পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ঢাকা

পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ঢাকা  স্থানীয় সরকারের একটি ধরন বা ব্যবস্থা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছিল এ ব্যবস্থা। এখানে উল্লেখ্য, মহল্লার মুসলমান ও হিন্দু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল ভিন্ন। তবে, মুসলমান অধিবাসীদের মধ্যে গড়ে উঠা এ ব্যবস্থার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকরও ছিল।

ঢাকার এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ওপর পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় নি। উনিশ শতকে লেখা ঢাকার ওপর দুটি বইয়ে লেখক জেমস টেইলর ও ওয়াল্টার্স অনেক খুঁটিনাটি তথ্য দিয়েছেন, কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ওপর কিছুই জানান নি। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত জেমস ওয়াইজের গ্রন্থে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। ঢাকা পঞ্চায়েতসমূহের তত্ত্বাবধায়ক খাজা আজম ‘দি পঞ্চায়েত সিস্টেম অব ঢাকা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন ১৯০৭ সালে। অনুমান করা যায় যে, উনিশ শতকের মধ্যভাগের আগে ঢাকায় এ ব্যবস্থা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তা সুসংহত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ঢাকার নওয়াব পরিবারের উত্থানের সঙ্গে এবং নওয়াব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার প্রতিটি মহল্লার পঞ্চায়েত সুদৃঢ় হয়েছিল। নওয়াবগণ নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার মাধ্যম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করেছিলেন।

ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উদ্ভব সম্পর্কে ডা. ওয়াইজ মনে করেন, প্রতিটি মুসলমান কওম বা শ্রেণিতে আছে পঞ্চায়েত। ব্যবসাবাণিজ্য এবং অন্য ব্যাপারে পঞ্চায়েতের অলিখিত আইনের কেউ বিরোধিতা করলে তার বিরুদ্ধে নেওয়া হয় কঠোর ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের মঙ্গলই পঞ্চায়েতের কাম্য। এ আদালত ‘সেক্যুলার এবং রিপাবলিকান’ যেখানে প্রতিটি সদস্যের ভোটদানের ক্ষমতা সমান যদিও পঞ্চায়েতের সভাপতির মতামতই প্রতিফলিত হয় প্রায় ক্ষেত্রে।

খাজা আজম ওয়াইজের ব্যাখ্যা নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁর মতে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিশ্চিতভাবে চালু করেছিলেন পূর্ব ‘বঙ্গের মুষ্টিমেয় আদি ধর্মান্তরিত ও বহিরাগত মুসলমানরা। তাদের প্রতিবেশী হিন্দুরা সবসময় তাদের ম্লেচ্ছ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। সুতরাং সামাজিকভাবে নিজেদের রক্ষার জন্য এ ধরনের সংগঠনের তাদের দরকার ছিল। এছাড়াও, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ওপর ফকিরদের (অর্থাৎ সাধু) প্রভাব ছিল বেশ। তারাও পঞ্চায়েত গঠনে প্রভাবিত করেছিলেন। এ প্রভাব বোঝা যায় পঞ্চায়েতে ব্যবহূত বেশ কিছু শব্দে যেমন, চান্দা যা ফকিররাই ব্যবহার করতেন। যেমন কোন কিছু ভাগ হলে পঞ্চায়েতের সর্দার দুভাগ পান, ফকিরদের ক্ষেত্রেও তাই হয়। এটি হিন্দুদের থেকে ধার করা তা ঠিক নয়। কিন্তু, খাজা আজমের এযুক্তি মেনে নেওয়াও কষ্টসাধ্য। আদি মুসলমানরা যদি এ ব্যবস্থার উদ্ভাবক হয়ে থাকেন, তাহলেও আশেপাশের কোন ব্যবস্থা নিশ্চয় তাদের প্রভাবিত করেছিল। কথাটা এভাবে বলা যেতে পারে, হিন্দুদের বিভিন্ন বর্ণ বা গ্রুপের নিজস্ব পঞ্চায়েত ছিল যা প্রধানত রক্ষা করত ব্যবসা বাণিজ্য বা পেশাগত স্বার্থ। অনেকটা গিল্ডের মতো। এ প্রথা পরে হয়ত পরিব্যাপ্ত হয়েছিলো হিন্দুদের সামাজিক জীবনেও। ধর্মান্তরিত মুসলমানরা হয়ত অসচেতনভাবে তা গ্রহণ করেছিলেন। খাজা আজম নিজেও লিখেছেন মুসলমান শাসক বা মুগলরা এ ব্যবস্থা চালু করে নি। সুতরাং এ ব্যবস্থা প্রাচীন। শুধু ঢাকায় নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় চালু ছিল পঞ্চায়েত। বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম প্রদেশ, বোম্বাই ও দক্ষিণ ভরতের প্রাচীন আমল থেকেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল।

