য এবং রথের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এই সংখ্যা পাঁচ থেকে এগারোর মধ্যে ছিল। রথের সামনের অংশ আচ্ছাদিত হতে থাকে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী এবং তাদের গোলাকার চক্র অংশটি অলংকৃত হয়ে ওঠে ফুলেল নকশা ও সেই সাথে নরত্ব আরোপমূলক অলঙ্করণ দ্বারা। ফলে বহু সমতলের পেডেস্টল তাদের পূর্বের তীক্ষ্ণ অ্যাঙ্গেল হারিয়ে অর্ধ গোলাকার হয়ে ওঠে। তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মূর্তির পেছনের পাথর এবং প্রধান দেবতার বর্ধিতাংশ মসৃণ করে কেটে ফেলার কারণে। ফলে উঁচু রিলিফের জায়গা দখল করে গোলাকার প্লাস্টিক ফর্ম। আবার জ্যোতিশ্চক্রটি ছিদ্রযুক্ত করায় পেছন থেকে আলোর চলাচলে প্রকৃত অর্থেই এটি প্রভামন্ডলে রূপান্তরিত হয়। এই রীতিটি সম্ভবত এগারো শতকের শেষ দিকে উপস্থিত হয়, যা মূর্তিগুলিকে নতুন শৈলীগত ব্যাপ্তি দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করে।

বারো শতকের ভাস্কর্যগুলিও তাদের পূর্ববর্তী যুগের ভাস্কর্যগুলির মতো অসাধারণ ছিল। তাই এই শতকের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা কঠিন। তাই পাল-সেন রীতির চূড়ান্ত পর্যায়ের ভাস্কর্যগুলি সম্বন্ধে একটি সাধারণ জ্ঞান অর্জনের জন্য এর মধ্য থেকে সামান্য কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত চূড়ান্ত পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ভাস্কর্যের মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের কয়েকটির মধ্যে শিব, সদাশিব (চিত্র-১৫), সূর্য, কার্তিক (চিত্র-১৬) ও শ্যামাতারা অন্তর্ভু&ক্ত। এগুলি বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের অবলোকিতেশ্বর এবং ভারতীয় জাদুঘরের ব্রহ্মা ও কসর্পন অবলোকিতেশ্বর এবং উত্তর বঙ্গের আরও কিছু ভাস্কর্য বাংলার পরিণত ভাস্কর্য শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যদি অলংকরণ ও ভরাট শরীরকে হিসেবে আনা হয় তাহলে দক্ষিণ বিহারেও এই বিকাশ একই রকম ছিল। তবে কিছু কিছু ফিগারে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাদের শরীরের লম্বা গড়নে এবং কোমরের কাছে তীক্ষ্ণ বাঁকে। নালন্দার জাদুঘরে সংরক্ষিত নালন্দার কসর্পন অবলোকিতেশ্বর এ ধরনের রীতির একটি নমুনা। এ অঞ্চলের অন্যান্য অসাধারণ ভাস্কর্য যেগুলি এই রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, সেগুলি হলো ব্রোঞ্জের তৈরী বুদ্ধত্রয়, বোধগয়া প্রত্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত ফতেহপুরের অবলোকিতেশ্বর ও মৈত্রেয় এবং পাটনা জাদুঘরে সংরক্ষিত কুরকিহরের লোকনাথ ভাস্কর্য। আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা থেকে প্রাপ্ত মহিষাসুরমর্দিণী এবং ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত রাজশাহীর গরুড় মূর্তিগুলি তাদের শরীরের বলিষ্ঠ ভাঁজে সম্ভবত কর্ণাটকের হোয়শল শিল্প রীতির ছাপ বহন করছে।

তের শতকের প্রথম দিকে বাংলায় মুসলিম বিজয়াভিযানে পরাজিত সেনগণ পদ্মার পূর্ব পাড়ে সরে আসে এবং দেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজ ক্ষমতা বজায় রাখে। সম্পদের অভাব সত্ত্বেও সেনগণ খোদাই কর্মে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখে। তবে শৈলীগত দিক বিবেচনা করলে এই যুগে নতুন কোন ধারা সৃষ্টি হয় নি। এভাবেই পাল-সেন যুগের ভাস্কর্যের পূর্ব ভারতীয় রীতির দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে, যা মধ্য যুগের প্রথম দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। তবে গুরুত্বপূর্ণ যে, এই রীতি মহাযান-তন্ত্রযান বৌদ্ধদের হাতে হাতে বাংলার সীমা ছাড়িয়ে উত্তরে নেপাল ও তিববত, পূর্বে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণে শ্রীলংকা ও ইন্দোনেশিয়াতে বিস্তার লাভ করে।  [অশোক কে ভট্টাচার্য]