হুঁকা
হুঁকা আরবি শব্দ হুক্কার অপভ্রংশ রূপ এর অর্থ গোলাকার কৌটাবিশেষ। বাংলাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় হুঁকা শব্দটি প্রচলিত। হুঁকা বলতে বোঝায় ধূমপানের বিশেষ কৌশল বা তদুদ্দেশ্যে ব্যবহূত যন্ত্র। মুগল যুগে এদেশে ব্যবসারত ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা হুঁকাকে সম্বোধন করত ‘হাবল-বাবল’ (hubble-bubble)। ধূমপানের সময় হুঁকা থেকে বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়া নির্গত হতো বলে উক্ত নামকরণ করা হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলার লোকজনও উত্তেজক মাদক হিসেবে নানা ধরনের ধূমপানে অভ্যস্ত ছিল। তামাকের সিগারেট প্রচলনের পূর্বে ধূমপানের উপাদান ছিল গাঁজা, আফিম, ভাং ও অন্যান্য মাদক দ্রব্য। তামাকের আদি উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও মেক্সিকো। সতের’শ শতাব্দীর দিকে পর্তুগিজরা এদেশে তামাকের প্রচলন করে। অতি দ্রুতই বাংলায় তামাক সেবন জনপ্রিয় ও একটি সাধারণ নেশায় পর্যবসিত হয়। তামাক সেবনের অভ্যাস তৈরিতে বাঙালিরা উপাদান হিসেবে আমেরিকান তামাকই শুধু গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তারা আমেরিকান পাইপ পদ্ধতিকে গ্রহণ করে নি।
হুঁকা অনেক রকম হয়ে থাকে। নৃতাত্ত্বিক তথ্যানুযায়ী, প্রায় সব গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যে অতীতকালের মতোই এখনও স্ব স্ব বৈচিত্র্যময় হুঁকার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। দরিদ্ররা যে সহজ পদ্ধতির হুঁকা ব্যবহার করে তা নারকেলের খোল (মালা) বা মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি। তাতে একটি ছিদ্র করা থাকে। এর সঙ্গে বাঁশের বা কাঠের নল সংযুক্ত করা হয় এবং ছিলিম বা কল্কি নামের একট ছোট পাত্র নলের মাথায় জুড়ে দেওয়া হয়। ছিলিম বা কল্কি হচ্ছে একটি ফাঁপা কৌণিক ছোট পাত্র যাতে ধূমপানের জন্য প্রস্ত্ততকৃত তামাক ও জ্বলন্ত কাঠকয়লা পুরে দেওয়া হয়। ছিলিম বলতে একইসঙ্গে ধূমপানের তামাক ও তার আধারকে বোঝায়। ধূমপায়ীদের সাধারণ কথাবার্তায় শব্দটি এভাবে প্রযুক্ত হয় যে, ‘আরেক ছিলিম দাও’ যেমন করে বলা হয় ‘আরেকটা সিগারেট বা আরেক গ্লাস চলবে’ ইত্যাদি। হুঁকায় ব্যবহারের জন্য তামাক পাতাকে কেটে গুঁড়া করা হয় এবং ঝোলাগুড় বা চিটাগুড়ের সঙ্গে ভালভাবে মাখানো হয়। সাধারণ হুঁকায় ধূমপানের সময় নারকেলের মালায় বা পাত্রের গায়ের ছিদ্র দিয়ে ধোঁয়া টানতে হয়।
উচ্চ, অভিজাত শ্রেণির ব্যবহূত হুঁকাকে বলা হয় ফারসি (পার্শিয়ান) হুঁকা যার নিচের অংশের গঠনাকৃতি অন্যান্য হুঁকার চেয়ে ভিন্ন ও বিচিত্র। সাধারণ হুঁকায় যে ধরনের ছিদ্র থাকে, ফারসি হুঁকায় তার বদলে থাকে একটি পাইপ বা নল। ফারসি হুঁকার গায়ে ও ছিলিম পাত্রে নানা কারুকার্য থাকে। অভিজাত ব্যক্তিবর্গ উন্নতমানের তামাক ব্যবহার করে যা উৎকৃষ্ট চিটাগুড় ও অন্যান্য সুগন্ধিযুক্ত মসলাপাতি দিয়ে মাখানো হয়। রাজকীয় ব্যক্তি, জমিদার, অভিজাত ও বিত্তবান শ্রেণির হুঁকা বিচিত্র কারুকার্যে নকশামন্ডিত করা হতো।
