আলীবর্দী খান
আলীবর্দী খান (১৬৭৬-১৭৫৬) বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নওয়াব (১৭৪০-১৭৫৬)। তিনি প্রথম জীবনে মির্জা মুহম্মদ আলী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত মির্জা মুহম্মদের পুত্র। মির্জা মুহম্মদ ছিলেন আওরঙ্গজেব-এর দ্বিতীয় পুত্র মির্জা আজম শাহের দরবারের একজন কর্মচারী। তার মাতা ছিলেন খোরাসানে বসবাসকারী আফসার গোত্রীয় তুর্কি এবং তার পিতামহ ছিলেন আওরঙ্গজেবের বৈমাত্রেয় ভাই। মুহম্মদ আলী বয়োপ্রাপ্ত হলে আজম শাহ তাঁকে পিলখানার (হাতিশালা) তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন। অচিরেই তাঁকে জার্দোজখানার (জরিদার বস্ত্রের গুদামঘর) তত্ত্বাবধায়কের পদ প্রদান করা হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষক আজম শাহ ১৭০৭ সালে এক যুদ্ধে নিহত হলে তিনি চাকুরিহারা হন। ফলে তাঁর পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য ভাগ্যান্বেষণে তিনি বাংলায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তৎকালীন বাংলা অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় রাজনৈতিক ঝামেলামুক্ত ছিল। ১৭২০ সালে তিনি তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু বাংলার নওয়াব মুর্শিদকুলী খান তাঁকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেননি। ফলে তিনি কটকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কটকের শাসনকর্তা সুজাউদ্দীন তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করে একশ টাকা মাসিক বেতনে চাকুরি প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিশ্বস্ততা এবং উড়িষ্যায় অবাধ্য জমিদারদের দমনে সাফল্যের জন্য তাঁকে উচ্চপদে নিয়োগ করা হয়। এভাবে উড়িষ্যা হয়ে ওঠে বাংলার ভবিষ্যত নবাব মির্জা মুহম্মদ আলীর অনুশীলনের ক্ষেত্র।
সুজাউদ্দীনের শ্বশুর মুর্শিদকুলী জাফর খানের মৃত্যুর পর মির্জা মুহম্মদ আলী সুজাউদ্দীনকে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় সাহায্য করেন। মুর্শিদকুলীর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় সুজাউদ্দীনই ছিলেন বাংলার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী। কিন্তু জামাতা এবং শ্বশুরের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। ১৭২৭ সালের ৩০ জুন মুর্শিদকুলীর মৃত্যুর পর সুজাউদ্দীন মির্জা মুহম্মদ আলীর চেষ্টায় বাংলার মসনদে আরোহণ করতে সমর্থ হন।
বুদ্ধিভিত্তিক পরামর্শ এবং অকৃত্রিম সেবার জন্য সুজাউদ্দীন মির্জা মুহম্মদ আলীর পরিবারকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেন। তিনি ১৭২৮ সালে মির্জা মুহম্মদ আলীকে গুরুত্বপূর্ণ আকবরনগর (রাজমহল) চাকলার (প্রশাসনিক বিভাগ) ফৌজদার নিয়োগ করেন, এবং তাঁকে ‘আলীবর্দী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। নতুন ফৌজদার আলীবর্দী খান একজন সুশাসক প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
সকল রাষ্ট্রীয় কার্যে সুজাউদ্দীন আলীবর্দীকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। নওয়াব আলীবর্দীর উপদেশের ওপর সুজাউদ্দীন এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে, এ সুবাহর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তাঁর মতামত নিতে সুজাউদ্দীন আলীবর্দীকে বছরে একবার রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠাতেন। ১৭৩২ সালে যখন সম্রাট মুহম্মদ শাহ বিহারকে বাংলা সুবাহর সাথে একীভূত করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই নওয়াব সুজাউদ্দীনকেই এ একীভূত বৃহত্তর প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু সুজাউদ্দীন সম্পূর্ণ প্রদেশকে তাঁর একক শাসনাধীনে রাখা সমীচীন মনে করেন নি। বিহার তাঁর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে মনে করে সুজাউদ্দীন ১৭৩৩ সালে আলীবর্দীকে বিহারের শাসনভার অর্পণ করেন। আলীবর্দীর এ দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিন পূর্বে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগমের (যার স্বামী ছিলেন জয়েনউদ্দীন আহমদ খান) গর্ভে সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না এবং সে কারণে এ শিশুকেই তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং তাকে লালন পালন করেন। আজিমাবাদে এক বছর অবস্থানের পর সুজাউদ্দীন আলীবর্দীকে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠান, তাঁকে ‘মহববত জং’ উপাধি প্রদান করেন এবং পাঁচ হাজারি মনসবদার (পদমর্যাদা) পদে উন্নীত করেন। এরপর আলীবর্দী আজিমাবাদে ফিরে যান।
