গজনবী, স্যার আবদুল করিম

গজনবী, স্যার আবদুল করিম (১৮৭২-১৯৩৯)  একজন পর্যটক, অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী, বঙ্গীয় শাসন পরিষদের (Bengal Governor's Executive Council) সদস্য ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ও ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, মুসলিম শিক্ষার সংস্কারক এবং বঙ্গীয় মুসলিম রেনেসাঁর অন্যতম দিকপাল। আবদুল করিম গজনবী ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট তারিখে বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানাধীন দেলদুয়ার গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল হাকিম খান দেলদুয়ারের জমিদার ছিলেন। স্যার আবদুল হালীম গজনবী (১৮৭৬-১৯৫৩) ছিলেন তার ছোট ভাই। করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী (১৮৫৫-১৯২৬) ছিলেন আবদুল করিম গজনবীর মাতা এবং বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন তাঁদের খালা। আবুল আসাদ মুহম্মদ ইবরাহিম সাবের ও আবু জায়গাম মুহম্মদ খলিল সাবের দুজন ছিলেন গজনবী ভাইদের মামা। বিদ্যানুরাগী মাতা করিমুন্নেসার উৎসাহ-উদ্দীপনায় আবদুল করিম গজনবী ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারের অন্তর্গত এক্সমাউথের সেন্ট পিটার্স স্কুল, লন্ডনের মেসার্স রেন অ্যান্ড গার্নেজ ইনস্টিটিউশন ও লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি জার্মানির জেনা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছুকাল অধ্যয়ন করেন। ১৮৯০ সালে তিনি আই.সি.এস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইউরোপের কয়েকটি দেশ তিনি ব্যাপকভাবে সফর করেন এবং সেখানকার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। ১৮৯৪ সালে ২২/২৩ বছর বয়সে দেশে ফিরে আবদুল করিম গজনবী তাঁর পিতার জমিদারি এস্টেট পরিচালনার কাজ শুরু করেন। কথিত আছে যে, গজনবীদের পূর্ব পুরুষ আফগানিস্থানের গজনী প্রদেশ থেকে বাংলায় এসেছিলেন। তাই তাঁরা নামের শেষে স্থানবাচক গজনী শব্দ হতে গৃহীত ‘গজনবী’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। তাদের অন্যতম পূর্বপুরুষ ফতেহ্দাদ খান গজনবী লোহানীর নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে তারা জমিদারি প্রাপ্ত হন।

উনিশ শতকের প্রথম দশকে বঙ্গবিভাগকে কেন্দ্র করে আবদুল করিম গজনবীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাগ কার্যকর হলে তিনি কেবল তা সমর্থনই করেননি; বরং সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) দলের নেতৃবৃন্দের বঙ্গ বিভাগ-বিরোধী আন্দোলন প্রতিরোধ করারও চেষ্টা করেন। এ জন্য পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৯০৫-১৯০৬) স্যার জোসেফ ব্যাম্পফিল্ড ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫) বঙ্গভঙ্গ সমর্থনের জন্য আবদুল করিম গজনবীকে ‘রাইট গজনবী’ (ন্যায়পন্থী) বলে এবং বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেননি বলে  আবদুল হালিম গজনবীকে ‘রং গজনবী’ (ভ্রান্ত গজনবী) বলে অভিহিত করেন।

আবদুল করিম গজনবী পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের (১৯০৫-১৯১১) মুসলিম নির্বাচনী এলাকা হতে ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ভারতের ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের এবং বঙ্গ প্রেসিডেন্সির মুসলিম এলাকা হতে ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ভাইসরয় কাউন্সিলের সরকার মনোনীত সদস্য ছিলেন। তিনি যখন ভাইসরয় কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন, তখন হজযাত্রীদের যাতায়াতের বিষয় তদন্ত করার দায়িত্বভার আবদুল করিম গজনবীর উপর অর্পিত ছিল। সে-জন্য হজযাত্রীদের মক্কা-মদিনায় যাতায়াতের বিষয় আলোচনা করার উদ্দেশ্যে ১৯১৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক আবদুল করিম গজনবীকে একবার তদানীন্তন হেজাজের শাসনকর্তা শরিফ হোসাইন (১৯০৮-১৯২৪)-এর নিকট পাঠানো হয়েছিল। সে সময় তিনি ফিলিস্তিন ও সিরিয়া ভ্রমণ করেন।

