বারবোসা, দুয়ার্তে

বারবোসা, দুয়ার্তে (?- ১৫২১)  ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যানানোর ও কোচিনে পর্তুগিজ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য ও রাজনীতির এক চমকপ্রদ বিবরণ রেখে গেছেন। বারবোসার বাবা সম্ভ্রান্ত বংশীয় দিয়োগো বারবোসা ব্রাগাংকার ডিউক-এর অধীনে কাজ করতেন। তিনি ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দুয়ার্তের চাচা গোঙ্কালো গিল বারবোসা ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে পেদরো আলভারেজ ক্যাবরেল-এর নেতৃত্বাধীন নৌ-বহরের সাথে ভারতে আসেন। পর্তুগিজ ফ্যাক্টর হিসেবে তিনি কোচিনে থেকে যান। সম্ভবত দুয়ার্তেও ক্যাবরেলের বাহিনীর সাথে ভারতে আসেন এবং তিনি তাঁর চাচার সাথে কোচিনে থেকে যান। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুয়ার্তে বারবোসা মালয়ালাম ভাষা রপ্ত করে ফেলেছিলেন এবং তিনি ফ্রান্সিসকো ডি আলবুকার্ক ও ক্যানানোরের রাজার সাক্ষাৎকারে দ্বোভাষীর ভূমিকা পালন করেন। দুয়ার্তের প্রকাশিত চিঠিপত্রের মধ্যে ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে পর্তুগালের রাজার কাছে লিখিত চিঠি থেকে এটি পরিষ্কার যে, তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত প্রধান লিপিকারকের পদটি পান নি এবং গভর্নর দিয়োগো কোরেরার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনও এক সময়ে বারবোসা পর্তুগালে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর গ্রন্থটি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর শ্যালক ফারনাও ডি ম্যাগেলাসের সাথে ফিলিপাইনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল আইল অব সেবু-র নিকট ম্যাগেলাস মারা যান। ওই বছর ১ মে স্থানীয় রাজা স্পেনীয়দের নির্বিচারে হত্যা করেন। নিহতদের মধ্যে বারবোসাও ছিলেন।

১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস থেকে প্রকাশিত রামুসিও-র ইতালীয় গ্রন্থে দুয়ার্তের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লিসবন থেকে উদ্ধারকৃত একটি পর্তুগিজ পান্ডুলিপি ১৮১৩ সালে প্রকাশ করা হয়। পান্ডুলিপিটির স্পেনীয় সংস্করণ বার্সিলোনা ও মিউনিখে সংরক্ষিত আছে। পর্তুগিজ ভাষা থেকে প্রথম ইংরেজি অনুবাদ সম্পন্ন হয় লর্ড স্ট্যানলি কর্তৃক (হ্যাকল্যুত সোসাইটি, ১৮৬৫ সাল) এবং এম.এল ডেমস ইংরেজি ভাষায় দ্বিতীয় অনুবাদ গ্রন্থটি An Account of the Countries Bordering on the Indian Ocean and Their Inhabitants ১৯১৮ সালে সম্পন্ন করেন ।

বারবোসা আফ্রিকা, আরব, পারস্য (আরবীয় পারস্য) ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বর্ণনা দিয়েছেন। ষোল শতকের প্রথম পাদে ঐশ্বর্যশালী আবিসিনীয়দের ওপর তাঁর অসাধারণ বর্ণনা এখন পর্যন্ত অনন্য হিসেবে বিবেচিত। ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সবচেয়ে পুরনো বিবরণ যাঁদের লেখায় পাওয়া যায়, বারবোসা তাঁদের মধ্যে অণ্যতম। সে সঙ্গে তিনি আরও বর্ণনা করেছেন কিভাবে পর্তুগিজরা এই বাণিজ্যিক পথটি তাদের আবিষ্কৃত উত্তমাশা অন্তরীপের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এর ফলে তুর্কি সাম্রাজ্যের ওপর প্রচন্ড আঘাত নেমে আসে। লোহিত সাগরের দক্ষিণপশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু কিছু উপজাতির মধ্যে কন্যা শিশুর উপর অস্ত্রোপচারের যে বিবরণ বারবোসা দিয়ে গেছেন তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে।