কখনও কঠোর দমননীতি আবার কখনও নমনীয় নীতি গ্রহণ করে আলীবর্দী বিহারে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করেন। নতুন কর আরোপ না করে শুধু জমিদারদের কাছ থেকে সঠিকভাবে বকেয়া কর আদায় করেই তিনি সরকারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করেন। এর ফলে তিনি সুজাউদ্দীনের সুনজরে আসেন এবং নিজের অবস্থান অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন ও মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৭৩৯ সালের ১৩ মার্চ সুজাউদ্দীনের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র সরফরাজ বাংলার মসনদে আসীন হন। কিন্তু মাত্র এক বছর এক মাসের মধ্যেই ক্ষমতালিপ্সু বিশ্বাসঘাতক চক্রের ষড়যন্ত্রের ফলে তাঁর সরকারের পতন হয়। যে সব সরকারি কর্মকর্তা সুজাউদ্দীনের আমলে তাঁর অনুগত ছিল তাঁরাই সরফরাজের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সে সময়ে দিল্লি সাম্রাজ্যের ওপর বৈদেশিক আক্রমণ এসব ক্ষমতালিপ্সু কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক হয়। আলীবর্দী এবং তাঁর ভাই হাজী আহমদের জন্যও সেটা ছিল সুবর্ণ সুযোগ, কারণ তখন দিল্লির বাদশাহ মুহম্মদ শাহ নাদির শাহের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
অত্যন্ত সতর্কতা ও পারদর্শিতার সঙ্গে পরিকল্পনা করে আলীবর্দী বাংলার সুবাহদারি লাভের প্রয়াস পান। ১৭৪০ সালে দিল্লির রাজদরবারে অবস্থানরত তাঁর বন্ধু মুতামানউদ্দৌলার সহযোগিতায় তিনি দিল্লির বাদশাহ মুহম্মদ শাহের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা শাসনের সনদ লাভ করেন। এ সনদ বলে তিনি সরফরাজের কাছ থেকে বাংলার শাসনাধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার সুযোগ লাভ করেন এবং ১৭৪০ সালের ১০ এপ্রিল সংঘঠিত গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করেন। সে বছর এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তিনি বাংলার নওয়াব হিসেবে বাদশাহ মুহম্মদ শাহের স্বীকৃতি লাভ করেন। বাদশাহ তাঁকে ‘সুজাউল মুলক’ ও ‘হুসামউদ্দৌলা’ উপাধি প্রদান করেন।
গিরিয়ার যুদ্ধ আলীবর্দীকে বাংলা ও বিহারের অবিসংবাদিত নেতার মর্যাদায় উন্নীত করে। কিন্তু উড়িষ্যা তখনও তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, কারণ তখনও উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর রুস্তম জং (নিহত সরফরাজের আত্মীয়) তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করেন নি। কিন্তু ১৭৪১ সালের ৩ মার্চ ফুলওয়ারিয়ন নামক স্থানে এক যুদ্ধে আলীবর্দী রুস্তম জংকে পরাজিত করেন। পরে মির্জা বকরও আলীবর্দীর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে, কিন্তু যুদ্ধে আলীবর্দীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
১৭৪১ সালের শেষ নাগাদ আলীবর্দী তাঁর সব শত্রুকে পরাভূত করে সমগ্র বাংলা বিহার ও উড়িষ্যায় তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠ করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি মারাঠা আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন হন। তাঁর এলাকায় সর্বপ্রথম মারাঠা আক্রমণ সংঘঠিত হয় ১৭৪২ সালে। তারপর ১৭৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই মারাঠারা তার রাজ্য আক্রমণ করে। আলীবর্দী মারাঠাদের পরাজিত করেন এবং ১৭৫১ সালের মে অথবা জুনে নাগপুর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে মারাঠাদের বাধ্য করেন। তবে মারাঠা আক্রমণে বাংলার বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ও অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
মারাঠা আক্রমণ বিহারে আফগান বিদ্রোহ ত্বরান্বিত করে। আলীবর্দী এসব সমস্যা মোকাবিলার ঐকান্তিক চেষ্টা চালান। কিন্তু সার্বিকভাবে দুর্যোগ নির্মূল করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে ইউরোপীয় বণিকরা বাংলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আরও দুঃসাহসী হয়ে ওঠে, যেমনটি তারা করেছিল দক্ষিণ ভারতে।
এসব দুর্যোগ নওয়াবকে ভীষণভাবে বিষণ্ণ ও ভারাক্রান্ত করে তোলে এবং এতে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে থাকে। তিনি অচিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর মৃত্যু আসন্ন ভেবে তিনি তাঁর দৌহিত্র ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলাকে কাছে ডেকে দেশ শাসন সম্পর্কিত কিছু মূল্যবান উপদেশ দেন। ইতোমধ্যেই নওয়াবের অসুস্থতা মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং তিনি ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
আলীবর্দীর শাসন ১৬ বছর স্থায়ী হয়। প্রথম এগারো বছর তিনি বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় তাঁর শাসনাধীন অঞ্চলে তিনি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিতে পারেন নি। ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিনি যুদ্ধবিধবস্ত দেশে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হাতে নেন। যে সব অঞ্চল মারাঠা আক্রমণে ধ্বংস হয় সেগুলি পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন এবং কৃষকদের চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু পুনর্গঠন কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নওয়াব পরলোক গমন করেন। [মোহাম্মদ শাহ]