হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান
হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান (Hydrocarbon Exploration) বাংলাদেশে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান প্রথম শুরু হয় ১৯১০ সালে, যখন ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম প্রসপেক্টিং কোম্পানী (Indian Petroleum Prospecting Company) চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে প্রথম অনুসন্ধানী কূপ খনন করে। ১৯১৪ সালের মধ্যে সীতাকুন্ডে ৪টি এ ধরনের কূপ খনন করা হয়। কিন্তু সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয় নি। বার্মা তেল কোম্পানি ১৯২৩-১৯৩৩ সালের মধ্যে সিলেটের পাথারিয়ায় আরও ৩টি কূপ খনন করে। যদিও কূপগুলিতে তেল ও গ্যাসের সন্ধান রের্কড করা হয়, তথাপি এর আবিষ্কার সম্ভব হয় নি। আর এরই সঙ্গে (১৯১০-১৯৩৩) এই অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন তৎপরতার প্রথম পর্যায় শেষ হয়।
ভারত উপমহাদেশের বিভক্তির পর অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫১-১৯৭০) শুরু হয়। বার্মা অয়েল কোম্পানি পূর্বাঞ্চলে কয়েকটি কূপ খনন করে প্রথম দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে- ১৯৫৫ সালে সিলেটে ও ১৯৫৯ সালে ছাতকে। স্ট্যানভ্যাক (Standard Vacuum Oil Company) দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১৯৫৯-৬০ সালে সাফল্য ছাড়াই তিনটি কূপ খনন করে। শেল অয়েল কোম্পানী (Shell Oil Company) ১৯৬০-এর দশকে সবচেয়ে সফল অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা করে। এ সময় তারা দেশের পূর্বাঞ্চলে ৫টি বড় গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায়, যথা- তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ। ১৯৬৯ সালে জাতীয় তেল ও গ্যাস উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ওজিডিসি (OGDC-Oil and Gas Development Corporation) সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তৃতীয় পর্যায়ের (১৯৭১-১৯৮০) প্রসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭২ সালে পেট্রোবাংলা স্থাপিত হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বকসমূহে অনুসন্ধান কাজ চালাতে ১৯৭৪ সালে ৬টি বিদেশী তেল কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (PSC) স্বাক্ষরিত হয়। নিপ্পন অয়েল (BODC) দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ৩টি, মধ্যাঞ্চলে Arco ১টি এবং ইনা-ন্যাপথালিন (Ina-Napthalin) ২টি কূপ খনন করলেও ইউনিয়ন অয়েলই (Union Oil) একমাত্র কোম্পানি, যারা প্রথম ১৯৭৭ সালে উত্তর বঙ্গোপসাগরে গ্যাস আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে। ১৯৭৮ সালের মধ্যে সব বিদেশী কোম্পানিই তাদের নিজ নিজ বক পরিত্যাগ করে স্বদেশে পাড়ি জমায়। পেট্রোবাংলার অধীনে ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানী (National Oil Company) স্থলভাগে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালায়। তাদের মাধ্যমেই ১৯৭৭ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান কার্যক্রমের চতুর্থ পর্বে (১৯৮১-২০০০) কয়েকটি স্থলভাগ ও উপকূলীয় গ্যাসক্ষেত্র এবং একটি তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। আশির দশকে পেট্রোবাংলা ১৯৮১ সালে বিয়ানীবাজার, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। একমাত্র বাণিজ্যিক তেলক্ষেত্র হরিপুর ১৯৮৬ সালে আবিষ্কৃত হয় যার কৃতিত্ব ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানীর। এসময় দুটি বিদেশী তেল কোম্পানি কার্যরত ছিল-পার্বত্য অঞ্চলে শেল অয়েল এবং সিলেট অঞ্চলে সিমিটার (Scimitar)। ১৯৯০ সালের দিকে চট্টগ্রামের পাহাড়ে একটা শুকনো কূপ (dry well) খননের পর শেল এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। অন্যদিকে অনুসন্ধান সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব পূরণ না করায় এবং ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়ায় সিমিটারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়। অবশ্য সিমিটার সিলেটের জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে।
কয়েকটি বিদেশী তেল কোম্পানির অংশগ্রহণে নববইয়ের দশকে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে গতি আসে। হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের প্রথম পর্বের টেন্ডার ১৯৯৩ সালে ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে অক্সিডেন্টাল এক্সপোরেশন (Occidental Exploration), কেয়ার্ন এনার্জি (Cairn Energy), রেক্সউড ইন্টারন্যাশনাল (Rexwood International) ও ইউনাইটেড মেরিডিয়ান কর্পোরেশন (United Meridian Corporation) -এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কেয়ার্ন এনার্জি ১৯৯৬ সালে উত্তর বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায়। রেক্সউড ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে যে খনন চালায় তা শুষ্ক বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৯৬ সালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়া কূপে অক্সিডেন্টাল গ্যাস বিস্ফোরণজনিত বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ে। অবশ্য পরে একই স্থানে তারা গ্যাস পাওয়ার কথা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে কেয়ার্ন তার পরিচালনভার শেল অয়েলের কাছে এবং অক্সিডেন্টাল তার অংশীদার ইউনোকল কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে।
এই ইউনোকল-অক্সিডেন্টাল কোম্পানিই ১৯৯৮ সালে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিবিয়ানায় যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে, তা বাংলাদেশের বৃহত্তম বলে বিবেচিত। ইউনোকল ও শেল উভয় কোম্পানিই বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যরত। নববইয়ের দশকে ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি বাপেক্সও সক্রিয় ছিল, যদিও কিছুটা ধীর গতিতে। ১৯৯৫ সালে শাহবাজপুরে এবং ১৯৯৬ সালে শালদানদীতে আবিষ্কৃত দুটি গ্যাসক্ষেত্র তাদেরই অনুসন্ধানের ফসল। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় দফা টেন্ডার ঘোষণা করা হয়। নতুন পিএসসি চুক্তির অধীনে অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিত করতে দুই হাজার সালের প্রারম্ভেও অন্যান্য তেল কোম্পানিগুলির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত ছিল। [বদরুল ইমাম]