লোহিত সাগর অঞ্চলীয় বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের প্রধান চাবিকাঠি এডেন বন্দর দখলে আলবুকার্ক-এর ব্যর্থতার কথা বারবোসা বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, হরমুজ প্রণালীর ওপর পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণের ফলে লোহিত সাগর অঞ্চলের সাথে ভারত ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে তুর্কিদের রাজস্ব আয় সংকুচিত হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেছেন যে, পর্তুগিজরা আরবের দক্ষিণপূর্ব উপকূলের সমৃদ্ধ ঘোড়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাজ্যসমূহ এবং বিজয়নগরে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

বারবোসা গুজরাট ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার মানুষ ও তাদের জীবন-যাপন প্রণালী এবং সেই সাথে তাদের উন্নত বাণিজ্যের এক বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন। ইউরোপীয় লেখকদের বর্ণনায় সকল মুসলমানকে ‘মুর’ হিসেবে অভিহিত করার প্রবণতা থাকলেও বারবোসা কোথাও কোথাও তুর্কি, আরব, পারস্যদেশীয়, খোরাসানী প্রভৃতি জাতি হিসেবে তাদের উল্লেখ করেছেন। আর হিন্দুদের উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি শুধু রাজপুত ও ব্রাহ্মণদের কথা বলছেন। তিনি জৈন বানিয়াদের কথাও উল্লেখ করেছেন যারা মাছ-মাংস খেত না, এমনকি তারা জীবন্ত পোকামাকড়ের পরিবর্তে মুসলমানদের অর্থ প্রদান করত। ক্যাম্বের মুসলমানগণ যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলত তিনি তাও উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে কিছু ছিল অভিবাসী এবং কিছু ছিল ধর্মান্তরিত। তারা বেহিসেবী জীবন-যাপন করত। তিনি ক্যাম্বের শিল্প, বিশেষ করে সুতি ও রেশম শিল্প এবং এগুলির নির্মাতা সুদক্ষ কারিগরদের কথা উল্লেখ করেছেন। ক্যাম্বেতে ঘোড়া চালিত গাড়ির যে তথ্য তিনি দিয়েছেন তা হলো সর্বপ্রাচীন। ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলি সম্পর্কে বারবোসা প্রদত্ত বিবরণ পর্তুগিজ আগমনের প্রাক্কালে ভারতের সমৃদ্ধ বাণিজ্যের ইঙ্গিত দেয়। বিজয়নগর শহর ও বাণিজ্য থেকে এর সমৃদ্ধি সম্পর্কিত বিবরণ এবং সেই সাথে সেখানকার রাজার উদারতা, এ সব কিছুই বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।

তবে বাংলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি অন্যান্যদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বেঙ্গলা শহর সম্পর্কে তাঁর উল্লেখ বেশ কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কোন কোন পন্ডিত একে সপ্তগ্রাম বলে শনাক্ত করেন। মুসলমান বণিকদের জীবন-যাত্রাপ্রণালী ও তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত বারবোসার বিবরণ বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এই মুসলমান বণিকেরা খোজার ব্যবসাও করতো। তাঁর বিবরণে বাংলায় হিন্দু বণিকের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে, বহির্বাণিজ্যের সমস্তটাই মুসলমান বণিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মুসলমানদের হাতে ছিল বেশ কিছু সংখ্যক জাহাজের মালিকানা। সুতি বস্ত্র ও চিনির ব্যবসা, বিশেষ করে দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশসমূহের সাথে একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা প্রমাণ করে।

এক যুগ-সন্ধিক্ষণে বারবোসার বিবরণ শুধু বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সেসময়ের জাতিতাত্ত্বিক বিবরণও এর গুরুত্বের পরিধিকে বাড়িয়েছে অনেক গুণ। অবশ্য তিনি এসবের অনেক কিছুই অন্যান্য সূত্র হতে সংগ্রহ করেছেন।  [অনিরুদ্ধ রায়]

গ্রন্থপঞ্জি  EF Oaten, European Travellers in India, Lucknow , 1973; ML Dames (tr. & ed.), The Book of Duarte Barbosa, 2 Vols, ASEA, Indian reprint 1989.