বর্তমানে অভিজাত হুঁকা প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে। পূর্বে এসব অলঙ্করণযুক্ত সুদৃশ্য হুঁকা প্রস্ত্তত করার জন্য বিশিষ্ট কারিগর থাকত। ছিলিম প্রস্ত্ততের জন্যও ছিল সুদক্ষ অনুচর। তাদের বলা হতো হুঁকা বরদার। এরা বংশপরম্পরায় তাদের প্রভু ও উত্তরাধিকারীদের সেবা প্রদান করত। এভাবে হুঁকা বরদার হয়ে ওঠে সমাজের বিশেষ এক কর্মজীবী সম্প্রদায়।
উচ্চ অভিজাত শ্রেণির হুঁকা সাধারণত নানা ধাতব দিয়ে তৈরি হতো। এতে ছিল ফাঁপা ও দীর্ঘ সরু নল। ধূমপানের নল হতো বেশ লম্বা যাতে হুঁকা স্থানান্তর না করেও দূর থেকে হুঁকায় ধূমপান করা যায়। সুসজ্জিত হুঁকাটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হতো, লম্বা নলটিকে কুন্ডলী পাকিয়ে হুকার গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হতো। উক্ত নলকে নানা রং ও অলঙ্করণে সাজানো হতো যা ছিল হুকা মালিকের সম্পদ ও বিলাসিতার পরিচায়ক। ছিলিম তৈরির ক্ষেত্রে এই সম্পদ ও বিলাসিতার পরিচয় বেশি প্রদর্শিত হতো। ছিলিম প্রস্ত্ততকরণে ব্যবহূত হতো তামাক, চিটা গুড়, মদ, সুগন্ধিযুক্ত নির্যাস, ফল এবং মসলার মিশ্রণ। এরকম রাজকীয় ছিলিমের উদ্দেশ্যই ছিল দরবারের লোকজনকে নিজের বৈভব প্রদর্শন করে বিমোহিত করা। হুঁকা ব্যবহারের সুবর্ণযুগে এটি ছিল ব্যক্তির আভিজাত্য ও পদমর্যাদা প্রদর্শনের বস্ত্ত। হুকায় তামাক পরিবেশন ত্রুটিযুক্ত বা নিম্নমানের হলে ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন হতো।
হুঁকা বরদার নিয়োগের ফলে কিছুসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। তৎকালে পুণ্যাহ উৎসবে, বাঈজী নাচে, ভোজ অনুষ্ঠানে হুঁকা পরিবেশন ছিল অপরিহার্য। প্রত্যেক অভিজাত ব্যক্তিই কোন উৎসবে যোগদানের সময় হুঁকার বরদারসহ সঙ্গে কিছুসংখ্যক ভৃত্য রাখতেন। হুঁকা বরদারের কাজ ছিল প্রভুর ধূমপানের ছিলিমকে সবসময় জ্বালিয়ে রাখা। এদেশীয় রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের অনুকরণে ইউরোপীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও ধূমপানের জন্য হুকা ব্যবহার করতে শুরু করে। হুঁকা বরদারের এতই গুরুত্ব ছিল যে, বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস একসময় এরকম নির্দেশ দেন যে, তাঁর ভোজসভায় আমন্ত্রিত অতিথিরা যেন হুকা বরদার ব্যতীত অন্য কোন ভৃত্য সঙ্গে না নিয়ে আসে।
সমাজকাঠামো, আর্থব্যবস্থা ও প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হুঁকায় ধূমপান ব্যবস্থাটিরও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে উচ্চশ্রেণির মধ্যে হুঁকার পরিবর্তে চুরুট ও সিগারেট ব্যবহূত হচ্ছে এবং স্বল্প আয়ের লোকজনের মধ্যে বিড়ির প্রচলন বেড়েছে। তবে, গ্রামাঞ্চলে এখনও হুঁকা ধূমপানের ক্ষেত্রে তার প্রাধান্য বহাল রেখেছে। [সিরাজুল ইসলাম]