হেকিমি চিকিৎসা
হেকিমি চিকিৎসা (Hakeemi Treatment) ইউনানি দর্শনভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। উদ্ভিজ্জ ভেষজ দ্বারা ঐতিহ্যিক ধারায় রোগ নিরাময়ের এই পদ্ধতির চিকিৎসকরা হেকিম নামে পরিচিত। হেকিম শব্দটি আরবি, ‘হিকমত’ অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও দক্ষতা থেকে উৎপত্তি। কথান্তরে জ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তিরাই হলেন হেকিমি চিকিৎসক। গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রেটিসের (৪৬০-৩৭৭ খ্রি) নীতি হেকিমি চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তি। এই পদ্ধতিতে ধরে নেওয়া হয় যে, মানুষের মানসিক ও দৈহিক প্রকৃতি চারটি দেহরস ড্যাম (রক্ত), বালঘাম (শেষ্মা, কফ), সাফরা (হলুদ পিত্তরস) ও সাউদা (কালো পিত্তরস) দ্বারা প্রভাবিত। একজন স্বাস্থ্যবান মানুষের শরীরে আত্মরক্ষামূলক অথবা স্বনিয়ন্ত্রক শক্তি কুওয়াত-ই-মুদাবিবরা (medicatrix naturae) দ্বারা সংরক্ষিত থাকে। কোন কারণে এই ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে শরীরে দেহরসের সুসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং রোগের আক্রমণ ঘটে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে দেহের এই হারানো ক্ষমতা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং এভাবে দেহরসের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারক্রমে রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।
হেকিমি চিকিৎসায় আঙুল দ্বারা নাড়ি অনুভবের মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করা হয়। এছাড়া রোগনির্ণয়ের জন্য আছে মূত্র, মল ইত্যাদির চাক্ষুষ পরীক্ষা। চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ইলাজ বিত-তদবীর (স্বাস্থ্যবিধিমূলক চিকিৎসা), ইলাজ বিল-ঘিজা (খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন চিকিৎসা), ইলাজ বিদ-দাওয়া (ভেষজ চিকিৎসা) এবং জারাহাত (শল্যচিকিৎসা)। স্বাস্থ্যবিধিমূলক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে রক্তমোক্ষণ, ঘর্মনিঃসরণ, মূত্রবৃদ্ধি, হামাম গোসল (turkish bath), দেহমর্দন, দহন, বিরেচন, ব্যায়াম ইত্যাদি। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে রোগীকে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ অথবা রোগীর উপযোগী খাদ্যের প্রকৃত পরিমাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ। দেহরস সাধারণত হজমকৃত খাদ্য থেকে উৎপন্ন এই ধারণার দরুন হেকিমি চিকিৎসায় পথ্যের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভেষজ চিকিৎসায় উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ থেকে স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্ত ভেষজ দ্রব্য ব্যবহূত হয়। এই চিকিৎসায় সাধারণত একক ঔষধ ব্যবহার অগ্রাধিকার পেলেও বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে প্রায়শই মিশ্র ঔষধের ব্যবস্থাও থাকে। অত্যল্প শল্যচিকিৎসাও হেকিমি পদ্ধতিতে চালু রয়েছে।
হিপোক্রেটিসের পর গ্যালেন (১৩১-২১০ খ্রি), আল রাজি (৮৫০-৯২৫ খ্রি), ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) প্রমুখ গ্রিক, আরব ও পারস্য দেশীয় ঔষধ প্রস্ত্ততকারক ও চিকিৎসক হেকিমি চিকিৎসার সেই আদিযুগে এই পদ্ধতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। দশম শতকে আরবদের মাধ্যমে হেকিমি চিকিৎসা ভারত উপমহাদেশে পৌঁছয়। এরপর এই পদ্ধতি দিলির সুলতান, খিলজী, তুঘলক ও মুগল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশসহ গোটা দেশে বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ আমলে পাশ্চাত্য চিকিৎসা প্রচলনের ফলে এ চিকিৎসা পদ্ধতিটি হুমকির সম্মুখীন হয়। তবে এক সময়ে জনমনে আস্থা অর্জনে সমর্থ হওয়ায় এটি আজও টিকে আছে। হেকিম আজমল খান (১৮৬৮-১৯২৭), হেকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ (১৮৮৩-১৯২২), হেকিম আব্দুল হামিদ (১৯০৮-?), হেকিম মোহাম্মদ সাইদ (১৯২০-১৯৯৮), হেকিম হাবিবুর রহমান প্রমুখ সুবিদিত ব্যক্তিদের চেষ্টা, শ্রম, ত্যাগ ও উৎসাহে হেকিমি চিকিৎসা সগৌরবে বিকশিত হয়েছে এবং অদ্যাবধি চালু রয়েছে।
হেকিমি চিকিৎসা বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত। ঢাকা ও সিলেটে সরকারী ইউনানি কলেজসহ বাংলাদেশে আরও কয়েকটি ইউনানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক বোর্ড। প্রায় ৪,০০০ অভিজ্ঞ ও পেশাগতভাবে সুদক্ষ হেকিম বর্তমানে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির চিকিৎসার সাথে জড়িত। [আবদুল গনি]
আরও দেখুন সামাজিক চিকিৎসা; সনাতন চিকিৎসা।