প্রাচীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বা হিন্দুদের দল প্রভাব ফেলেছিল ঢাকাবাসীদের উপর। বিভিন্ন মহল্লায় প্রধানত নিজেদের বিরোধ মেটাবার জন্য তারা সৃষ্টি করেছিলেন পঞ্চায়েতের এবং ক্রমে তা পরিব্যপ্ত করে নিয়েছিলো মহল্লাবাসীদের জীবন। তবে পঞ্চায়েত মুসলমানদের হলেও তা ধর্মীয় কোন সংগঠন ছিল না, বিশেষ করে বিচার-আচারের জন্য প্রয়োজন ছিল বিচক্ষণ উপদেশ। তাই মহল্লার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, হিন্দু বা মুসলমান সদস্য হতেন পঞ্চায়েতের। হিন্দুদের ‘দল’ বা পঞ্চায়েত থেকে ছিল এটি আলাদা কারণ, হিন্দুদেরটির ভিত্তি ছিল বর্ণ এবং খুব সম্ভব তা তাদের পেশাগত ব্যাপারেই মনোযোগ দিত বেশি।

মুসলমানদের মধ্যেও পেশাগত কিছু পঞ্চায়েত ছিল যেমন, ভিস্তিদের। ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বসবাসকারী ভিস্তিদের নিয়ে ছিল এ পঞ্চায়েত। মুহররমের সময় তাদের পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো নওয়াব ভিস্তি। কারণ, মুহররম মিছিলে ভিস্তিদের ছিল বিশেষ ভূমিকা এবং এ পদ ছিল বংশানুক্রমিক। কিন্তু এ ছিল পেশাগত ব্যাপার। মহল্লায় থাকলে তাকে মানতে হতো নিজ মহল্লা পঞ্চায়েতের নির্দেশ। এদিক থেকেও ঢাকার পঞ্চায়েত ছিল অন্য সব পঞ্চায়েত থেকে আলাদা।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এর পর নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ যখন ঢাকার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইলেন তখন গুণগত পরিবর্তন হয়েছিল পঞ্চায়েতে। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল পঞ্চায়েতে এবং নওয়াব পরিবার তাঁদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন পঞ্চায়েতকে।

ঢাকা শহরের আদিবাসীদের ’কুট্টি’ বলা হতো। ভদ্রলোকরা কুট্টিদের থেকে নিজেদের আলাদা করে দেখতেন। কারণ, কুট্টিদের অধিকাংশ ছিলেন অশিক্ষিত ও দরিদ্র। কিন্তু ঢাকায় তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মহল্লায় মহল্লায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত পঞ্চায়েত। এবং পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রণ করলে তারাও নিয়ন্ত্রিত থাকতেন।

খাজা পরিবারের কর্তারা তাই করেছিলেন। কুট্টি তথা পঞ্চায়েতকে তারা অর্থ সাহায্য করতেন। নওয়াব পরিবারের প্রধান বিভিন্ন মহল্লার পঞ্চায়েত সর্দারকে পাগড়ি পরাতেন। সব পঞ্চায়েতকে একত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়কের পদ আর সে পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন খাজা আজম। পঞ্চায়েতের সর্দাররাও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নওয়াবকে দেখতেন মুসলমানদের নেতা ও তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে, তবে সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর পরিবর্তন এসেছিল সে ব্যবস্থায়।

ঢাকা শহরের প্রতিটি মহল্লায় ছিল একটি করে পঞ্চায়েত। এর সদস্য ছিলেন মহল্লার সমস্ত মুসলমান বাসিন্দা। মহল্লার প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠান, অন্যান্য কার্যাবলি, এককথায়, মহল্লার মুসলমানদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত এ পঞ্চায়েত। মহল্লার বিবাদ বিসম্বাদ সবকিছুর মীমাংসা হতো এ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে।

