ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে

ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে  বাংলা ও এর বাইরে সর্বপ্রথম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তনকারী কোম্পানি। ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দি ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি পরবর্তী সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে নামে পরিচিত হয়। পূর্ব ভারতে বিস্তৃত রেলপথ নির্মাণে ইউরোপীয় পুঁজি বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা কাজে লাগাবার ক্ষেত্রে এটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ প্রতিষ্ঠানটির ঘনিষ্টতম অপর কোম্পানিগুলি ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে, সাউথ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে, নর্থ ওয়েস্টার্ণ রেলওয়ে ও সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া রেলওয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ সব কোম্পানি ছিল ইউরোপীয় পুঁজি ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। রেলওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন ছিল ব্রিটিশ পুঁজিবাদের একটি প্রকল্প। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে বাণিজ্যিকভাবে রেল যোগাযোগ শুরু হয়। এর বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা শীঘ্রই সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে রেলপথ নির্মাণের হুজুগ সৃষ্টি করে। রেলওয়ে ব্যবসা শুরু হওয়ার তিন দশকের মধ্যে এ খাতে পুঁজি বিনিয়োগ এত বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে যে, অনেক বিনিয়োগকারী বিদেশের রেলওয়ে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকে। মুনাফা অর্জনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত বিশেষ করে পূর্ব ভারতকে পুঁজি বিনিয়োগের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করা হয়। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার জন্য সর্বপ্রথম পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন রোলান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তিনি ভারত সরকারকে রেলপথ নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন।

১৮৪১ সাল থেকে স্টিফেনসন ও তাঁর দল ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, শ্রমশক্তি, কাষ্ঠ সম্পদ, আইনগত দিক এবং নতুন যোগাযোগ পদ্ধতির সম্ভাব্য বাজার সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৮৪৪ সালে তিনি তাঁর পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সবোর্ড অব কন্ট্রোল এর বিবেচনার জন্য পেশ করেন। একটি বন্দোবস্ত দলিলের মাধ্যমে লন্ডনে রেলওয়ে কোম্পানি গঠিত হয় (১ জুন ১৮৪৫)। দলিলে এ কোম্পানিকে একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এর নামকরণ হয় ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি’। শুরুতে এর মূলধন ছিল ৪০ লক্ষ স্টার্লিং এবং এ মূলধন ২৫০ স্টার্লিং মূল্যমানের ১৬,০০০ শেয়ারে বিভক্ত ছিল। তেরো জন সদস্য নিয়ে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স গঠিত হয়। স্টিফেনসন ছিলেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ভারত সরকার ও কোম্পানির মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৮৪৯ সালের ১৯ আগস্ট দুপক্ষে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে ভারত সরকার কোম্পানিকে রেলওয়ে খাতে প্রকৃত বিনিয়োগের ৫% মুনাফা প্রদানের অঙ্গীকার করে। এ চুক্তি দ্বারা সরকার কোম্পানিকে রেল লাইন ও রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট স্থাপনা নির্মাণের জন্য ক্ষতিপূরণ সহ প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের অধিকার প্রদান করে। ১৮৫১ সালে রেলপথ নির্মাণের প্রকৃত কাজ শুরু হয়। পরীক্ষামূলকভাবে কলকাতা থেকে বর্ধমান জেলার রানীগঞ্জ কয়লা খনি পর্যন্ত (১২১ মাইল) রেলপথ নির্মিত হয়। পরীক্ষামূলক রেললাইন স্থাপন করে প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় ১৮৫২ সালে দ্রুত রেল লাইনের সম্প্রসারণ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। এভাবে ভারতে রেল-যুগের সূচনা হয়।

পূর্ব ভারতে ভিক্টোরিয়ান রেল প্রযুক্তির বাস্তবায়ন ব্রিটিশ পুঁজি ও ভারতীয় শ্রমশক্তির একটি সাফল্য। হাজার হাজার মাইল রেললাইন এবং রেল সংশ্লিষ্ট বিপুল সংখ্যক স্থাপনা নির্মাণে হাজার হাজার শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কর্মস্থলে ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ প্রকৌশলী, দক্ষ শ্রমিক ও ওভারশিয়ার ভারতে আসেন। বিশ্ব বাজার থেকে নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। জলাভূমি, নদী ও খালের উপর বাঁধ, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। পাহাড় পর্বতের মধ্য দিয়ে সুড়ঙপথ কাটা হয়। হাজার হাজার ঠিকাদার, তস্য-ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের কাজ বরাদ্দ করে তাদের কাজে তদারকি ও সমন্বয় সাধন করা হয়। রেলপথ নির্মাণকাজে হাজার হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা সামাল দেওয়া হয়। সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে শ্রমিক অসন্তোষ ও স্থানীয় প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করা হয়। সবশেষে স্থানীয়দের মধ্য থেকে হাজার হাজার লোক নিয়োগ করে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং রেল চলাচল ও রেল স্থাপনাসমূহ ব্যবস্থাপনার কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথম অবস্থায়ই কোম্পানিকে এসব বিরাট প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয় এবং কোম্পানি সাফল্যের সঙ্গে তা অতিক্রম করে। এ কোম্পানি রেলওয়ে ব্যবস্থাকে একটি শিল্পে পরিণত করে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং অকল্পনীয় পরিমাণে মাল পরিবহণ করে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে নজিরবিহীন প্রসার ঘটায়।

কোম্পানির অংশীদারদের রাষ্ট্র কর্তৃক ৫% মুনাফার নিশ্চয়তা প্রদানের ফলেই রেলওয়ের এ অসাধারণ সাফল্য সম্ভব হয়।  অনেক অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন যে, মুনাফা প্রদানের এ ধরনের অঙ্গীকার সে কালে ইউরোপে ছিল অজ্ঞাত এবং এটি ছিল ব্রিটেনের পুঁজিপতিদের জন্য ঔপনিবেশিক শাসকদের রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত একটি ছাড়। তাদের মতে এর উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ব্রিটিশ শিল্পপতিদের উৎপাদিত পণ্য ভারতের দূরতম স্থানে বাজারজাত করা এবং অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা। উদ্দেশ্য যা-ই থাক না কেন এ রেলব্যবস্থা সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে যে অশেষ কল্যাণ বয়ে এনেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ রেলব্যবস্থা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃপ্রাদেশিক যাতায়াত ও কর্মকান্ডের বাধাগুলি সর্বপ্রথম অপসারণ করেছিল।  [সিরাজুল ইসলাম]