১৯১৪ সালের ৩০ জুন তারিখে মুসলিম শিক্ষার উন্নতিকল্পে ডি পি আই ডব্লিউ. ডব্লিউ হর্নেল-এর নেতৃত্বে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট ‘মোহামেডান এডুকেশন এডভাইজারি কমিটি’ নামে গঠিত কমিটিতে তিনি অন্যতম বেসরকারী সদস্য ছিলেন। উক্ত কমিটিতে গজনবী সার্বিক মুসলিম শিক্ষানীতি, প্রাইমারি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত পাঠ্যসূচি, কারিগরি ও শিল্প শিক্ষা, নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে   বিস্তারিত সুপারিশমালা পেশ করেন।

মন্টেগু-চ্যেমসফোর্ড কর্তৃক ১৯১৯ সালে প্রণীত ভারত শাসন সংস্কার আইনের নীতিমালা অনুসারে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বঙ্গ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার (১৯২৪-১৯২৬) দ্বিতীয় নির্বাচনে এবং ১৯২৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত উক্ত সভার (১৯২৭-১৯২৯) তৃতীয় নির্বাচনে আবদুল করিম গজনবী ময়মনসিংহ দক্ষিণ-পশ্চিম (মুসলমান) নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচকমন্ডলীর প্রতিনিধিরূপে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দুইবারে মোট নয় মাস মন্ত্রিপদে অভিষিক্ত ছিলেন। প্রথমবারে ১৯২৪ সালে এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)-এর সাথে দুই মাস এবং দ্বিতীয়বারে ১৯২৭ সালে ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর সাথে (গজ-চক্র মন্ত্রিত্ব) সাত মাস।

১৯২৪ সালে আবদুল করিম গজনবী ‘শাসন সংস্কার তদন্ত কমিটি’তে সাক্ষ্য দেন। ওই সাক্ষ্যদান কালে তিনি ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসমূহ অবিকল ভারতে প্রয়োগ করা হলে তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তার নেতৃত্বে বাংলার ১৫ জন বিশিষ্ট মুসলিম নেতা সাইমন কমিশন-এর সমর্থনে পত্রিকায় বিবৃতি দেন। ১৯২৮ সালে আবদুল করিম গজনবীকে ‘বেঙ্গল সাইমন কমিটি’র সভাপতি এবং ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে ‘সর্বভারতীয় প্রাদেশিক সাইমন কমিটি’ সমূহের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে হার্টগ কমিটিতে সাক্ষ্য প্রদান কালে আবদুল করিম গজনবী বাংলাকেই বাঙালির সর্বজনীন মাতৃভাষারূপে অভিহিত করেন। তিনি মুসলমানদের কারিগরি ও বাণিজ্যিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং নারী শিক্ষাকে পুরুষদের শিক্ষার চাইতেও অধিকতর প্রয়োজনীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৩৪ সালের ৯ মে পর্যন্ত পাঁচ বছর তিনি ‘বেঙ্গল একজিকিউটিভ কাউন্সিল’-এর সদস্য ছিলেন। কাউন্সিল সদস্য থাকাকালে হজ্জ্ব সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়সমূহের দায়-দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত ছিল। দেশ সেবা ও সরকারি আনুগত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার আবদুল করিম গজনবীকে ১৯২৮ সালে ‘নাইট’ এবং ১৯৩৩ সালে ‘নওয়াব বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। স্যার আবদুল করিম গজনবী ছিলেন সরকারপন্থী রাজনীতিক। তিনি সব সময় সরকারের সুনজরে থেকে মুসলমান সমাজের উপকার করার চেষ্টা করেছেন। সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭)-এর কর্মকান্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে এর মাধ্যমে গজনবী মুসলিম সমাজের অনেক অভাব-অভিযোগ সরকারের নিকট তুলে ধরেন।

১৯৩৪ সালের ১০ মে তারিখে বাংলা সরকারের ‘এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল’ থেকে অবসর গ্রহণের পর আবদুল করিম গজনবী রাজনৈতিক জীবন হতে সম্পূর্ণ অবসর জীবনযাপন করেন।

তার লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল: (১) Pilgrim Traffic to Hedjaz and Palestine, (২) Muslem Education in Bengal এবং (৩) The Dyarchial System in Bengal।

আবদুল করিম গজনবী ১৯৩৯ সালের ২৪ জুলাই তারিখ সোমবার কলকাতায় তার বালিগঞ্জের বাসভবনে ব্রাঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ২৬শে জুলাই তারিখে তাকে দেলদুয়ারের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।  [মুহম্মদ আবদুস সালাম]

গ্রন্থপঞ্জি  ওয়াকিল আহমদ, উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা (১) বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩; Naresh Kumar Jain (ed.) Muslims in Indian (1), New Delhi, 1976. P.179; Humaira Momen, Muslim Politics in Bengal (A Study of Krishak Praja Party and the Elections).