১৯০৭ সালের দিকে, খাজা আজমের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার পঞ্চায়েতের সংখ্যা ছিল একশত তেত্রিশটি। এ একশত তেত্রিশটি পঞ্চায়েত বিভক্ত ছিল দুভাগে-বারা (বারো) এবং বাইস (বাইশ)। ‘বারা’ এবং ‘বাইস’ নাম দুটির উদ্ভবের কারণ অবশ্য খাজা আজম জানান নি। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয়েছিল পঞ্চায়েতগুলিকে। যে সব মহল্লার অধিবাসীরা মুসলমানি বাংলা বলতেন তারা ছিলেন ‘বাইস’ পঞ্চায়েতের অধীনে। এ পরিপ্রেক্ষিতে খাজা আজম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘বারা’র সদস্যরা ধর্মান্তরিত মুসলমানদের উত্তর পুরুষ এবং ‘বাইস’ এর সদস্যরা বহিরাগত মুসলমানদের। মনে হয়, ‘বারা’র মুসলমানরা ছিলেন ঢাকা শহরের বাইরে থেকে যারা এসে বসতি বেঁধেছিলেন ঢাকায়, তারা। ভাষা ছিল তাদের বাংলা। ‘বাইসে’র সদস্যরা ছিলেন মুগল ও বহিরাগত মুসলমান, যারা এখানে বিয়ে করেছিলেন বা যাদের ঔরসজাত উত্তরাধিকারী ছিলেন বা যারা ঢাকা এসে ফিরে যাননি, তাদের উত্তর পুরুষরা। তারা উর্দু অথবা বাংলা উর্দু মিশেল ঢাকাইয়া কথা বলতেন। তবে, ‘বারা’র মুসলমানরা যে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন না এমন নয়। ঢাকা শহরে ‘বারা’ পঞ্চায়েতের সংখ্যা ছিল বাহাত্তরটি আর ‘বাইস’ পঞ্চায়েতের সংখ্যা ছিল একষট্টিটি। সমস্ত পঞ্চায়েতসমূহ আবার পরিচিত ছিল দায়রা-ই-মুতিয়ুল-ই ইসলাম নামে।

পঞ্চায়েতের গঠন, আয়ের উৎস বা কার্যাবলি সম্পর্কে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে তেমন হেরফের নেই। এক্ষেত্রে খাজা আজমের গ্রন্থ নির্ভরযোগ্য। পঞ্চায়েত গঠিত হতো মহল্লার পাঁচজন প্রতিনিধি সমন্বয়ে। সম্মিলিত ভাবে তাঁরা পরিচিত ছিলেন পঞ্চ লায়েক বিরাদার নামে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সর্দার বা মীর-ই-মহল্লা যার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো পঞ্চায়েত। খাজা আজম লিখেছেন, আগে পঞ্চায়েতের সর্দার গদি পেতেন বংশানুক্রমে, কিন্তু গত বিশ বছর ধরে (অর্থাৎ ১৯০৭ এর আগে) সর্দার নির্বাচিত হচ্ছেন। তবে দেখা গেছে, সর্দারের মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ বা পরিবারের প্রভাবশালী কোন সদস্যই নির্বাচিত হচ্ছেন সর্দার। পঞ্চায়েতসমূহের তত্ত্বাবধায়ক অবশ্য ইচ্ছে করলে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করতে পারতেন। নওয়াব পরিবারের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই বোধ হয় করা হয়েছিল এ নিয়ম।

সর্দার নির্বাচনের পর অন্যান্য পঞ্চায়েতের সর্দাররা মিলে ঠিক করতেন নতুন সর্দার পঞ্চায়েতের ফান্ডে কত টাকা চাঁদা দেবেন। সর্দারি গ্রহণ করার দিন মহল্লার সবাই মিলে সর্দারকে উপহার দিতেন একটি পাগড়ি। এ পাগড়ি পরিচিত ছিল সর্দারি পাগড়ি নামে। মহল্লার সবাই চাঁদা দিয়ে তৈরি করে দিতেন এ পাগড়ি। নওয়াব সলিমুল্লাহ বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে সর্দারদের পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। সর্দারি গ্রহণ করার পর সর্দার মহল্লার সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। সর্দার কাজে গাফিলতি দেখালে বা পঞ্চায়েতের কাজ পরিচালনায় অক্ষম হলে, পঞ্চায়েতের সদস্যরা তাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন।

