হার্বেরিয়াম
হার্বেরিয়াম একটি সংগ্রহশালা যেখানে থাকে স্বীকৃত শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি অনুসারে ধারাবাহিকভাবে সাজানো, সংরক্ষিত, শুষ্ক উদ্ভিদ নমুনা। শ্রেনিবিন্যাস ছাড়াও প্রতিটি উদ্ভিদ নমুনার সঙ্গে থাকে সংগ্রহের স্থান ও তারিখ, সংগ্রাহকের নাম, আবাস সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বিবরণ, স্থানীয় নাম ইত্যাদি তথ্য।
প্রত্যেকটি উন্নত ও অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই নিজস্ব জাতীয় হার্বেরিয়াম রয়েছে, যেখানে দেশের উদ্ভিদকুলের নমুনা সংরক্ষিত থাকে। অনেকগুলি বৃহৎ আন্তর্জাতিক হার্বেরিয়াম স্বদেশের ছাড়াও অন্যান্য দেশের উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষণ করে। লন্ডনের কিউ-এর রয়েল বোটানিক গার্ডেনে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম হার্বেরিয়াম। এখানে গোটা বিশ্বের বহু দেশের প্রায় ৬০ লক্ষাধিক উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে।
বিশ শতকের চলিশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের প্রধান, প্রফেসর পঞ্চানন মহেশ্বরীর কার্যকালে ঢাকায় হার্বেরিয়ামের পত্তন ঘটে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মী এবং রাজস্ব বিভাগের জনৈক কর্মচারী, শৌখিন উদ্ভিদবিদ এস.কে সেন এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছপালার নমুনা সংগ্রহ করে একটি হার্বেরিয়াম গড়ে তোলেন। এটিই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের হার্বেরিয়াম। দেশের গাছপালা সম্পর্কে শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদানে এই হার্বেরিয়াম ছাত্র-শিক্ষকদের প্রভূত সাহায্য যুগিয়েছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামের বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে ছোটখাটো হার্বেরিয়াম আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্বেরিয়ামগুলি উদ্ভিদশ্রেণীবিন্যাস শিক্ষণ ও গবেষণায় এবং বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হার্বেরিয়াম বন উদ্ভিদ সমীক্ষায় সহায়তা যোগায়। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহের সুবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হার্বেরিয়াম দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।
হার্বেরিয়ামে সংগ্রহের ভিত্তিতে অঞ্চল বিশেষের উদ্ভিদকুলের বর্ণনা, বিভিন্ন প্রজাতির বিস্তার ও এগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ব্যবহার নিবন্ধিত হয়। হার্বেরিয়াম লেবেলের তথ্যাদি থেকে দেশে প্রজাতিটির প্রাচুর্য বা দুর্লভতা অাঁচ করা যায় এবং তৎক্ষণাৎ বিপন্ন প্রজাতিগুলি সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। হার্বেরিয়াম উদ্ভিদ শনাক্তির একটি কেন্দ্রও, যেখানে কোন প্রজাতির আনুষ্ঠানিক সকল তথ্যই পাওয়া যায়। এটি একটি প্রতিষ্ঠানও, যা গাছপালার প্রামাণ্য নাম, প্রাকৃতিক পরিবেশে কোন প্রজাতির বর্তমান অবস্থা ও সেটি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার তথ্যাদি যোগায়। সম্প্রতি মীরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে বাংলাদেশ জাতীয় হার্বেরিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [মোঃ সালার খান]
হার্বেরিয়ামের পেস্ট (Pest of herbarium) বুক লাইস (book lice), সিলভারফিস (silverfish), আলমন্ড মথ (almond moth), সিগারেট বিটল (cigarette beetle) এবং কার্পেট বিটল (carpet beetle) হার্বেরিয়ামের পেস্ট হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বুক লাইস Psocoptera বর্গের অন্তর্গত Liposcelidae গোত্রের সদস্য। এ দলের Liposcelis species শুকনা নমুনার অংশ লেবেল, আঠা, কাগজ ইত্যাদি খেয়ে ক্ষতি করে।
সিলভারফিস Lepisma saccharina Thysanura বর্গের অন্তর্গত Lepismatidae গোত্রের সদস্য। মাকু-আকৃতির মাঝারি আকারের এ পেস্ট ডানাবিহীন। এরা সাধারণত সংরক্ষিত নমুনায় লাগানো আঠা এবং লেবেল খেয়ে থাকে। আলমন্ড মথের (almond moth) বৈজ্ঞানিক নাম Ephestia cautella। এরা Lepidoptera বর্গের Pyralidae গোত্রের সদস্য। লার্ভা অবস্থায় সংরক্ষিত উদ্ভিদ কিংবা তার অংশকে আক্রমণ করে। শুকনো উদ্ভিদ কিংবা উদ্ভিদের অংশ আটকানো কাগজের উপরে সিল্কসদৃশ ককুনের মধ্যে এদের পিউপা দশা সম্পন্ন হয়। E. cautella উদ্ভিদ সংরক্ষণাগারের খুবই মারাত্মক পেস্ট। এরা শুকনো উদ্ভিদের পাতা খেয়ে ও তার উপরে জাল তৈরি করে নমুনার ক্ষতি করে। এদের দেহ-নিঃসৃত বর্জ্য পদার্থ ও সিল্ক দ্বারা উদ্ভিদের না খাওয়া অংশেরও ক্ষতি হয়।
সিগারেট বিটল Anobiidae গোত্রের সদস্য, Lasioderma serricorne। এদের দেহ বেশ হূষ্টপুষ্ট, ডিম্বাকৃতি এবং রং লালচে-হলুদ। মাথা ও অগ্রবক্ষ নিচের দিকে বেঁকে থাকার জন্য পাশ থেকে এদের দেহ কুঁজাকৃতি বলে মনে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বিটল শুকনো উদ্ভিদ কিংবা উদ্ভিদের অংশে আটকানো কাগজের উপরে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে সেখানকার নমুনা খাওয়া শুরু করে।
কার্পেট বিটল Dermestidae গোত্রের সদস্য, Anthrenus scrophulariae। এরাও লার্ভা অবস্থায় হার্বেরিয়ামে সংরক্ষিত নমুনা আক্রমণ করে। সংরক্ষিত নমুনা ছিদ্র করে এরা ক্ষতি করে। কালো কার্পেট বিটলও (black carpet beetle, Attagenus piceus) সংরক্ষিত নমুনা আক্রমণ করে। এদের ক্ষতির ধরন ও প্রকৃতি সাধারণ কার্পেট বিটলের মতো। [আবদুল জববার হাওলাদার]
আরও দেখুন বাংলাদেশ জাতীয় হার্বেরিয়াম।