হোসেন, মোহাম্মদ শরীফ
হোসেন, মোহাম্মদ শরীফ (১৯৩৪-২০০৭) শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক। ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি যশোর জেলা শহরের নিকটবর্তী খড়কি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা শফিউদ্দীন আহমদ এবং মাতা মেহেরুন্নেছা খাতুন-এর একমাত্র সন্তান।
মোহাম্মদ শরীফ হোসেন ১৯৪৯ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫১ সালে মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন।
ছাত্রাবস্থায় মোহাম্মদ শরীফ হোসেন মুসলিম ছাত্রলীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের সংগে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে প্রত্যক্ষভাবে ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং তিনি কয়েকবার কারাবন্দি হন। ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগ-এর দপ্তর সম্পাদক এবং ১৯৫৮ সালে যশোর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। ১৯৬২ সালে মোহাম্মদ শরীফ হোসেন মাইকেল মধুসূদন কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত থাকেন।
১৯৬৩-৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি) সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সর্বপ্রথম যশোরে বইমেলা প্রবর্তন করেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বই মেলার আয়োজন করেন এবং দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বই ব্যাংক গড়ে তোলেন। গ্রামাঞ্চলে তিনি সাধারণ মানুষকে ভ্রাম্যমাণ পাঠকেন্দ্রের মাধ্যমে বই পড়তে আগ্রহী করে তোলেন। মোহাম্মদ শরীফ হোসেন যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক থাকাকালে অনেক দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। তালপাতায় লেখা অনেক পান্ডুলিপি এখনও সংরক্ষিত আছে। ১৯৬৭ সালে যশোর জেলা কৃষক সমিতির কর্মকান্ডে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এ জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়।
শরীফ হোসেন ১৯৬৮ সালে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে যশোরে প্রথম নৈশবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গণশিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি কয়েকটি মাধ্যমিক ও প্রাইমারি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খড়কির পীর শাহ আব্দুল মতিন ও অধ্যক্ষ আবদুল হাই-এর সহযোগিতায় যশোরের খড়কি এলাকায় আঞ্জুমানে খালেকিয়া ও লিল্লাহ ট্রাস্ট নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই এতিমখানা প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজের ৫ বিঘা জমি দান করেন। মোট ১১ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত তিনতলা ভবন নিয়ে এতিমখানা। এ ভবনে রয়েছে ১৪টি ফ্লাট এবং অফিস রুম। ফ্ল্যাট থেকে প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ আয় হয় ৩০/৩৫ হাজার টাকা। এখানে বর্তমানে ১১০ জন এতিম ছেলে থাকে। তাদের থাকা-খাওয়া, লেখাপড়া, শিক্ষা এবং চিকিৎসার সব ব্যয় কর্তৃপক্ষ বহন করে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাষ্ট্রবিরোধিতার কারণ দেখিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। ৭ ডিসেম্বর যশোর জেলা পাকবাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হলে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭৫-৮৩ সালে খুলনায় সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপক এবং ১৯৮৯-৯০ সালে যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৯৪ সালে মোহাম্মদ শরীফ হোসেন নিজের বাড়ীর সামনে ‘সন্দীপন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি সমবায়ী, অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক এবং অবাণিজ্যিক সংস্থা। এখানে ৪৬ জন এতিম মেয়ে রয়েছে। এদের থাকা-খাওয়া, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যয় সন্দীপন কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকে। ৫ বছর থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়সের এতিম মেয়েরা এখানে বসবাস করে। হোম সাপোর্টের মাধ্যমে সন্দীপন ১৫ জন এতিমকেও লালনপালন করে। এ ছাড়া সন্দীপন ভবনে ৭০/৭৫ জন কলেজ ছাত্রী স্বল্প সিট ভাড়ায় থেকে বাইরে লেখাপড়া করছে। সন্দীপনের এ অংশের নাম ‘নারী উন্নয়ন কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দর্জিবিজ্ঞান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া গরিব, অসহায় ও দুস্থ মহিলাদের ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। সন্দীপনের অপর একটি প্রকল্প হলো কোচিং সেন্টার। যশোরের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ৫২টি কোচিং সেন্টার রয়েছে। এখানে দুস্থ ও গরিব ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে লেখাপড়া শেখানো হয়ে থাকে।
সন্দীপন কীটনাশকমুক্ত ফসল উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। শরীফ হোসেন দূষিত ফসল থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাবার জন্যে এ প্রকল্প গড়ে তোলেন। গ্রামে গ্রামে মসজিদে মসজিদে মিটিং করে ফসলদূষণ সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করা হয়। তিনি শ্রমজীবী নারী বিশেষ করে গৃহকর্মী নারীর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় গড়ে তোলেন দিবাযত্ন কেন্দ্র। এই দিবাযত্ন কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৬০টি শিশুকে রাখা হয়। এদের খরচ দিবাযত্ন কেন্দ্র বহন করে।
বাংলাদেশ সরকার মোহাম্মদ শরীফ হোসেনকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করেন। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয় এবং খড়কির পারিাবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। [আনোয়ারুল করিম]