মহল্লার সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে সর্দারকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হতো। মহল্লায় কারও মৃত্যু হলে, মহল্লাবাসীদের খবর দেওয়া, কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা এসব দায়িত্বও ছিল সর্দারের। এক কথায় মহল্লার সবকিছু নির্ভর করত সর্দারের উপর।

সাধারণত মহল্লার প্রভাবশালী (বা অর্থশালী) ব্যক্তিই সর্দার হতেন। খাজা আজমের বইয়ের পরিশিষ্টে মহল্লার সর্দারদের যে তালিকা পাওয়া গেছে সেখানে সর্দারদের পেশার উল্লেখ নেই। কিন্তু নামগুলি পড়লে দেখা যায়, বেশ কিছু সর্দার হয়েছেন যাঁরা ছিলেন বেপারি ও খলিফা। দুজন ডাক্তারের নামও পাওয়া গেছে। অনেকের নাম দেখে ধরে নেওয়া যায় যে, তারা তেমন বিত্তবান ছিলেন না। তবে মনে হয়, মহল্লায় বিত্তবান হওয়াই সর্দার নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা ছিল না। খানদান বা পেশী ক্ষমতাও ছিল খুব সম্ভব যোগ্যতার মাপকাঠি।

পঞ্চায়েত সর্দারের পর স্থান ছিল ‘নায়েব সর্দার’-এর। সর্দারের অনুপস্থিতিতে নায়েব সর্দারকে পালন করতে হতো সর্দারের দায়িত্বসমূহ।

মহল্লা দুজন বয়োজ্যেষ্ঠও পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হতেন। তাঁরা পরিচিত ছিলেন লায়েক বিরাদার নামে। পঞ্চায়েতের পঞ্চম সদস্য পরিচিত ছিলেন গুরিদ নামে। তিনি ছিলেন বার্তাবহ। কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে বা কারও মৃত্যু হলে গুরিদের মারফত সর্দার খবর পাঠাতেন মহল্লার সবাইকে।

সামাজিক অনুষ্ঠানের তদারকি ছাড়াও পঞ্চায়েতের একটি প্রধান কাজ ছিল মহল্লার সব ধরনের বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করা। মহল্লার বিবাদ বিসম্বাদ দেখা দিলে সালিশির জন্যে যে কোন পক্ষ পঞ্চায়েতের বৈঠকের জন্যে অনুরোধ জানাতে পারত, তবে এর খরচ আহবানকারী পক্ষকে বহন করতে হতো। খরচ ছিল পান তামাকের, অন্য কিছুর নয়। সাধারণত এ ধরনের বৈঠক ডাকা হতো বৃহস্পতিবার রাতে। বাদি-বিবাদি ছাড়াও মহল্লার যে কেউ যোগ দিতে পারতেন মজলিস বা বৈঠকে। ‘লায়েক বিরাদার’ এবং সর্দার প্রশ্ন করতেন বাদি-বিবাদিকে। তারপর দেওয়া হতো রায়। দুপক্ষকেই মেনে নিতে হতো পঞ্চায়েতের রায়। এ রায়ের প্রতি কোন রকম অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা যেত না। তবে, ইচ্ছে করলে অন্যান্য পঞ্চায়েতের সর্দারদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে ঐ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যেত। বিশ-ত্রিশ-এর দশকে, সর্দাররা কোন বিবাদ মেটাতে না পারলে যেতেন কাজী জহুরুল হক, কাজী আলাউদ্দীন, হাকিম হাবিবুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর এবং কাজী ইসমাইলের কাছে। এঁরা ছিলেন ঢাকার সে আমলের প্রধান প্রধান ব্যক্তিত্ব। মনে হয়, নওয়াব সলিমুল্লাহর পর পঞ্চায়েতের ওপর নওয়াব পরিবারের আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছিল এবং ত্রিশ দশকে সে প্রভাব বোধহয় আর তেমন ছিল না। এ সময় নওয়াব পরিবারের বিকল্প হিসেবে উপরিউক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁরা জমিদার ছিলেন না বটে, কিন্তু ছিলেন খানদানি বংশের, স্বচ্ছল এবং শিক্ষিত এককথায় আহসান মঞ্জিল এর বিপরীতে নতুন যুগের প্রতিনিধি। সমাজে এঁদের আধিপত্যই তখন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

মহল্লার পঞ্চায়েতের রায়ের বিরুদ্ধে সাধারণত কেউ আপীল করতে যেতেন না। মহল্লা পঞ্চায়েতকে সহজে কেউ ঘাটাতে চাইতেন না। মহল্লার পঞ্চায়েতের রায় যদি কেউ না মানার সাহস দেখাতেন তবে তাকে একঘরে করা হতো। সামাজিকভাবে এ বর্জন পরিচিত ছিল বুন্দ নামে। যে ব্যক্তির ওপর এ ‘বুন্দ’ জারি করা হতো তার সবর্নাশ হয়ে যেত। ঐ ব্যক্তি যদি নিজেরে মহল্লা ছেড়ে অন্য মহল্লায়ও যেত তাহলেও সেই ‘বুন্দ’ জারি থাকতো। ঢাকা শহরে তার পক্ষে তখন বসবাস করা হয়ে উঠত অসম্ভব।

আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আরেক ধরনের শাস্তি ছিল। অপরাধীর পেটে কাঁঠাল বেঁধে বেত মারা হতো এবং তারপর বলা হতো দৌড়াতে। এরপর সর্দার সন্তুষ্ট হলে অপরাধী মুক্তি পেত।

শহরের সমস্ত সর্দারদেরও একটি কাউন্সিল ছিল, এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে। কোন সর্দার কোন কারণে অভিযুক্ত হলে এ কাউন্সিলে তার বিচার হতো এবং কাউন্সিলের রায় তাকে মেনে নিতে হতো। অবশ্য কাউন্সিলের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে, সর্দারের অধিকার ছিল পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধায়কের কাছে আপীল করার। এবং এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের রায়ই ছিল চূড়ান্ত।

পঞ্চায়েতের আরেকটি কাজ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে সাহায্য-সহযোগিতা করা। যে দুটি ধর্মীয় উৎসব পালনে পঞ্চায়েতকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে হতো তা হল মুহররম ও ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম।

পঞ্চায়েতের আয়ের নির্দিষ্ট কয়েকটি উৎস ছিল। মহল্লার প্রতিটি নতুন অধিবাসীকে পঞ্চায়েতের সদস্য হওয়ার জন্য চাঁদা দিতে হতো।

মহল্লার যে কোন বিয়েতে, কনের মহল্লার পঞ্চায়েত বরের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নজরানা নিতো। এ ব্যাপারে প্রতিটি মহল্লায় নিজস্ব রেট ছিল। এ নজরানার নাম ছিল, পঞ্চায়েতই রাকাম। যদি কনের পিতা মহল্লার অন্য কারও জমিতে বা বাড়িতে বাস করতেন তাহলে বরকে ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ছাড়াও দিতে হতো আরও কিছু অর্থ। এর নাম ছিল হাক্কি-ই জমিনদার-যার পরিমাণ সাধারণত এক টাকার বেশি হতো না। পঞ্চায়েত ঐ টাকা দিয়ে দিত কনের পিতার বাড়িঅলাকে। কনের মহল্লার মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যেও বরকে কিছু টাকা দিতে হতো যা পরিচিত ছিল হক-ই-আল্লাহ নামে।

পঞ্চায়েতের স্থাবর সম্পত্তি ছিল পঞ্চায়েতের ঘর যা পরিচিত হতো বাংলা নামে। এ ‘বাংলা’য় দিনে মক্তব বসত মহল্লার ছেলেমেয়েদের জন্য, আর রাতের বেলা তা পরিণত হতো মহল্লা ক্লাবে। ‘বাংলা’য় ব্যবহূত এবং রক্ষিত জিনিসপত্র যেমন, সতরঞ্জি, বাতি, হুঁকো, গোলাপ পাশ, সামিয়ানা ইত্যাদিও ছিল পঞ্চায়েতের স্থাবর সম্পত্তির অন্তর্গত। পঞ্চায়েত ফান্ডের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সর্দার।

ঢাকার পাঞ্চায়েত ব্যবস্থা কবে লুপ্ত হয়েছিল জানা যায় নি, তবে, ধরে নেওয়া যায় চল্লিশ দশক থেকেই। অর্থনীতির নতুন বিন্যাস, ১৯৪৭-এর পর বিশাল পরিবর্তন সবকিছুই সাহায্য করেছিল এর বিলুপ্তিতে। সম্প্রতি, ঢাকার দ’ুএকটি মহল্লায় আবার নতুনভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালুর প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। [মুনতাসীর মামুন]