লালদিঘি

লালদিঘি  চট্টগ্রামের একটি ঐতিহাসিক স্থান। লালকুঠি (মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তর) ও লালঘর (জেলখানা) এর সন্নিকটে অবস্থিত একটি পুকুরকে ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে পরিবর্ধন করে দিঘিতে রূপান্তর করা হয়। তখন থেকে দিঘিটি লালকুঠি ও লালঘরের নাম অনুসারে লালদিঘি নামে পরিচিত হয়। লালদিঘির চারপাশে পরবর্তীকালে কতিপয় স্থাপনা, মাঠ নির্মিত হয়। এ দিঘির পাড়ে মেলাও বসে। ‘লালদিঘি’ নামকরণটি অবশ্যই পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত। ব্রিটিশ আমলে পুলিশের প্রতীক ছিল লাল।

লালদিঘির রিকেট ঘাট  লালদিঘির পশ্চিম পাড়ের পাকা ঘাটটির নাম রিকেট ঘাট। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের কমিশনার স্যার হেনরী রিকেটস (১৮৪১-৪৮)-এর স্মৃতি রক্ষার্থে চট্টগ্রামের তৎকালীন জমিদারগণ এ ঘাট নির্মাণ করেন।

লালদিঘির ময়দান  পূর্বে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত সমগ্র সমতল এলাকা সেকালে মিউনিসিপ্যাল ময়দান নামে খ্যাত ছিল। উনিশ শতকের শেষার্ধে উত্তর-দক্ষিণ রাস্তাটি নির্মিত হলে মিউনিসিপ্যাল ময়দান দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। পূর্বাংশ সাধারণের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সে মাঠ মুসলিম হাই স্কুল খেলার মাঠ নামে পরিচিত হয়। এখন এ মাঠ লালদিঘির ময়দান। এ ময়দানকেই কেন্দ্র করে বিভিন্ন সভা সমিতির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতীয় এবং স্থানীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জববারের বলী খেলা

লালদিঘির বলী খেলা  বলীখেলা এক ধরনের কুস্তি। বল থেকে বলি। কুস্তিগীরদের চট্টগ্রামের ভাষায় ডাকা হয় বলী বা বলশালী। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে চট্টগ্রামে বলী খেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের লোকজ বলী খেলা এখন চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয় লালদিঘির ময়দানে প্রতি বাংলা সনের ১২ বৈশাখে। হাত পায়ের কসরত আর শক্তি দিয়ে অপরজনকে মাটিতে ফেলে পিঠ ঠেকাতে পারলেই জিতে যান একজন বলী। ১৯০৯ সালে লালদিঘিতে বলী খেলার প্রচলন করেন ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী আবদুল জববার সওদাগর। তাই জববারের বলীখেলা নামেও অভিহিত হয় এ কুস্তি খেলা।

লালদিঘির মেলা  বলীখেলা বা কুস্তি খেলা উপলক্ষে লালদিঘির চারপাশে রাস্তাজুড়ে বসে চার-পাঁচ দিনের মেলা। খোলা আকাশ বা সামান্য ছাউনি দিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। কুটির শিল্পের বিভিন্ন রকমের দ্রব্য, ছোটদের খেলনাপাতির জিনিস, নানা আকৃতির প্লাস্টিকের পুতুল, বাঁশি, মুখোশ, ঘর সাজানোর জন্যে বিভিন্ন কারুপণ্য, তৈজষপত্র মাটির পুতুল, ফল ও ফুলদানী, লোহা, কাঠ, বাঁশ বেত এবং মাটির তৈরি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, লোহার তৈরি দা, ছুরি, বঁটি, কোদাল, হামাল দিস্তা, তাওয়া, খুন্তি পিঠা বানানোর রকমারি খোলা আর ‘পুস’ নকশি হাড়ি এবং নানাবিধ পুতুল। হস্তশিল্পজাত, যেমন পাটের শিকে, দোলনা, থলে, টেবিলম্যাট, বেতের চেয়ার টেবিলসহ নানা ফার্নিচার সামগ্রী। ঐতিহ্যবাহী খাদ্যদ্রব্য, যেমন গজা, মোয়া, তিলের মোয়া, চিনিমাথা বুট, মুড়ি, বাতাসা, খৈ, জিলাপি, মিষ্টি, বাঙ্গী, তরমুজ, ডাব নারকেলসহ মৌসুমী ফল, নানা প্রকার মাছের শুটকি কেনাবেচা হয়। এর পাশাপাশি থাকে নাগরদোলা, ভ্যারাইটি শো, চরকি, সার্কাস এবং মেলার অন্যান্য অনুষঙ্গ। বহু লোকের সমাগম ঘটে এ মেলায়।

লালদিঘি পার্ক ও অন্যান্য  লালদিঘির পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ ও মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ে অত্যন্ত শোভনভাবে নানারকম গাছ ও ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে পার্ক। পার্কের দেওয়াল ঘেঁষে উইলো ও দেবদারুর সারি। ভোর ৬টায় থেকে ৮টা, বিকেল ৩টা থেকে ৭টা পর্যন্ত পার্ক উন্মুক্ত থাকে।

লালদিঘির রাজনীতি ও ব্যাবসায়িক গুরুত্ব  লালদিঘির ময়দান জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। লালদিঘির ময়দানে রাজনৈতিক সভা সমাবেশ জাতীয় গুরুত্ব বহন করে থাকে। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের ব্যবসায় কেন্দ্র। পূর্ব ও উত্তর পাড়ে ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন হোটেল গড়ে উঠেছে এ বাণিজ্যিক অঞ্চলে। দিঘির পাড় থেকে বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল করে। হাজার হাজার লোকের সমাগম হয় এখানে। সদা কর্মচঞ্চল লালদিঘি এলাকা চট্টগ্রামের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। [মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন]