কর্ণফুলি সেতু

কর্ণফুলি সেতু (Karnaphuli Bridge) চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও উপজেলায় কর্ণফুলি নদীর উপর স্টীল-পাইল ভিত্তি ও স্টীলের কাঠামো দ্বারা নির্মিত ৯১৯.৪৮ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটি সড়ক সেতু। মূলত নেদারল্যান্ডের ইস্টার্ন সেল্ড ব্রিজের (Eastern Scheldt Bridge) একটি ব্যবহূত অংশ বাংলাদেশে এনে এখানে স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের এলাকার অধিবাসীগণ চট্টগ্রাম শহরকে কর্ণফুলি নদী অতিক্রম করে দক্ষিণে সম্প্রসারণ করা এবং কক্সবাজারসহ অন্যান্য এলাকাকে সড়কপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কর্ণফুলি নদীর উপর একটি সেতু স্থাপনের দাবি করে আসছিল। চট্টগ্রামবাসীর এ দাবি পূরণ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার ডাচ সহযোগিতায় কর্ণফুলি নদীর উপর সেতু নির্মাণের জন্য রাজকীয় নেদারল্যান্ড সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে। ডাচ সরকার প্রকল্পটির অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর তাদের ইস্টার্ন সেল্ড ব্রিজের ৯২২ মিটার অংশ পুনর্ব্যবহার করার মাধ্যমে কর্ণফুলি নদীর উপর সেতু নির্মাণ করতে রাজি হয়। এ মর্মে ১৯৮৮ সালে ঢাকায় দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। দু’দেশের সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতার শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের ওপর দায়িত্ব পড়ে সেতুর দু’পাশের অভিগমন সড়কসমূহ (approach roads) নির্মাণ করার। মূল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৯ সালের জুন মাসে। সম্প্রতি এটির নামকরণ করা হয়েছে শাহ্ আমানত সেতু।

কর্ণফুলি সেতু

চট্টগ্রামের ইকবালঘাট ও সদরঘাট থেকে যথাক্রমে প্রায় ৭০০ মিটার ও ১.৫ কিমি উজানে এবং  কালুরঘাট সেতু থেকে প্রায় ৭ কিমি ভাটিতে কর্ণফুলি সেতু অবস্থিত। দু লেনবিশিষ্ট এ সেতুটি ৭ মিটার প্রশস্ত এবং লেনদুটির দু পার্শ্বে রয়েছে প্রতিটি দেড় মিটার প্রশস্ত দুটি ফুটপাত। সেতুর মেঝে বা পাটাতন অ্যাজোব কাঠের তক্তার উপর সুরক্ষাকারী বিটুমিনের আবরণ দ্বারা তৈরি। সেতুর নিচ দিয়ে নৌচলাচল উন্মুক্ততা তথা সেতুর পাটাতন এবং পানির লেভেলের মধ্যবর্তী ব্যবধান ১২.২ মিটার। সেতুটির ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২০০ কিমি বেগে প্রবাহিত  ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। সেতুর  ভূমিকম্প সহন ক্ষমতা ০.১০ জি তীব্রতাসম্পন্ন অনুভূমিক কম্পন পর্যন্ত এবং এর স্তম্ভসমূহ সর্বোচ্চ প্রতি সেকেন্ডে ২.৫ মিটার বেগবিশিষ্ট পানিস্রোত প্রতিরোধক্ষম। সেতুটি তাপমাত্রার সর্বোচ্চ ৪৫° সে পর্যন্ত উঠানামা সহনক্ষম। সেতুর অনুমোদিত রৈখিক ভারবহন ক্ষমতা প্রতিমিটারে ৩ কেএন। অভিগমন সড়কসহ মূল সেতু নির্মাণে তৎকালীন ব্যয় ছিল ১৪১৫.৩ মিলিয়ন টাকা যার মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৭৭৫.৪ মিলিয়ন টাকা।

চট্টগ্রাম শহর অংশে সেতুর অভিগমন সড়কের দৈর্ঘ্য ৫ কিমি এবং পটিয়া অংশে অভিগমন সড়কের দৈর্ঘ্য ১০.৫ কিমি। সেতুসহ অভিগমন সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১৬.৫ কিমি। বহদ্দারহাট থেকে ফকিরটেক পর্যন্ত ফুটপাতের প্রস্থ ৭.৩ মিটার এবং পটিয়া-আনোয়ারা সড়ক অংশের মধ্যবর্তী ফুটপাতের প্রস্থ ৫.৪৮ মিটার। বহদ্দারহাট থেকে ফকিরটেক পর্যন্ত সড়কের সর্বাধিক প্রশস্ততা ১২.২ মিটার এবং পটিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার মধ্যবর্তী অংশে এ প্রশস্ততা ৯.৭৫ মিটার। সেতুটির কাঠের পাটাতনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় উদ্বোধনের মাত্র ১০ বছরের মাথায় ২০০০ সাল থেকে সেতুটি ভারি যানবাহনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর সেতুটি পুনরায় চালু করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ও কুয়েত সরকারের যৌথ অর্থায়নে ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে তৃতীয় কর্ণফুলি সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার, প্রস্থ ২৪.৪ মিটার। চার লাইনের ফুটপাত ও ডিভাইডারসহ মূল সেতু ৮৩০ মিটার। এর মধ্যে ভায়াড্যাক্ট ১২০ মিটার। দু’পাশের সংযোগ সড়কসহ সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কুয়েত সরকার ঋণ সহায়তা দিয়েছে ৩৭২ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার বহন করেছে। শেষ পর্যন্ত পুরো সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৮০ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মাণ করেছে চীনা মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। সেতুর ১০টি পিলারের মধ্যে নদীর মাঝখানে চারটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ৬টি পিলার। এটি এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেইড প্রযুক্তিতে নির্মিত দেশের একমাত্র সেতু। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সংযোগ সড়কের কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। এর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের যাতায়াত সহজতর হবে এবং দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং মাসুদ হাসান চৌধুরী]

মানচিত্রের জন্য দেখুন চট্টগ্রাম জেলা